২০২৫ সালের মে মাস নিঃসন্দেহে ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। কারণ এই মাসেই টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসর নিলেন ভারতের দুই ক্রিকেট মহীরুহ – বিরাট কোহলি এবং রোহিত শর্মা। দীর্ঘদিন ধরে ভারতীয় ক্রিকেটের দুই মূল স্তম্ভ ছিলেন এঁরা, যাঁদের নেতৃত্ব, ব্যাটিং পারফরম্যান্স এবং চরিত্র ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসে অমোচনীয় ছাপ রেখে গেছে। কিন্তু সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় হলো, তাঁরা দু’জনেই প্রায় একসাথে টেস্ট ক্রিকেট থেকে বিদায় নিলেন। এই যুগল অবসরের পেছনে কী ছিল কারণ, কেমন ছিল তাঁদের ক্যারিয়ার, এবং কীভাবে এই সিদ্ধান্ত ভারতীয় ক্রিকেটের ভবিষ্যতে প্রভাব ফেলবে – এইসব দিক বিশ্লেষণেই গঠিত হবে এই লেখার মূল বিন্যাস।
কেন রোহিত শর্মা অবসর নিলেন?
প্রথমত, বোঝা দরকার কেন কোহলি ও রোহিত একসাথে এই সিদ্ধান্ত নিলেন। যদিও তাঁরা আলাদা আলাদা বিবৃতিতে তাঁদের অবসর ঘোষণা করেন, তবু সময়ের মিল এবং সমান্তরাল প্রেক্ষাপট ইঙ্গিত দেয় যে এই সিদ্ধান্ত ছিল গভীরভাবে ভাবনা-পরিকল্পনার ফল। দুজনেরই বয়স এখন ৩৫ পেরিয়েছে। দীর্ঘ এক দশকেরও বেশি সময় ধরে তাঁরা টেস্ট ক্রিকেটের কঠিনতম মঞ্চে নিজেদের উজাড় করে দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ধাক্কাধাক্কি, অনবরত সফর, মানসিক চাপ – সব মিলিয়ে অবসর নেওয়া ছিল একটি প্রাকৃতিক সিদ্ধান্ত।
রোহিত শর্মা ছিলেন ২০২২ সাল থেকে ভারতের টেস্ট অধিনায়ক। তাঁর অধীনে ভারত জিতেছে অসংখ্য সিরিজ, বিশেষ করে ঘরের মাঠে অপরাজেয় রেকর্ড গড়ে তোলেন তিনি। টেস্ট ফরম্যাটে রোহিত নিজেকে নতুন করে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ২০১৯-এর পর থেকে। তাঁর ব্যাটিং ছিল ধৈর্য, স্টাইল এবং আত্মবিশ্বাসের সংমিশ্রণ। ওপেনার হিসেবে শুরু করা এই ব্যাটসম্যান টেস্ট ক্রিকেটে প্রমাণ করেছেন যে, আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যানরাও ধৈর্য ধরে খেলার মাধ্যমে সাফল্য পেতে পারেন। তাঁর অবসর ঘোষণার পর ভারতীয় বোর্ড প্রাথমিকভাবে চেয়েছিল তিনি অন্তত ইংল্যান্ড সফর পর্যন্ত থাকুন, কিন্তু রোহিত জানান, পরিবার ও ব্যক্তিগত জীবনের প্রতি সময় দেওয়ার এখনই সঠিক সময়।

কেন বিরাট কোহলি অবসর নিলেন?
অন্যদিকে, বিরাট কোহলি ছিলেন ভারতীয় ক্রিকেটের আধুনিকতম সময়ের অন্যতম উজ্জ্বল তারকা। টেস্ট ক্রিকেটের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল অগাধ। এমনকি যখন বিশ্বজুড়ে টেস্ট ক্রিকেট জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে, তখন কোহলি এই ফরম্যাটকে পুনরুজ্জীবিত করতে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। তাঁর সময়ে ভারত ঘরের মাঠে একের পর এক সিরিজ জিতেছে, বিদেশের মাটিতেও গড়ে তুলেছে আক্রমণাত্মক ব্র্যান্ড অফ ক্রিকেট। অধিনায়ক হিসেবে এবং একজন ব্যাটসম্যান হিসেবে তাঁর অবদান অসামান্য। ২০১৪ থেকে ২০২২ – এই আট বছরে তিনি ছিলেন ভারতীয় ক্রিকেটের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান, যার স্ট্রোক ছিল আগ্রাসনের প্রতীক আর চোখে ছিল জয়ী হওয়ার অদম্য তৃষ্ণা।
কিন্তু ২০২৩ সালের পর থেকে বিরাট কোহলির ফর্ম কিছুটা খারাপ হতে শুরু করে, বিশেষ করে টেস্টে। তার মানসিক চাপ, পারিবারিক দায়িত্ব এবং দীর্ঘ ক্রিকেট সফরের ক্লান্তি মিলিয়ে ধীরে ধীরে তাঁর টেস্ট খেলায় মনঃসংযোগে ঘাটতি দেখা দেয়। যদিও তিনি এখনও সাদা বলের ক্রিকেটে দারুণ ফর্মে রয়েছেন, তবে লাল বলের প্রতি আগের সেই তীব্রতা হয়ত খানিকটা কমে গিয়েছিল। তাঁর অবসর ঘোষণার সময় তিনি বলেন, “I’ve given everything I had for Test cricket. Time to move on.”
এই দুই কিংবদন্তির একসাথে অবসর শুধু একটি যুগের সমাপ্তিই নয়, ভারতীয় ক্রিকেটের পুনর্গঠনেরও সূচনা। তাঁদের অবসর মানে নতুন প্রজন্মের ব্যাটসম্যানদের জন্য দরজা খুলে যাওয়া – যেমন শুভমান গিল, যশস্বী জয়সওয়াল, রুতুরাজ গায়কওয়াড় বা সরফরাজ খান। এই তরুণ ব্যাটসম্যানদের সামনে এখন বড় সুযোগ এসেছে নিজেদের প্রতিভা দিয়ে ভারতীয় টেস্ট দলে জায়গা পাকাপোক্ত করার।

তবে এটা বলাই যায়, কোহলি ও রোহিত শুধু খেলার মানুষ ছিলেন না, তাঁরা ছিলেন অনুভবের নাম। ভারতীয় ক্রিকেটের জয়পরাজয়ের সাথে দেশবাসীর আবেগ জড়িয়ে পড়েছিল এই দুজনকে ঘিরেই। তাঁদের ব্যাটিং মানেই ছিল একধরনের সৌন্দর্য, যুদ্ধ, লড়াই আর প্রেরণার মিশেল। মাঠে বিরাটের আগ্রাসন আর রোহিতের শান্ত সৌম্য আচরণ – এই দুই বিপরীত ধারা একসাথে মিশে তৈরি করেছিল এক অনন্য যুগল। তাঁদের অবসর ঘোষণার সময় সোশ্যাল মিডিয়াতে কোটি কোটি মানুষ আবেগে ভেসেছেন, কারণ এদের ব্যাটিংয়ে মানুষ নিজের জীবনের একটুকরো আশা খুঁজে পেত।
এই বিদায়ের মধ্যেও একটা আশার রেখা আছে। তাঁরা দুজনেই ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টিতে খেলবেন, অন্তত আগামী কিছু সময় পর্যন্ত। ২০২৫ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ও ২০২৬-এর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ লক্ষ্য করে ভারতীয় বোর্ড চাইছে তাঁদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে।
অর্থাৎ, রোহিত ও কোহলির একসাথে টেস্ট থেকে অবসর নেওয়া নিছক কাকতালীয় নয় – এটা ছিল সময়ের দাবি। যেভাবে তাঁদের যুগ শুরু হয়েছিল টিম ইন্ডিয়ার পুনর্গঠনের হাত ধরে, তেমনি তাঁদের বিদায়ও হচ্ছে নতুন প্রজন্মের হাত ধরে ভবিষ্যতের স্বপ্ন নির্মাণের আশায়। ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে এই দুই নাম থাকবে শ্রদ্ধায়, গৌরবে আর ভালোবাসায়। তাঁরা ছিলেন, আছেন, থাকবেন – ভারতীয় ক্রিকেটের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে।