দেব ও ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান!

Spread the love

দেব ও ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান! : পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত ঘাটাল এলাকা বহু বছর ধরেই বর্ষাকালে ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে। প্রতি বছরই সেখানে মানুষের ঘরবাড়ি ভেসে যায়, কৃষিজমি নষ্ট হয় এবং জনজীবন স্তব্ধ হয়ে পড়ে। এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান হিসাবে বহু বছর আগে প্রস্তাব করা হয়েছিল “ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান”। কিন্তু এই প্রকল্পের কাজ বাস্তবে শুরু হয়নি বহুদিন ধরে। আর এই বিলম্ব ঘিরেই রাজনৈতিক বিতর্ক ও প্রচারপ্রচারণা জোরদার হয়েছে বিশেষ করে ঘাটালের সাংসদ দেব (দীপক অধিকারী)–কে ঘিরে।

ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান কী?

ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান পশ্চিমবঙ্গের একাধিক নদীবাহিত অঞ্চলের বন্যা সমস্যা থেকে স্থায়ী মুক্তি দিতে কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদিত একটি বৃহৎ প্রকল্প। ১৯৭৭ সালে এর প্রাথমিক রূপরেখা তৈরি হয়। মূলত শীলাবতী, শীলাই ও কানসাবতী নদীর জলের গতি নিয়ন্ত্রণ, বাঁধ নির্মাণ, চ্যানেল খনন, ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নয়ন ইত্যাদি এই প্রকল্পের মূল কাজ। এর ফলে ঘাটাল, দাসপুর, চন্দ্রকোনা, কেশপুর, কাঁথি প্রভৃতি অঞ্চলের মানুষের বহুদিনের দুর্ভোগ লাঘব হবে বলে মনে করা হয়।

দেব ও তাঁর প্রতিশ্রুতি

২০১৪ সালে দেব প্রথমবার ঘাটাল থেকে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী হয়ে সংসদে নির্বাচিত হন। তার পর থেকে তিনি বারংবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছেন যে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান তিনি বাস্তবায়ন করাবেন। জনসভা, ভিডিও বার্তা, সংসদের প্রশ্নোত্তর পর্বে এমনকি সোশ্যাল মিডিয়াতেও তিনি বহুবার দাবি করেছেন যে এই প্রকল্প তাঁর “মিশন”। ২০১৯ সালে পুনরায় নির্বাচিত হওয়ার পরও তিনি বলেন, কেন্দ্র যদি অনুমোদন দেয় তবে রাজ্য সরকারও এই প্রকল্পের জন্য প্রস্তুত।

প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক জট

তবে বাস্তব চিত্রটি অনেকটাই জটিল। কেন্দ্রীয় সরকার, যা এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য অর্থ বরাদ্দ করতে পারে, তারা দীর্ঘদিন ধরে প্রকল্পের প্রয়োগ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে আসছে। কেন্দ্রীয় জলসম্পদ মন্ত্রক থেকে জানানো হয়েছিল, রাজ্যের পক্ষে কিছু কারিগরি নথি ও পরিবেশগত ছাড়পত্র এখনও জমা দেওয়া হয়নি, তাই প্রকল্প আটকে আছে। অন্যদিকে রাজ্য সরকারের তরফে দাবি করা হয়, সমস্ত প্রয়োজনীয় নথিপত্র দেওয়া হয়েছে, বরং কেন্দ্র অযথা বিলম্ব করছে।

এই টানাপড়েনের মাঝে দেব মাঝেমাঝেই হতাশা প্রকাশ করেছেন। ২০২৩ সালে একবার তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি আবেগঘন পোস্ট করেন যেখানে বলেন, “সব কাগজ পাঠিয়েছি, কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদন চাই। আমি একজন অভিনেতা, কিন্তু ঘাটালের মানুষ আমাকে বিশ্বাস করে তাদের প্রতিনিধি বানিয়েছে। আমি তাদের প্রতি দায়বদ্ধ।”

রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কটাক্ষ

বিরোধী দলগুলি, বিশেষত বিজেপি, এই ইস্যুতে দেব ও তৃণমূলকে একাধিকবার আক্রমণ করেছে। তাদের অভিযোগ, বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়েও তৃণমূল সংসদ সদস্য এই প্রকল্প বাস্তবায়নে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন। তারা এটিকে “ফটো অপ” ও “প্রতিশ্রুতির রাজনীতি” বলে কটাক্ষ করে।

বাস্তব পরিস্থিতি

ঘাটালের মানুষ এই পরিস্থিতিতে অনেকটাই হতাশ। বর্ষাকাল আসলেই তারা আতঙ্কে দিন গুনতে শুরু করেন। শিলাবতী নদীর জল বাড়লেই জল ঢুকে পড়ে ঘরবাড়িতে। অনেক এলাকায় স্কুল, হাসপাতাল ও বাজার বন্ধ হয়ে যায়। কৃষকের ফসল জলে ভেসে যায়। এই বাস্তব চিত্র ঘিরে মানুষের ক্ষোভ দিন দিন বাড়ছে।

দেবের নতুন উদ্যোগ

২০২৪ সালের পর থেকে দেব আরও বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠেন। তিনি একাধিকবার দিল্লি যান এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রকের সঙ্গে দেখা করেন। মিডিয়াতে তিনি জানান, “আমি অভিনেতা নই এখানে, আমি ঘাটালের একজন দায়বদ্ধ প্রতিনিধি। যতক্ষণ না ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়িত হচ্ছে, আমি লড়াই চালিয়ে যাব।”

তিনি এই প্রকল্পের জন্য অর্থ বরাদ্দ ও সময়সীমা নির্ধারণের দাবিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও আলোচনায় বসেন। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, প্রয়োজন হলে তারা নিজেরা কাজ শুরু করবে।

২০২৫-এ বর্তমান অবস্থা

২০২৫ সালে এই লেখা তৈরির সময়েও প্রকল্পটি পূর্ণাঙ্গভাবে শুরু হয়নি। তবে শোনা যাচ্ছে, রাজ্য সরকার “প্রাথমিক পর্যায়ের কিছু কাজ” শুরু করতে চলেছে ঘাটাল ও দাসপুর অঞ্চলে। তবে সেটা পুরো মাস্টার প্ল্যান নয়, কিছু আংশিক কাজ মাত্র।

ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান শুধুমাত্র একটি প্রকল্প নয়, এটি ঘাটালবাসীর বহু বছরের স্বপ্ন ও নিরাপত্তার প্রতীক। দেব এই স্বপ্নের মুখ হয়ে উঠেছেন, এবং তাঁর রাজনৈতিক সাফল্য ও ব্যর্থতা অনেকটাই এই প্রকল্পের বাস্তবায়নের সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে। তবে বাস্তবতা বলছে, কেন্দ্র ও রাজ্যের রাজনৈতিক সমন্বয়, আমলাতান্ত্রিক দেরি ও আন্তঃমন্ত্রণালয় দ্বন্দ্বের কারণে আজও প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি।

দেবের আন্তরিক প্রচেষ্টা কতটা বাস্তব রূপ নেবে, তা সময়ই বলবে। তবে ঘাটালের মানুষ এখন আর প্রতিশ্রুতি নয়, বাস্তব কাজ দেখতে চান। আর সেই কাজ আদৌ হবে কি না, সেটাই আগামী নির্বাচন ও ঘাটালের ভবিষ্যতের মূল প্রশ্ন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *