‘কোহলি’রা কী ভারতীয় নাকি পাকিস্তানি? কী বলছে ইতিহাস

Spread the love

বিরাট কোহলির টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসর গোটা ক্রিকেট বিশ্বেই এক যুগের অবসানের বার্তা হয়ে এসেছে। তাঁর ব্যাটিং কৌশল, আগ্রাসী মনোভাব, এবং ভারতের জার্সিতে তাঁর অতুলনীয় আবেগ তাঁকে শুধু ভারতেই নয়, উপমহাদেশ ও বিশ্বের নানা প্রান্তে জনপ্রিয় করে তুলেছে। কিন্তু এই ‘কোহলি’ নামটি কেবল ক্রিকেট মাঠেই নয়, ইতিহাস, ধর্ম এবং উপমহাদেশের বিভক্তির সাথেও অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। বিরাট কোহলি কে শুধু একজন ক্রিকেটার হিসেবে দেখলে ভুল হবে; তাঁর নাম, তাঁর পরিচয় এবং তাঁর পেছনের পরিবারিক ইতিহাস আমাদের নিয়ে যায় ভারতের পাঞ্জাব থেকে পাকিস্তানের গুজরানওয়ালা পর্যন্ত।

কোহলি নামের উৎস কী?

‘কোহলি’ নামটি অনেকেই হয়তো শুধুই একটি পদবী হিসেবে চিনে থাকেন। কিন্তু এই পদবীর পেছনে রয়েছে শতাব্দীপ্রাচীন সামাজিক ও ধর্মীয় ভেদবিভাজনের চিহ্ন। ‘কোহলি’ পদবী সাধারণত উত্তর ভারতের পাঞ্জাব অঞ্চলে পাওয়া যায়। এই নামটির মূল উৎস ধরা হয় হিন্দু ক্ষত্রিয় বা বাণীয়া শ্রেণি থেকে, যারা মূলত যোদ্ধা বা প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত ছিল। পরবর্তীতে অনেক কোহলি পরিবার ধর্মান্তরিত হয়ে শিখ ধর্মের অন্তর্গত হয় এবং শিখ সমাজে গুরু সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুক্ত হয়।

কোহলিদের ঐতিহাসিক উৎপত্তিস্থল হিসেবে ধরা হয় পাঞ্জাবের পশ্চিমাঞ্চল, অর্থাৎ বর্তমানে যেটি পাকিস্তানের অন্তর্গত। লাহোর, গুজরানওয়ালা, সিয়ালকোট, ও করাচির মতো শহরে একসময় বহু কোহলি পরিবার বাস করত। এই পরিবারগুলির অনেকে পরবর্তীতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে পাকিস্তানে থেকে যায়, আবার অনেকে দেশভাগের সময় ভারতে চলে আসে এবং দিল্লি, হরিয়ানা, জম্মু ও হিমাচল প্রদেশে স্থায়ী বসতি স্থাপন করে।

১৯৪৭ সালের দেশভাগ উপমহাদেশের বহু জনগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের জীবনে এক স্থায়ী ছাপ রেখে গেছে। কোহলি পরিবারও সেই অভিঘাতের শিকার হয়। পশ্চিম পাঞ্জাবের অনেক হিন্দু ও শিখ কোহলি পরিবার দেশভাগের সময় পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে চলে আসে, আবার অনেক মুসলিম কোহলি পরিবার পাকিস্তানে থেকে যায়।

এইভাবে কোহলি নামটি ভারত ও পাকিস্তান—উভয় দেশেই আলাদা ধর্মীয় পরিচয়ে বিদ্যমান রয়েছে। ভারতের কোহলিরা বেশিরভাগই হিন্দু বা শিখ, অপরদিকে পাকিস্তানের কোহলিরা সাধারণত মুসলিম। অথচ ইতিহাসের গোড়ায় তাঁরা এক সূত্রে বাঁধা ছিল।

বিরাট কোহলি: ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার!

বিরাট কোহলি জন্মেছেন ১৯৮৮ সালে, দিল্লিতে। তাঁর পরিবার দেশভাগের পর পাকিস্তান থেকে ভারতে চলে এসেছিল, যদিও তাঁদের সুনির্দিষ্ট পূর্বপুরুষ কোথা থেকে এসেছিলেন, সে নিয়ে কোনও সরকারি নথি নেই। তবে ইতিহাস ও সামাজিক পরম্পরার ভিত্তিতে ধরে নেওয়া হয় কোহলির পূর্বপুরুষরা পাঞ্জাবের গুজরানওয়ালা অঞ্চলের বাসিন্দা ছিলেন, যেটি বর্তমানে পাকিস্তানে অবস্থিত।

এই গুজরানওয়ালায়ই জন্মেছিলেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর পরিবারের পূর্বপুরুষরাও। কোহলি পরিবারের সেই একই অঞ্চলের ইতিহাস ও সংস্কৃতির ধারক হওয়াটা এক নতুন মাত্রা যোগ করে বিরাট কোহলির পরিচয়ে।

কোহলি পদবীর সম্প্রসারণ কীভাবে?

কোহলি পদবীটি মূলত পাঞ্জাবি জাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও, ধর্ম পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই পদবী ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি ও দেশে ছড়িয়ে পড়ে। একদিকে ভারতের পাঞ্জাব, দিল্লি, হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশে হিন্দু ও শিখ কোহলিদের বাস; অন্যদিকে পাকিস্তানের পাঞ্জাব, সিন্ধ, ও করাচি অঞ্চলে মুসলিম কোহলিরা বর্তমান। তাঁদের পেশা, ভাষা, জীবনযাপন একে অপরের থেকে আলাদা হয়ে গেলেও, পদবীর উৎস ও পূর্বপুরুষের শিকড় আজও একই।

এই বিভাজনের মধ্যেও আশ্চর্য বিষয় হলো—উভয় দেশের কোহলি পরিবারগুলোর মধ্যে এখনও কিছু কিছু সাংস্কৃতিক মিল রয়ে গেছে। যেমন পারিবারিক রীতিনীতি, কিছু উৎসব পালন এবং খাদ্যাভ্যাসে পাঞ্জাবি সংস্কৃতির ছোঁয়া। এ যেন রাজনৈতিক সীমারেখা তাদের আলাদা করলেও, ঐতিহ্যের রক্তসূত্র এখনও বহমান।

ধর্মান্তরণ ও ইতিহাসের মোড়!

কোহলি সম্প্রদায়ের একটি অংশ যে শিখ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, সে ইতিহাস অনেকাংশেই ধরা পড়ে গুরু গ্রন্থ সাহেব ও শিখ ইতিহাসে। আবার ব্রিটিশ আমলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারী কোহলিদের সংখ্যাও কম ছিল না। এঁরা ব্রিটিশদের প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক কার্যকলাপে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। ফলে ব্রিটিশ আমলে পাঞ্জাবি কোহলি পরিবারদের মধ্যে প্রশাসনিক প্রভাব দেখা গিয়েছিল।

এই ধর্মান্তরকরণ শুধুমাত্র ধর্মীয় বিশ্বাসের পরিবর্তন নয়, বরং অনেক সময় এটি রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কারণেও ঘটত। মুসলিম কোহলিরা পাকিস্তানে তাঁদের নিজস্ব একটি পরিচয় তৈরি করলেও, তাঁদের পদবী সেই ঐতিহাসিক বন্ধনকে মনে করিয়ে দেয় যেটি ভারতের বর্তমান কোহলি পরিবারের সঙ্গে যুক্ত।

‘ভারতীয় না পাকিস্তানি’—আসলে উত্তর নেই সহজভাবে!

বিরাট কোহলির নাম ঘিরে অনেকেই প্রশ্ন তোলেন, “ওঁরা কি আদতে পাকিস্তানি ছিলেন?” উত্তর এককথায় দেওয়া কঠিন। তাঁর পরিবার বর্তমান পাকিস্তানে বসবাস করলেও, তা ছিল ১৯৪৭-এর আগের কথা। সে সময় ভারত-পাকিস্তান আলাদা রাষ্ট্র ছিল না। ফলে বিরাট কোহলির পূর্বপুরুষদের সেই সময়ের গুজরানওয়ালা এখন পাকিস্তানে হলেও, তাঁদের পরিচয় ছিল ব্রিটিশ ভারতের পাঞ্জাবি হিন্দু।

অতএব, বিরাট কোহলি পাকিস্তানি ছিলেন না—এই কথাটি যেমন সত্য, তেমনি এই দাবিও অস্বীকার করা যায় না যে তাঁর পারিবারিক শিকড় সেই ভৌগোলিক অঞ্চলে যা এখন পাকিস্তানের অন্তর্গত।

কোহলি নামটি কেবল একটি পদবী নয়, এটি ইতিহাস, ধর্ম, সংস্কৃতি, এবং রাজনীতির এক সুগভীর ছাপ বহন করে। বিরাট কোহলির পরিবার হোক কিংবা পাকিস্তানের কোনও মুসলিম কোহলি পরিবার, তাঁদের পূর্বপুরুষেরা এককালে একই ঐতিহ্যের অংশ ছিলেন। উপমহাদেশের বিভক্ত রাজনীতি তাঁদের আলাদা করলেও, ইতিহাস তাঁদের একসূত্রে গেঁথে রেখেছে।

ক্রিকেট মাঠে বিরাট কোহলি যখন ব্যাট হাতে নামেন, তখন তাঁর পরিচয় শুধুমাত্র একজন ভারতীয় ক্রিকেটার হিসেবেই নয়—তিনি পাঞ্জাবি ইতিহাস, উপমহাদেশীয় ঐতিহ্য এবং ধর্মীয় বহুত্ববাদের এক প্রতীক। তাঁর নাম ‘কোহলি’ সেই প্রাচীন শিকড়ের পরিচায়ক, যেখানে ভারত-পাকিস্তান বিভাজনের আগের এক যুগের ছায়া এখনো প্রতিফলিত হয়।

এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে বলা যায়—কোহলি নামটি কোনও নির্দিষ্ট দেশের নয়, এটি উপমহাদেশের এক যুগান্তকারী ইতিহাসের কথা বলে, যা আজও জাতি, ধর্ম, সীমান্তের ঊর্ধ্বে এক প্রাচীন সম্পর্ককে বহন করে চলে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *