অবস্থা খারাপ হয়ে গেছিল আমেরিকার, চরম পরিণতি হয়েছিল বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী দেশের!

Spread the love

১৮৬১ থেকে ১৮৬৫ সাল পর্যন্ত সময়ে সংঘটিত আমেরিকার গৃহযুদ্ধ আধুনিক ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই যুদ্ধ কেবল একটি জাতির অভ্যন্তরীণ সংকটের প্রতিচ্ছবি নয়, এটি একটি জাতির ঐক্যের নতুন দিশা পাওয়ার সংগ্রাম হিসেবেও পরিচিত। আমেরিকার উত্তর এবং দক্ষিণের মধ্যে ক্রমাগত মতভেদ, বিশেষ করে দাসপ্রথা, অর্থনীতি এবং রাজনীতিকে কেন্দ্র করে, এই যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে। গৃহযুদ্ধ আমেরিকার ইতিহাসে এক গভীর ক্ষত রেখে গেলেও, এই যুদ্ধের মাধ্যমেই আধুনিক আমেরিকার ভিত্তি স্থাপিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ১৮৬১ থেকে ১৮৬৫ সাল পর্যন্ত সময়কালটি একটি গভীর ক্ষত এবং একইসঙ্গে পুনর্জন্মের প্রতীক। এই সময়কালে সংঘটিত হয়েছিল গৃহযুদ্ধ, যা আমেরিকার ইতিহাসে এক অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। দেশের উত্তর এবং দক্ষিণের মধ্যে ক্রমবর্ধমান মতভেদ, বিশেষ করে দাসপ্রথা এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক নীতিগুলির পার্থক্যকে কেন্দ্র করে এই যুদ্ধ শুরু হয়।

১৮০০ সালের শুরু থেকেই আমেরিকার উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে মতপার্থক্য বাড়তে থাকে। উত্তরাঞ্চল যেখানে শিল্পায়ন ও আধুনিক বাণিজ্যের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, দক্ষিণাঞ্চল ছিল মূলত কৃষিনির্ভর। দক্ষিণের অর্থনীতি সম্পূর্ণরূপে দাসপ্রথার উপর নির্ভরশীল ছিল। তুলা, তামাক, এবং অন্যান্য ফসল উৎপাদনের জন্য দাসশ্রম অপরিহার্য ছিল দক্ষিণাঞ্চলের জন্য। অন্যদিকে, উত্তরাঞ্চল দাসপ্রথাকে মানবাধিকারের পরিপন্থী মনে করত এবং এর বিলোপ চেয়েছিল। উত্তরাঞ্চল দাসপ্রথা বিলোপ করার পক্ষে ছিল এবং আধুনিক শিল্প ও বাণিজ্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছিল। অন্যদিকে, দক্ষিণাঞ্চল কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে বিশ্বাসী ছিল এবং দাসপ্রথার উপর তাদের অর্থনীতি নির্ভরশীল ছিল। এই মতভেদ ধীরে ধীরে রাজনীতিতেও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

১৮৬০ সালে রিপাবলিকান প্রার্থী আব্রাহাম লিঙ্কন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। লিঙ্কন দাসপ্রথা বিলোপের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, যা দক্ষিণাঞ্চলের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। লিঙ্কনের নির্বাচনের পর দক্ষিণাঞ্চলের ১১টি রাজ্য আমেরিকান ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করে।

দক্ষিণের ১১টি রাজ্য একত্রিত হয়ে ১৮৬১ সালে গঠন করে কনফেডারেট স্টেটস অব আমেরিকা। এই নতুন রাষ্ট্রের রাজধানী ছিল ভার্জিনিয়ার রিচমন্ড, এবং জেফারসন ডেভিস এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এই রাজ্যগুলি বিশ্বাস করত যে, তাদের স্বাধীনতা এবং অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করার জন্য বিচ্ছিন্ন হওয়া জরুরি।

কনফেডারেট স্টেটে অন্তর্ভুক্ত রাজ্যগুলি ছিল: দক্ষিণ ক্যারোলিনা, মিসিসিপি, ফ্লোরিডা, আলাবামা, জর্জিয়া, লুইসিয়ানা, টেক্সাস, আরকানসাস, টেনেসি, নর্থ ক্যারোলিনা এবং ভার্জিনিয়া। এই বিচ্ছিন্নতার পেছনে দাসপ্রথা ছিল মুখ্য কারণ।

১৮৬১ সালের এপ্রিলে দক্ষিণ ক্যারোলিনার ফোর্ট সাম্টারে প্রথম গুলি চালানোর মাধ্যমে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। উত্তরাঞ্চল এবং দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে মতপার্থক্যের পাশাপাশি সামরিক সংঘাতও তীব্র হয়। যুদ্ধের প্রথম দিকের অনেক লড়াইয়ে কনফেডারেট বাহিনী সফল হয়, কিন্তু উত্তরাঞ্চল দ্রুত তাদের সামরিক কৌশল পরিবর্তন করে।

গৃহযুদ্ধের সময় অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে, যা আমেরিকার ইতিহাসে চিরস্মরণীয়।

  1. গেটিসবার্গ যুদ্ধ (১৮৬৩): গেটিসবার্গ যুদ্ধ ছিল গৃহযুদ্ধের মোড় পরিবর্তনকারী একটি ঘটনা। উত্তরাঞ্চলের বিজয় কনফেডারেট বাহিনীর শক্তি দুর্বল করে দেয়। এটি গৃহযুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়। উত্তরাঞ্চলের বিজয় দক্ষিণাঞ্চলের জন্য একটি বড় ধাক্কা ছিল।
  2. এমান্সিপেশন প্রোক্লেমেশন: ১৮৬৩ সালে আব্রাহাম লিঙ্কন দাসপ্রথা বিলোপের জন্য এই ঘোষণা জারি করেন। এই প্রোক্লেমেশন দাসদের মুক্তির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এবং উত্তরাঞ্চলের নৈতিক অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করেছিল। উত্তরাঞ্চলের আদর্শিক অবস্থানকে আরও মজবুত করে।
  3. শেরম্যানের মার্চ টু দ্য সি (১৮৬৪): উত্তরাঞ্চলের সেনাপতি উইলিয়াম টেকুমসে শেরম্যান কনফেডারেট রাজ্যগুলির মধ্য দিয়ে ধ্বংসযাত্রা চালিয়ে দক্ষিণের মনোবল ভেঙে দেন।
  4. অ্যাপোম্যাটক্স কোর্ট হাউসে আত্মসমর্পণ (১৮৬৫): কনফেডারেট সেনাবাহিনীর নেতা রবার্ট ই. লি উত্তরাঞ্চলের জেনারেল উলিসেস এস. গ্রান্টের কাছে আত্মসমর্পণ করেন, যা গৃহযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটায়। কনফেডারেট সেনাবাহিনীর নেতা রবার্ট ই. লি আত্মসমর্পণ করেন, যা গৃহযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটায়।

যুদ্ধের শেষে, উত্তরাঞ্চল কনফেডারেট রাজ্যগুলিকে পরাজিত করে। ১৮৬৫ সালে গৃহযুদ্ধ শেষ হলে দক্ষিণের রাজ্যগুলি পুনরায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়। তবে যুদ্ধের ক্ষত এত সহজে মুছে যায়নি।

যুদ্ধের পরে, রেকনস্ট্রাকশন যুগ শুরু হয়। এই সময়ে দাসপ্রথার অবসান হয় এবং মুক্তিপ্রাপ্ত দাসদের অধিকার সুরক্ষিত করার জন্য নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়। ১৮৬৫ সালে ১৩তম সংশোধনী গৃহীত হয়, যা দাসপ্রথা সম্পূর্ণরূপে বিলোপ করে।

তবে, দক্ষিণাঞ্চল অর্থনৈতিক এবং সামাজিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। যুদ্ধোত্তর সময়ে বর্ণবৈষম্য এবং জাতিগত বিভাজন আরও তীব্র হয়।

গৃহযুদ্ধ আমেরিকার ইতিহাসে একটি গভীর ছাপ রেখে গেছে। এটি কেবল দাসপ্রথার অবসান ঘটায়নি, বরং আমেরিকাকে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসেবে গড়ে তুলেছে। এই যুদ্ধ আধুনিক আমেরিকার জন্ম দেয়।

আমেরিকার গৃহযুদ্ধ থেকে শেখা যায় যে মতভেদ এবং বিভাজনকে দূর করতে একতাই একটি জাতির প্রকৃত শক্তি। যুদ্ধের সময়ে আব্রাহাম লিঙ্কনের নেতৃত্ব এবং তার মানবাধিকারের প্রতি অঙ্গীকার আজও বিশ্বজুড়ে অনুপ্রেরণা দেয়।

১৮৬০ সালে রিপাবলিকান প্রার্থী আব্রাহাম লিঙ্কন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়লাভ করেন। তিনি দাসপ্রথা বিলোপের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, যা দক্ষিণাঞ্চলের রাজ্যগুলির জন্য একটি হুমকির সমান ছিল। এর ফলস্বরূপ, দক্ষিণের রাজ্যগুলি বিচ্ছিন্ন হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

কনফেডারেট স্টেটস অব আমেরিকা গঠন


১৮৬১ সালের ফেব্রুয়ারিতে দক্ষিণের ছয়টি রাজ্য—দক্ষিণ ক্যারোলিনা, মিসিসিপি, ফ্লোরিডা, আলাবামা, জর্জিয়া এবং লুইসিয়ানা—মন্টগোমারি, আলাবামায় একত্রিত হয়ে নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করে। এই নতুন রাষ্ট্রের নাম দেওয়া হয় কনফেডারেট স্টেটস অব আমেরিকা, এবং এর প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন মিসিসিপির জেফারসন ডেভিস। পরবর্তীতে টেক্সাস, আরকানসাস, টেনেসি, নর্থ ক্যারোলিনা এবং ভার্জিনিয়াও কনফেডারেট স্টেটে যোগ দেয়।

অবস্থা খারাপ হয়ে গেছিল আমেরিকার, চরম পরিণতি হয়েছিল বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী দেশের!

কনফেডারেট রাজ্যগুলি তাদের রাজধানী হিসাবে ঘোষণা করে ভার্জিনিয়ার রিচমন্ডকে। এই বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজ্যগুলি বিশ্বাস করত যে, তাদের স্বাধীনতা এবং নিজেদের অর্থনীতি রক্ষার জন্য আমেরিকান ইউনিয়ন থেকে আলাদা হওয়া প্রয়োজন।

১৮৬১ সালের এপ্রিলে দক্ষিণ ক্যারোলিনার ফোর্ট সাম্টারে প্রথম গুলি চালানোর মাধ্যমে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। উত্তরের ইউনিয়ন বাহিনী এবং দক্ষিণের কনফেডারেট বাহিনীর মধ্যে এই যুদ্ধ ধীরে ধীরে পুরো দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।

এই যুদ্ধ শুধুমাত্র সামরিক সংঘর্ষ ছিল না; এটি ছিল একটি আদর্শিক সংঘর্ষও। উত্তরাঞ্চল বিশ্বাস করত যে দাসপ্রথা একটি মানবাধিকার লঙ্ঘন, যেখানে দক্ষিণাঞ্চল দাসপ্রথাকে তাদের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অস্তিত্বের জন্য অপরিহার্য মনে করত।

গৃহযুদ্ধ পাঁচ বছর ধরে চলেছিল এবং এই সময়কালে ৬,২০,০০০-এর বেশি মানুষ প্রাণ হারায়। এটি আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। যুদ্ধের কিছু গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হল:

যুদ্ধ শেষে, দক্ষিণের কনফেডারেট রাজ্যগুলি পুনরায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যুক্ত হয়। আব্রাহাম লিঙ্কনের নেতৃত্বে পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়, যা রেকনস্ট্রাকশন যুগ নামে পরিচিত। এই সময়ে দাসপ্রথা সম্পূর্ণরূপে বিলোপ করা হয়, এবং দাসত্ব থেকে মুক্তি পাওয়া ব্যক্তিদের জন্য নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়।

তবে যুদ্ধের ক্ষত মুছে যাওয়া সহজ ছিল না। দক্ষিণাঞ্চল পুনর্গঠনের সময় অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হয়েছিল, এবং দাসপ্রথার বিলোপের পরও বর্ণবৈষম্য ও সামাজিক অসাম্য থেকে যায়।

গৃহযুদ্ধের অভিজ্ঞতা আমেরিকার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি একটি জাতিকে শিখিয়েছে যে বিভেদ এবং মতভেদকে দূর করতে একতাই মূলমন্ত্র। আজকের আমেরিকা ৫০টি রাজ্য নিয়ে একটি শক্তিশালী জাতি, যার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে গৃহযুদ্ধের সময় অর্জিত ঐক্যের মাধ্যমে।

গৃহযুদ্ধের ঐতিহাসিক ঘটনাগুলি আজও আমেরিকার সামাজিক, রাজনৈতিক, এবং সাংস্কৃতিক জীবনে প্রভাব ফেলছে। আব্রাহাম লিঙ্কনের নেতৃত্বে দাসপ্রথার বিলোপ এবং জাতীয় ঐক্যের জন্য সংগ্রাম আজও বিশ্বের জন্য একটি দৃষ্টান্ত।

মার্কিন গৃহযুদ্ধ কেবল একটি জাতির অভ্যন্তরীণ সংঘাত ছিল না; এটি ছিল একটি নতুন দিশা খুঁজে পাওয়ার সংগ্রাম। দাসপ্রথার অবসান এবং জাতীয় ঐক্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠা আমেরিকাকে একটি শক্তিশালী জাতি হিসেবে গড়ে তুলেছে। গৃহযুদ্ধ আমাদের শেখায় যে, মতভেদ থাকলেও একতাই একটি জাতির প্রকৃত শক্তি। আমেরিকার গৃহযুদ্ধ ছিল একদিকে বিভেদের চরম উদাহরণ, অন্যদিকে পুনর্জন্মের সূচনা। দাসপ্রথার অবসান এবং জাতীয় ঐক্যের প্রতিষ্ঠা আমেরিকার উন্নয়নের পথ খুলে দিয়েছিল। আজকের আধুনিক আমেরিকার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে এই রক্তক্ষয়ী অধ্যায়ের উপর। গৃহযুদ্ধ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে মতপার্থক্য যত বড়ই হোক, ঐক্যের শক্তি সবসময়ই প্রবল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *