বাঙালির রহস্যময় সাধক – বামাক্ষ্যাপা
বাংলার আধ্যাত্মিক ইতিহাসে যাঁর নাম শ্রদ্ধা ও রহস্যে মিশে আছে, তিনি হলেন সাধক বামাক্ষ্যাপা। তাঁকে অনেকে বলেন “তারাপীঠের সাধক” বা “তারকেশ্বর”। তাঁর জীবনযাত্রা, ভক্তি, ও অলৌকিক ঘটনাগুলো আজও মানুষের কৌতূহল জাগায়। লোককথা, ভক্তি, ও সাধনার এক অসামান্য সংমিশ্রণ এই মহান সাধকের জীবনকাহিনী।
শৈশবের অদ্ভুত স্বভাব
বামাক্ষ্যাপার আসল নাম ছিল বামাচরণ চট্টোপাধ্যায়। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৮৩৭ খ্রিষ্টাব্দে, বীরভূম জেলার আঘোরগ্রামে। ছোটবেলা থেকেই তাঁর মধ্যে ছিল এক অদ্ভুত মনন। পড়াশোনায় মন না দিয়ে তিনি মন্দিরে সময় কাটাতে, গান গাইতে এবং কালীঠাকুরের পূজায় অংশ নিতে ভালোবাসতেন।
গ্রামের মানুষ তখন থেকেই তাঁকে “পাগল ছেলে” বলে ডাকত। শোনা যায়, স্কুলে পড়ার সময় তিনি বইয়ের বদলে খাতায় কালীঠাকুরের ছবি আঁকতেন। এজন্য শিক্ষক প্রায়ই তাঁকে বকতেন, কিন্তু বামাচরণের চোখে তখন থেকেই ফুটে উঠত এক ভক্তিশ্রদ্ধা—যা পরবর্তীকালে তাঁকে বামাক্ষ্যাপা করে তুলেছিল।
গুরুভক্তি ও আঘোর সাধনার শুরু
তাঁর জীবনের এক বড়ো মোড় আসে যখন তিনি সাধক কালীকামিনীর সান্নিধ্যে আসেন। কালীকামিনীর আশীর্বাদেই তিনি আঘোর সাধনার পথে যাত্রা শুরু করেন।
একদিন তারাপীঠের শ্মশানে ধ্যানে বসে বামাক্ষ্যাপা অজ্ঞান হয়ে পড়েন। বহুক্ষণ পরে জ্ঞান ফিরে পেয়ে জানান—স্বয়ং মা তারা তাঁকে দর্শন দিয়েছেন। সেই অভিজ্ঞতাই তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়, এবং সেই মুহূর্ত থেকেই শুরু হয় এক অলৌকিক সাধনার অধ্যায়।
বামাক্ষ্যাপার গান ও বাউলধর্মের প্রভাব
বামাক্ষ্যাপা শুধু সাধকই নন, ছিলেন এক অনন্য কীর্তনশিল্পী ও কবিও। মন্দিরের সামনেই বসে তিনি নিজের লেখা ভক্তিগান গাইতেন। তাঁর কণ্ঠের ভক্তির শক্তিতে সাধারণ মানুষ থেকে জমিদার—সবাই মুগ্ধ হতেন।
অদ্ভুত ব্যাপার হলো, তিনি অনেক সময় ধ্যানমগ্ন অবস্থায় গান লিখতেন, পরে নিজেই ভুলে যেতেন যে এমন গান তিনি লিখেছেন। শিষ্যরা বিশ্বাস করতেন, তাঁর মাধ্যমে মা তারা স্বয়ং গান রচনা করতেন।
মিথ্যে চুরির অভিযোগ ও ‘অলৌকিক’ জেলঘরের ঘটনা
বামাক্ষ্যাপার জীবনের অন্যতম আলোচিত ঘটনা হলো তাঁর জেলে যাওয়া। শোনা যায়, একবার তাঁকে মিথ্যে চুরির অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছিল। কিন্তু জেলে ঢোকার কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘটে অদ্ভুত এক ঘটনা—হাজতের শিকল নিজে থেকেই ভেঙে যায়, আর দেখা যায় বামাক্ষ্যাপা বাইরে দাঁড়িয়ে হাসছেন।
গ্রামবাসীদের বিশ্বাস, এটি ছিল মা তারার আশীর্বাদ। সেই ঘটনার পর থেকে কেউ আর কখনও তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস পায়নি। এই ঘটনাই তাঁকে আরও রহস্যময় ও পূজনীয় করে তোলে।
ধনসম্পদের প্রতি অনাসক্তি
বামাক্ষ্যাপার জীবনে ধন-সম্পদ, ক্ষমতা বা বিলাসিতার কোনও স্থান ছিল না। তিনি সাধারণ খাবার—ভাত, শাক-সবজি, টক দই—খেয়ে দিন কাটাতেন।
অনেক জমিদার ও ধনীরা তাঁকে টাকা বা সম্পত্তি দিতে চাইতেন, কিন্তু তিনি সবসময় ফিরিয়ে দিতেন। তিনি বলতেন,
“আমার যা প্রয়োজন, মা তারা নিজেই দেন। আমি কিছুই চাই না।”

জমিদারের বাড়িতে অপমান ও তাঁর মহান প্রতিক্রিয়া
একবার এক ধনী জমিদার তাঁকে ভৃত্যদের সঙ্গে বসে খেতে বলেন, তাঁকে অপমান করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু বামাক্ষ্যাপা বিন্দুমাত্র রাগ না করে ভৃত্যদের পাশে বসেই খেতে শুরু করেন। তিনি বলেন,
“মা তো সবার মা। তাঁর কাছে ধনী-দরিদ্র কোনো পার্থক্য নেই।”
এই এক বাক্যেই উপস্থিত সবাই স্তব্ধ হয়ে যায়। সেই ঘটনার পর থেকে গ্রামের মানুষ তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা দ্বিগুণ হয়ে যায়।
অসুস্থ কন্যার অলৌকিক আরোগ্য
তারাপীঠে একবার এক বাবা-মা তাঁদের গুরুতর অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে আসেন। চিকিৎসকরা আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। বামাক্ষ্যাপা মায়ের মন্দিরের ধুলা সংগ্রহ করে সেই মেয়ের শরীরে মাখিয়ে দেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই অসুস্থ মেয়েটি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠে।
এই ঘটনার পর থেকে দূর-দূরান্তের মানুষ তাঁর কাছে আসতে শুরু করে, বিশ্বাস করতে থাকে যে তিনি মায়ের আশীর্বাদে অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন।
শ্মশানে রাত কাটানো ও তান্ত্রিক সাধনা
বামাক্ষ্যাপা প্রায়ই শ্মশানে রাত কাটাতেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল—শ্মশানই হচ্ছে মা তারার আসল আবাস। অনেক সময় দেখা যেত, তিনি চিতার ছাই মেখে গান গাইছেন।
তাঁর কণ্ঠে এমন ভক্তির আবেগ থাকত যে মানুষ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যেত। গ্রামবাসীরা তখন বুঝতে শুরু করে, তাঁর “পাগলামি” আসলে গভীর আধ্যাত্মিক সাধনার ফল।
প্রাণীপ্রেম ও দয়া
বামাক্ষ্যাপার অজানা এক দিক হলো তাঁর প্রাণীপ্রেম। তিনি মন্দিরের আশেপাশে থাকা কুকুর ও বিড়ালদের প্রায়ই খাবার দিতেন। অনেক সময় দেখা যেত, মা তারার সিংহাসনের প্রসাদ তিনি নিজের হাতে কুকুরকে খাওয়াচ্ছেন।
পুরোহিতরা এতে ক্ষুব্ধ হলেও তিনি বলতেন,
“মা তো সকল জীবের মধ্যে বিরাজ করেন। কুকুরকে খাওয়ালে মা-ই তৃপ্ত হন।”
এই মানবিকতা ও দয়ার দৃষ্টান্ত তাঁকে আরও মহান করে তোলে।
তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা নিয়ে প্রচলিত কাহিনী
বামাক্ষ্যাপাকে ঘিরে নানা গুজব ও কাহিনী আজও প্রচলিত। কেউ বলে, তিনি আগুনে হাত ঢুকিয়েও পোড়েননি। কেউ বলে, নদীর তীব্র স্রোতের মধ্যে দাঁড়িয়েও অক্ষত ছিলেন।
তবে তিনি কখনও এসব নিয়ে গর্ব করতেন না। তিনি শিষ্যদের বলতেন,
“এসব কিছুই মায়ের খেলা, আমি কিছুই নই। আমি শুধু মায়ের সন্তান।”
তাঁর এই বিনয়ী মনোভাবই তাঁকে সাধক থেকে কিংবদন্তি করে তুলেছে।
মৃত্যুর আগে আলোর মিলন
বামাক্ষ্যাপার মৃত্যুর ঘটনাটিও রহস্যে ভরা। শিষ্যদের মতে, মৃত্যুর ঠিক আগে তিনি “মা তারা”র নাম জপ করতে করতে এক আশ্চর্য আলোয় বিলীন হয়ে যান।
তাঁদের বিশ্বাস, তিনি দেহ ত্যাগ করেননি—মায়ের সত্তায় মিশে গিয়েছেন। সেই থেকেই তাঁর নাম আজও বেঁচে আছে প্রতিটি ভক্তের হৃদয়ে।
সাধক বামাক্ষ্যাপার উত্তরাধিকার
আজও তারাপীঠের প্রতিটি কোণে তাঁর স্মৃতি জীবন্ত। তাঁর গানের বাণী, তাঁর সাধনার পথ, তাঁর মানবিকতা—সবই বাঙালি সমাজে আজও অনুপ্রেরণার উৎস।
বামাক্ষ্যাপা আমাদের শেখান—ভক্তি মানে অন্ধ বিশ্বাস নয়, বরং নিজেকে সম্পূর্ণভাবে ঈশ্বরের হাতে সমর্পণ করা।
তাঁর জীবন প্রমাণ করে, “পাগলামি”র আড়ালে লুকিয়ে থাকতে পারে সত্য সাধনার আসল রূপ।
উপসংহার
সাধক বামাক্ষ্যাপার জীবন রহস্যময়, কিন্তু তাঁর ভক্তি, প্রেম ও মানবতার বার্তা আজও প্রাসঙ্গিক। তিনি শুধু একজন সাধক নন—তিনি এক চিরজাগ্রত চেতনা, যাঁর জীবন আমাদের শেখায় যে বিশ্বাসের শক্তি অলৌকিকতাকেও বাস্তবে রূপ দিতে পারে।
তারাপীঠ আজও তাঁর নামের আলোয় উজ্জ্বল—যেখানে ভক্তরা বিশ্বাস করে, মা তারার মতোই বামাক্ষ্যাপাও তাঁদের আশ্রয় ও আশীর্বাদ দান করেন।