ভারতের তরুণ ক্রিকেটার রিঙ্কু সিং এখন প্রচুর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন। তিনি যখনই মাঠে নামেন, তাঁর ব্যাট কথা বলে, আর সেই কারণেই দেশের কোটি কোটি ক্রিকেটপ্রেমীর মন জয় করেছেন। তবে এবার তিনি ক্রিকেটের জন্য নয়, বরং ব্যক্তিগত জীবনের একটি সিদ্ধান্তের কারণে আলোচনায় রয়েছেন। সম্প্রতি তিনি উত্তরপ্রদেশের আলিগড়ে একটি বিলাসবহুল বাংলো কিনেছেন, যার দাম ৩.৫ কোটি টাকা। এটি অত্যন্ত আধুনিক এবং সুসজ্জিত একটি বাড়ি, যা তাঁর সাফল্যের প্রতীক হিসেবে ধরা হচ্ছে।
কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো, এত দামী ও সুন্দর বাংলো থাকার পরও তাঁর বাবা-মা সেখানে থাকতে চান না। তাঁদের এই সিদ্ধান্ত জানার পর অনেকেই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছেন। কারণ এর পেছনে লুকিয়ে আছে এক গভীর অনুভূতি, সংগ্রামের এক দীর্ঘ ইতিহাস, যা রিঙ্কু সিং ও তাঁর পরিবারের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে।
আজ যে রিঙ্কু সিং ভারতীয় দলের একজন প্রতিভাবান ক্রিকেটার, তিনি কিন্তু খুব সহজে এই জায়গায় পৌঁছাননি। ছোটবেলা থেকেই তাঁর জীবন ছিল দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করার গল্প। তাঁর বাবা খানচন্দর সিং পেশায় একজন গ্যাস সিলিন্ডার ডেলিভারি ম্যান ছিলেন। প্রতিদিন ঘরে ঘরে গ্যাস সিলিন্ডার পৌঁছে দিতেন এবং সামান্য আয় দিয়ে সংসার চালাতেন।
রিঙ্কুর পরিবারে পাঁচ ভাইবোন। এতজনের দায়িত্ব সামলানো একজন গ্যাস ডেলিভারির কর্মীর পক্ষে সহজ ছিল না। সংসারে যখন অভাব ছিল, তখন রিঙ্কুর মা বাড়ির খরচ চালানোর জন্য অন্যের বাড়িতে কাজ করতেন। অনেক সময় তাদের বাড়িতে খাবার জোটাত না। কিন্তু এই দারিদ্র্য রিঙ্কুর স্বপ্নকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। তিনি জানতেন, যদি কিছু করতে হয়, তাহলে ক্রিকেটই তাঁর একমাত্র পথ।
রিঙ্কু যখন ছোট ছিলেন, তখন থেকেই তাঁর ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ ছিল। কিন্তু সমস্যা ছিল অর্থের। ব্যাট-বল কেনার মতো সামর্থ্য ছিল না পরিবারের। এমনকি প্র্যাকটিস করার জন্য ভালো মাঠ বা কোচিংয়ের সুযোগও ছিল না।
কিন্তু এই কঠিন সময়েও তাঁর পরিবার তাঁকে নিরুৎসাহিত করেনি। বরং বাবা-মা যতটুকু পেরেছেন, ততটুকু সাহায্য করেছেন। এক সময় তাঁর বড় ভাই একটি চাকরি করতেন এবং সেখান থেকে কিছু টাকা এনে রিঙ্কুর খেলার জন্য ব্যয় করতেন। এভাবেই ধীরে ধীরে রিঙ্কু তাঁর ক্রিকেট জীবনের পথে এগিয়ে যেতে থাকেন।
কিন্তু সহজ ছিল না সেই পথ। অনেক সময় অর্থের অভাবে তাঁকে খালি পেটে অনুশীলন করতে হয়েছে। অনেকে তাঁকে বলত যে ক্রিকেট ছেড়ে কোনো ছোটখাটো কাজ করুক, যাতে সংসারের সাহায্য হয়। কিন্তু রিঙ্কু দমে যাননি। তিনি জানতেন, একদিন তিনি সফল হবেন এবং তাঁর পরিবারকে দারিদ্র্য থেকে মুক্ত করবেন।
রিঙ্কুর জীবনে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আসে যখন তিনি আইপিএলে সুযোগ পান। ২০১৭ সালে পাঞ্জাব কিংস তাঁকে প্রথমবারের মতো দলে নেয়, কিন্তু সেই মৌসুমে খুব বেশি খেলার সুযোগ পাননি। পরে কলকাতা নাইট রাইডার্স (KKR) তাঁকে দলে নেয় এবং সেখান থেকেই তাঁর ক্রিকেট ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরে যায়।
২০২৩ সালের আইপিএলে গুজরাট টাইটান্সের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক ম্যাচে শেষ ওভারে পাঁচটি ছক্কা মেরে দলকে জিতিয়ে দেন রিঙ্কু। এই এক ম্যাচেই তিনি গোটা বিশ্বের নজর কাড়েন। সবাই বুঝতে পারেন, এই ছেলেটি বিশেষ কিছু। তাঁর নাম রাতারাতি ছড়িয়ে পড়ে।
এরপর তিনি ভারতীয় জাতীয় দলে সুযোগ পান এবং এখন তিনি ভারতের অন্যতম প্রতিভাবান ক্রিকেটার হিসেবে পরিচিত।
এত বছরের পরিশ্রমের ফলস্বরূপ আজ রিঙ্কু সিং একজন প্রতিষ্ঠিত ক্রিকেটার। তাঁর হাতে এখন অনেক বড় বড় স্পনসরশিপ ডিল রয়েছে, তিনি আইপিএলে ভালো পারিশ্রমিক পান এবং এখন ভারতের হয়ে খেলছেন। ফলে অর্থের অভাব তাঁর জীবনে আর নেই।
এই সাফল্যের স্মারক হিসেবে তিনি আলিগড়ে একটি অত্যাধুনিক বিলাসবহুল বাংলো কিনেছেন, যার দাম ৩.৫ কোটি টাকা। এটি একটি বিশাল বাড়ি, যেখানে অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, এত সুন্দর ও দামী বাড়ি থাকার পরেও তাঁর বাবা-মা এখানে থাকতে চান না।
রিঙ্কুর বাবা-মা নতুন বাংলোতে যেতে চান না, কারণ তাঁদের বর্তমান বাড়িটির সঙ্গে অনেক আবেগ জড়িয়ে রয়েছে। যে বাড়ির উঠোনে রিঙ্কু বড় হয়েছেন, যে বাড়িতে তিনি দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করেছেন, যে ঘরে বসে তাঁর মা তাঁকে আশীর্বাদ করেছেন, সেই বাড়ি তাঁরা ছেড়ে যেতে চান না।
তাঁরা মনে করেন, নতুন বাংলোতে গেলে তাঁদের পুরোনো স্মৃতিগুলো মুছে যাবে। তাঁদের সংগ্রামের দিনগুলো ভুলে যেতে হবে। তাঁরা চান না যে তাঁদের কষ্টের দিনগুলোর স্মৃতি মুছে যাক, কারণ সেটাই তাঁদের জীবনের একটা বড় শিক্ষা।

রিঙ্কুর বাবা বলেন, “আমাদের জীবনটা এই পুরোনো বাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে আছে। এখানে আমরা অনেক কষ্ট করেছি, অনেক স্বপ্ন দেখেছি, অনেক কিছু হারিয়েছি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাদের ছেলে আমাদের গর্বিত করেছে। এই বাড়িটাই আমাদের সত্যিকারের ঠিকানা।”
রিঙ্কুর মা বলেন, “এই বাড়ির প্রতিটি কোণায় আমাদের জীবনের গল্প লেখা আছে। এখানে আমাদের ছেলে বড় হয়েছে, এখানে সে স্বপ্ন দেখেছে, এখানে সে সংগ্রাম করেছে। আমরা এই বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাব না।”
রিঙ্কু সিং তাঁর বাবা-মায়ের সিদ্ধান্তকে পুরোপুরি সম্মান করেন। তিনি বলেন, “আমি চাই আমার বাবা-মা সুখে থাকুন। আমি বড় বাংলো কিনেছি, কিন্তু সেটাতে থাকতেই হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। যদি তাঁরা তাঁদের পুরোনো বাড়িতেই খুশি থাকেন, তাহলে সেটাই আমার জন্য সেরা সিদ্ধান্ত।”
তিনি আরও বলেন, “আমি যখনই বাড়ি যাই, আমি আমার পুরোনো বাড়িতেই থাকি। কারণ এই বাড়ির সঙ্গে আমার অনেক আবেগ জড়িত। আমি এখানে থেকেই বড় হয়েছি, এখান থেকেই স্বপ্ন দেখেছি। আমি কখনোই আমার শিকড়কে ভুলতে পারব না।”
রিঙ্কু সিংয়ের বাবা-মায়ের এই সিদ্ধান্ত অনেককেই ভাবিয়ে তুলেছে। সাধারণত মানুষ যখন বড় হয়, সফল হয়, তখন পুরোনো জিনিসগুলো ভুলে যায়। কিন্তু রিঙ্কুর বাবা-মা এই চিরসত্য কথাটি মনে করিয়ে দিয়েছেন— “মানুষ যত বড়ই হোক, নিজের শিকড় কখনো ভুলতে নেই।”
তাঁদের এই আবেগপ্রবণ সিদ্ধান্ত আমাদের শেখায় যে, জীবনের আসল মূল্য শুধুমাত্র অর্থ বা বিলাসবহুল বাড়িতে নয়, বরং সেই স্মৃতিগুলোতে লুকিয়ে থাকে, যা আমাদের গড়ে তোলে।
রিঙ্কু সিংয়ের গল্প শুধু একজন ক্রিকেটারের সাফল্যের গল্প নয়, এটি এক সংগ্রামী পরিবারের আত্মত্যাগ, ভালোবাসা ও আত্মসম্মানের গল্প। এই গল্প শুধু ভারত নয়, সারা বিশ্বের মানুষের জন্য এক অনুপ্রেরণা।