ভূত বা প্রেতাত্মা কি সত্যিই আছে? এই প্রশ্নটি যুগ যুগ ধরে মানুষের কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দুতে। হিন্দু ধর্মশাস্ত্র অনুযায়ী, মৃত্যুর পরে আত্মা কোথায় যায়, তা নির্ভর করে জীবনের কর্মফল ও সৎকারের উপরে। বিশেষত, গরুড় পুরাণ—হিন্দু ধর্মের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পবিত্র গ্রন্থ—এই বিষয়গুলিকে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করে। এই পুরাণে মৃত্যুর পরবর্তী জীবন, আত্মার গতি, এবং ভূত-প্রেতের রহস্য উন্মোচিত হয়েছে।
গরুড় পুরাণ কী বলে মৃত্যুর পরে আত্মা নিয়ে?
গরুড় পুরাণ অনুযায়ী, মানুষের আত্মা মৃত্যুর পরে একটি বিশেষ পথ অনুসরণ করে, যাকে “পিতৃলোকের গমন” বলা হয়। যদি সেই আত্মা পূর্ণ ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান অনুযায়ী সৎকার পায় এবং জীবনে সৎকর্ম করে থাকে, তাহলে সে মুক্তি লাভ করে বা পুনর্জন্ম লাভ করে। অন্যদিকে, যারা পাপকর্মে লিপ্ত থাকে বা অপূর্ণ ইচ্ছা নিয়ে মারা যায়, তারা ভূত, প্রেত, রাক্ষস বা অন্য কোনো অশুভ আত্মায় পরিণত হয়।
গরুড় পুরাণে ১৮ প্রকার ভূতের বর্ণনা
গরুড় পুরাণে বিভিন্ন প্রকার প্রেতাত্মা বা ভূতের বর্ণনা পাওয়া যায়। এরা প্রত্যেকে ভিন্ন ভিন্ন পাপের ফলস্বরূপ আত্মার বিকৃত রূপ। নিচে আমরা এই ১৮ প্রকার ভূতের ব্যাখ্যা তুলে ধরলাম:
১. ব্রহ্মরাক্ষস
এরা জীবদ্দশায় তন্ত্র-মন্ত্রে দক্ষ কিন্তু অশুভ উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত করত। মৃত্যুর পরে তারা সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ভূতে পরিণত হয়। এরা পরিবারের জন্য ভয়ানক হুমকি।
২. ডাইনি
যেসব নারী জীবনে কালো জাদু ব্যবহার করে মানুষের ক্ষতি করত, তারা মৃত্যুর পরে ডাইনি হয়ে ওঠে। বিশ্বাস করা হয়, ডাইনিদের পা উল্টো থাকে এবং তারা শিশু ও নারীদের বেশি টার্গেট করে।
৩. পৈশাচিক ভূত
এই ভূতেরা দানবীয় শক্তি দিয়ে জীবিতদের ক্ষতি করে এবং ভয় ছড়ায়। ঈশ্বরের নাম শুনলেই পালিয়ে যায়।
৪. প্রেত
যাদের সৎকার সম্পূর্ণভাবে হয়নি, তাদের আত্মা প্রেত হয়ে যায়। এরা চিরতরে তৃষ্ণা ও ক্ষুধার যন্ত্রণায় ভোগে এবং জীবিতদের কষ্ট দেয়।
৫. যক্ষ
ধনসম্পদে লোভী এবং অসৎ পথে সম্পদ অর্জনকারী ব্যক্তিরা যক্ষে পরিণত হয়। এরা ধনের পাহারাদার রূপে থেকে যায়।
৬. কুষ্মাণ্ড
অতিলোভ এবং অসত্ভাবে ধন-সম্পদ অর্জনের ফলে কুষ্মাণ্ড ভূতের জন্ম হয়। তারা সবকিছুর প্রতি ঘৃণাপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে।
৭. কিঙ্কর
মিথ্যাচার ও প্রতারণায় লিপ্ত ব্যক্তিরা মৃত্যুর পরে অপরাধবোধে ভোগে এবং কিঙ্কর ভূতে পরিণত হয়।
৮. রাক্ষস
রক্তপিপাসু এবং নৃশংস হত্যাকারীদের আত্মা রাক্ষস হয়ে ওঠে। তারা সর্বদা ধ্বংসের প্রতীক।
৯. শাকিনী ও ডাকিনী
মানুষের মনের ওপর প্রভাব ফেলে এরা। মানসিক দুর্বলতা বা বিভ্রান্তির মাধ্যমে ক্ষতি করে।
১০. বেতাল
এই ভূতেরা জীবিত মানুষের দেহে প্রবেশ করে এবং তাদের নিয়ন্ত্রণ করে। লোককথায় এসব ভূতের ব্যাপক উল্লেখ আছে।
১১. খেঁকর
সবসময় ক্ষতিকারী মনোভাব পোষণ করে। তারা দুর্ঘটনা, দুর্ভাগ্য ও বিপর্যয় ডেকে আনে।
১২. চেত
বিচলিত আত্মা যারা জীবিত অবস্থায় ভীষণ দুঃখ পেয়েছিল। তাদের আত্মা এখনো শান্তি পায়নি।
১৩. পেত্নী
অত্যাচারিত বা অন্যায়ভাবে নিহত নারীরা পেত্নী হয়ে প্রতিশোধ নিতে থাকে।
১৪. মহিষাসুর প্রেত
জীবিত অবস্থায় মহিষাসুরের মতো নিষ্ঠুরতা করে, মৃত্যুর পরে তারা ক্রোধের প্রতীক হয়ে ওঠে।
১৫. নিসাচর
রাত্রে সক্রিয় ভূত। দিনের আলো এড়িয়ে অন্ধকারে জীবনযাপন করে।
১৬. স্কন্ধক
যোদ্ধার আত্মা, যারা যুদ্ধে অপ্রাকৃতভাবে নিহত হয়েছে। প্রতিশোধ স্পৃহা তাদের চালিত করে।
১৭. অগ্নিশক্তি ভূত
যারা আগুনে পুড়ে মারা গেছে, তাদের আত্মা দুঃখ ও ক্রোধে পুড়ে যায় এবং মানুষের ক্ষতি করতে চায়।
১৮. চণ্ডভূত
এই ভূতেরা হিংসা ও ঈর্ষার প্রতীক, যাদের জীবনে অতিমাত্রায় ক্ষতিকারক মানসিকতা ছিল।
ভূত হওয়ার কারণ কী? গরুড় পুরাণের ব্যাখ্যা
গরুড় পুরাণ বলছে, অপূর্ণ বাসনা, অপরাধবোধ, পাপাচার, এবং সৎকারহীন মৃত্যু—এই চারটি মূল কারণ ভূত হওয়ার পিছনে কাজ করে। আত্মহত্যাকারী, দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু, যুদ্ধে নিহত এবং কন্যাদান/শ্রাদ্ধহীন আত্মা এই তালিকায় পড়ে।
এছাড়া যারা জীবদ্দশায় তন্ত্র-মন্ত্র বা কালো জাদুর অপব্যবহার করে মানুষের ক্ষতি করেছে, তারা অত্যন্ত শক্তিশালী ও বিধ্বংসী ভূতের রূপ নেয়।

ভূত মুক্তির উপায়: আত্মার পরিত্রাণের পথ
গরুড় পুরাণে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, পিতৃ তর্পণ, শ্রাদ্ধ, দান, এবং মন্ত্র উচ্চারণ—এই চতুর্ভুজ পদ্ধতিতে ভূতদের আত্মা মুক্তি পেতে পারে।
🌾 পিতৃ তর্পণ ও শ্রাদ্ধ
পিতৃপক্ষে পূর্বপুরুষদের স্মরণ করে জলদান, অন্নপ্রদান এবং পূজা। এটি আত্মাকে শান্তি দেয়।
🪔 দান ও পূণ্যকর্ম
অভাবীদের দান করলে, সেই পুণ্য মৃত আত্মার অংশ হয়।
🔥 যজ্ঞ ও মন্ত্রপাঠ
গায়ত্রী মন্ত্র, মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র প্রভৃতি মন্ত্র উচ্চারণ করে আত্মার শুদ্ধিকরণ সম্ভব।
উপসংহার
গরুড় পুরাণ কেবল ধর্মীয় গ্রন্থ নয়, এটি একটি আধ্যাত্মিক বিজ্ঞানের উৎস। এটি আমাদের সতর্ক করে দেয় যে, জীবনে ভালো কাজই শান্তির পথ। অন্যথায়, মৃত্যুর পর আত্মা বিভ্রান্ত হয়ে ভূত-প্রেতে পরিণত হয়। নিজের আত্মার মুক্তির জন্য যেমন সৎ জীবন অপরিহার্য, তেমনই পূর্বপুরুষদের আত্মার জন্য যথাযথ শ্রাদ্ধও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।