বলিউডের ইতিহাসে এমন অনেক তারকা রয়েছেন, যাঁদের ব্যক্তিগত জীবন তাঁদের পেশাদার সাফল্যের মতোই আলোচিত। কিন্তু এই তালিকায় অভিনেত্রী রেখার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁর সৌন্দর্য, অভিনয় দক্ষতা, এবং রহস্যে ঘেরা ব্যক্তিগত জীবন তাঁকে এক অনন্য অবস্থানে নিয়ে গিয়েছে। বিশেষ করে তাঁর সিঁথির সিঁদুরের প্রসঙ্গ আজও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। রেখার স্বামী মুকেশ আগরওয়ালের মৃত্যুর এত বছর পরেও কেন তাঁর সিঁথিতে সিঁদুর দেখা যায়, তা নিয়ে বলিউডে গুঞ্জনের শেষ নেই।
১৯৫৪ সালের ১০ অক্টোবর চেন্নাইয়ে জন্মগ্রহণ করেন রেখা। তাঁর আসল নাম ভানুরেখা গণেশন। তাঁর পিতা ছিলেন বিখ্যাত তামিল অভিনেতা জেমিনি গণেশন এবং মাতা পুষ্পবল্লী, যিনি নিজেও একজন জনপ্রিয় তেলুগু অভিনেত্রী ছিলেন। যদিও রেখার বাবা-মা কখনও বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হননি, তাঁর মা-ই ছিলেন তাঁর প্রধান অভিভাবক। রেখা তাঁর পিতার কাছ থেকে খুব বেশি স্নেহ বা সময় পাননি, কারণ জেমিনি গণেশন কখনও তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে মেয়ে হিসেবে স্বীকৃতি দেননি।
রেখার শৈশব কাটে এক দুঃসহ সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে। পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুব ভালো ছিল না, যার ফলে তাঁকে খুব অল্প বয়সেই কাজ শুরু করতে হয়। পড়াশোনায় মন না বসার কারণে তিনি স্কুল ছেড়ে দেন এবং অভিনয়ে মনোনিবেশ করেন। মাত্র ১২ বছর বয়সে তামিল ছবি “রঙ্গুলা রত্নম”-এ শিশুশিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯৬৯ সালে তিনি কন্নড় ছবি “গোডিয়ালি”-তে প্রথম নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেন।
১৯৭০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত হিন্দি চলচ্চিত্র “সাওয়ান ভাদো” ছিল রেখার বলিউডে অভিষেক। এটি তাঁকে রাতারাতি জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে দেয়। তবে এই সময়ে তাঁকে চেহারা এবং ত্বকের রঙ নিয়ে কটাক্ষ সহ্য করতে হয়েছিল। সেই কঠোর সমালোচনার মধ্য দিয়েও তিনি তাঁর অভিনয় প্রতিভা ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে বলিউডে শক্ত অবস্থান তৈরি করেন।
রেখার জীবনে প্রেম ও বিয়ের গল্পগুলো বলিউডের ইতিহাসে বিশেষ জায়গা দখল করে আছে। তাঁর জীবনের প্রথম উল্লেখযোগ্য সম্পর্কের সূত্রপাত ঘটে ১৯৭০-এর দশকে। অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল সবচেয়ে আলোচিত। “মুকাদ্দর কা সিকন্দর,” “সিলসিলা,” এবং আরও অনেক ছবিতে তাঁদের একসঙ্গে দেখা গেছে। এই সম্পর্কটি এতটাই গভীর ছিল যে বলিউড এবং দর্শক মহলে তাঁদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ব্যাপক গুঞ্জন শুরু হয়। যদিও অমিতাভ তখন জয়া ভাদুড়িকে বিয়ে করেছিলেন, রেখার সঙ্গে তাঁর রসায়ন পর্দার বাইরেও মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল।
রেখা এবং অমিতাভের সম্পর্কের জল্পনার অন্যতম কারণ ছিল তাঁদের একসঙ্গে সময় কাটানো এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁদের উপস্থিতি। “সিলসিলা” ছবিতে তাঁদের বাস্তব জীবনের সম্পর্ক প্রতিফলিত হয়েছে বলেই মনে করা হয়। কিন্তু তাঁদের সম্পর্ক কখনও আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায়নি। অমিতাভ এবং জয়ার সম্পর্ক স্থিতিশীল রাখতে জয়া বচ্চনের কঠোর অবস্থান এবং বলিউডের চাপ এই সম্পর্কের শেষ করে দেয় বলে মনে করা হয়।

এরপর রেখার জীবনে আরও কিছু প্রেমের গুঞ্জন শোনা যায়। বিনোদ মেহেরার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিয়েও ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। এমনকি বিনোদ মেহেরাকে নিয়ে রেখার গোপনে বিয়ের কথাও প্রচারিত হয়েছিল। যদিও রেখা এই বিয়ের কথা অস্বীকার করেছেন, বিনোদ মেহেরার মা তাঁকে মেনে নিতে চাননি বলে কিছু রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। বিয়ের খবর নিয়ে বিতর্ক থাকলেও তাঁদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা কেউই অস্বীকার করতে পারেনি।
১৯৯০ সালে রেখা ব্যবসায়ী মুকেশ আগরওয়ালকে বিয়ে করেন। তাঁদের বিয়ে সাধারণ মানুষের চোখে একটি চমক ছিল। বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই মুকেশের মানসিক অবস্থা নিয়ে সমস্যা শুরু হয়। মানসিক অবসাদ এবং দাম্পত্য জীবনের অশান্তি মুকেশকে বিপর্যস্ত করে তোলে। ১৯৯১ সালে তিনি আত্মহত্যা করেন। তাঁর মৃত্যুর জন্য রেখাকে দায়ী করা হয়, এবং তিনি বলিউডে একঘরে হয়ে যান। কিন্তু রেখা কখনও এই দুঃখজনক ঘটনার জন্য দোষ স্বীকার করেননি।
মুকেশ আগরওয়ালের মৃত্যুর পরও রেখার সিঁথিতে সিঁদুর দেখা যায়, যা বলিউডে চিরকালীন রহস্যের জন্ম দিয়েছে। এই সিঁদুর নিয়ে বারবার প্রশ্ন উঠেছে—কার নামে সিঁদুর পরেন রেখা? বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, সিঁদুর তাঁর ফ্যাশনের অংশ, এটি তাঁর ব্যক্তিগত পছন্দ। তবে এই ব্যাখ্যা অনেকেই মেনে নেননি।
১৯৮০-এর দশকের শেষের দিকে রেখার এক মেকআপ আর্টিস্ট জানিয়েছিলেন যে রেখা তাঁর ফ্যাশন সেন্সের জন্যই সিঁদুর পরেন, কারণ এটি তাঁকে ভালো মানায়। অন্যদিকে, অভিনেতা পুনিত ইসারের স্ত্রী দীপালি ইসার দাবি করেছিলেন যে রেখা আসলে অমিতাভ বচ্চনের নামে সিঁদুর পরেন। দীপালি আরও বলেন, রেখা এবং অমিতাভের সম্পর্কের গুঞ্জন বলিউডে সকলেরই জানা। যদিও তাঁদের বিয়ে বা আনুষ্ঠানিক সম্পর্কের কোনও প্রমাণ কখনও মেলেনি।
রেখার সিঁথিতে সিঁদুর নিয়ে প্রথম বড় বিতর্ক শুরু হয়েছিল নিতু সিং এবং ঋষি কাপুরের বিয়েতে। বলিউডের নামী তারকা ও বিশিষ্টজনদের উপস্থিতিতে এই বিয়ে ছিল এক উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠান। কিন্তু সেই অনুষ্ঠানের অন্যতম চাঞ্চল্যকর ঘটনা ছিল রেখার আকস্মিক আগমন।
রেখা ওই বিয়েতে একমাথা সিঁদুর এবং মঙ্গলসূত্র পরে উপস্থিত হন। তাঁর এমন উপস্থিতি দেখে অতিথিরা হতবাক হয়ে যান। এই সাজে তাঁকে দেখে অনেকে ধারণা করেন যে তিনি গোপনে বিয়ে করেছেন। যেহেতু তখন অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের গুঞ্জন তুঙ্গে ছিল, তাই তাঁর এই সাজকে ঘিরে জল্পনা আরও বেড়ে যায়।
গণমাধ্যম এবং বলিউড মহলে ব্যাপক আলোচনার ঝড় ওঠে। রেখা অবশ্য দাবি করেন যে তিনি সরাসরি একটি শুটিং ফ্লোর থেকে এসেছিলেন, এবং মেকআপ তোলার সময় পাননি। যদিও তাঁর এই ব্যাখ্যা অনেকেই বিশ্বাস করেননি, কারণ সেই সময়ে বলিউডে তাঁর এবং অমিতাভের সম্পর্ক নিয়ে গুঞ্জন ছিল অত্যন্ত প্রবল।
অনেকেই মনে করেন, রেখার এই ঘটনাটি একটি সাহসী পদক্ষেপ ছিল, যা অমিতাভ এবং তাঁর সম্পর্কের কথা প্রকাশ্যে নিয়ে আসে। যদিও তাঁদের সম্পর্ক কখনও আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায়নি, এই বিতর্ক বলিউডের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।
বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে রেখা সিঁদুর প্রসঙ্গে নানা ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি একবার বলেছিলেন, “সিঁদুর একটি সাজের অংশ। এটি আমার ফ্যাশনের অংশ, এবং আমি এতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি।” তিনি আরও উল্লেখ করেন, তাঁর জন্মস্থান দক্ষিণ ভারতে সিঁদুরকে শোভা বা সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। তবে এই মন্তব্যগুলি বিতর্ক থামাতে পারেনি।
রেখার মতে, সিঁদুর শুধুমাত্র বৈবাহিক অবস্থানের প্রতীক নয় বরং এটি একটি সাংস্কৃতিক ও নান্দনিক উপাদান, যা তাঁকে স্বতন্ত্রতা দেয়। তাঁর এই মতামত ব্যক্তিগত পছন্দের স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে অনেকে গ্রহণ করলেও বলিউডের গুঞ্জন তা নীরব করতে পারেনি। অনেক সমালোচক রেখার এই ব্যাখ্যাকে তাঁর জীবনের গোপন অধ্যায় আড়াল করার একটি উপায় হিসেবেও দেখে থাকেন।
৬৯ বছর বয়সেও রেখা আগের মতোই মোহময়ী এবং আত্মবিশ্বাসী। আজও তিনি বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসব ও পার্টিতে তাঁর অনন্য স্টাইল স্টেটমেন্ট নিয়ে হাজির হন। সোনালি শাড়ি, গা-ভর্তি গয়না, এবং উজ্জ্বল সিঁদুরে সজ্জিত হয়ে তিনি যেখানেই যান, সেখানেই চমক সৃষ্টি করেন। তিনি নিজেকে অভিনয় থেকে দূরে রাখলেও বলিউডের বড় অনুষ্ঠানে তাঁর উপস্থিতি বরাবরই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে।
নিজের পোষা প্রাণী, বাগান, এবং আধ্যাত্মিক জীবনে সময় কাটানোই এখন তাঁর প্রধান সুখ। রেখার জীবন এখন নিরিবিলি হলেও তাঁর ব্যক্তিত্ব আজও বলিউডের কিংবদন্তি অভিনেত্রীদের মধ্যে অন্যতম বলে বিবেচিত। নিজের সম্পর্কে বিতর্ক এড়িয়ে গিয়ে তিনি বরং আত্মবিশ্বাসী এবং অনুপ্রেরণামূলক একজন নারী হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেছেন।
রেখার সিঁথির সিঁদুর নিয়ে যতই বিতর্ক থাকুক না কেন, এটি তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের অংশ। এটি প্রেম, বিশ্বাস, এবং সৌন্দর্যের প্রতীক হতে পারে, অথবা শুধুই একটি ফ্যাশনের অংশ। তবে একথা অস্বীকার করা যায় না যে রেখার সিঁদুর পরা নিয়ে রহস্য এবং আকর্ষণ আগামী দিনেও তাঁর ভক্তদের মনে প্রশ্ন তুলতে থাকবে। রেখার জীবনের এই অধ্যায় বলিউডের ইতিহাসে চিরকালীন আলোচনার বিষয় হিসেবে থেকে যাবে। তাঁর জীবন থেকে শিক্ষা নেওয়ার মতো অনেক কিছু আছে—সংগ্রাম, অধ্যবসায়, এবং আত্মবিশ্বাসের মাধ্যমে নিজেকে স্থাপন করা। রেখা একজন নারীর প্রতীক, যিনি নিজের শর্তে জীবনযাপন করেন এবং সমাজের নিয়ম মেনে চলার পরিবর্তে নিজের পথ তৈরি করেন।