রাতে ঘুমানোর আগে অতিরিক্ত ফোন দেখলে কী হয়? | Phone Before Bed Effects Explained by Experts

Spread the love

রাতে ঘুমানোর আগে অতিরিক্ত ফোন খোলা স্ক্রিনের নীল আলো, ঘুমের হরমোন মেলাটোনিনকে বাধা দেয় এবং অনিদ্রা ও চোখের সমস্যা ডেকে আনতে পারে।

আধুনিক জীবনে আমরা প্রায় প্রতিদিনই রাতবেলা শুয়ে যাওয়ার আগে মোবাইলে স্ক্রল করি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম দেখি বা ভিডিও চালাই। এই অভ্যাস রিল্যাক্স করার লক্ষ্যেও হতে পারে — কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অভ্যাসটি আমাদের ঘুম, চোখ ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে।

সমঝদার শরীর এবং ঘুমের হরমোন

আমাদের শরীরে ঘুমিং সাইকেল নিয়ন্ত্রণ করে এক বিশেষ হরমোন — মেলাটোনিন। এটি সাধারণত রাত হওয়া মাত্রই তৈরি হতে শুরু করে, আমাদের মন ও শরীরকে ঘুমের দিকে ধাবিত করে। কিন্তু ফোনের স্ক্রিন থেকে বের হওয়া নীল আলো (blue light) এই প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে। এক গবেষণা দেখিয়েছে, নীল আলো সবুজ আলোয়ের তুলনায় প্রায় দুই গুণ বেশি সময় মেলাটোনিনের নিঃসরণ বন্ধ করে দেয়Harvard Health+1

এর ফলে ঘুম আসতে দেরি হয়, ঘুম ভাঙ্গা বেড়ে যায়, এবং ব্যক্তির পরের দিন ক্লান্তি, মনোযোগ কমে যাওয়ার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে।

ফোন ব্যবহার ও ঘুমের সম্পর্ক

এমনও দেখা গেছে যে যারা ঘুমানোর এক ঘণ্টার মধ্যে মোবাইল বা ফোন ব্যবহার করেন, তাদের মধ্যে ঘুমের গুণমান কম থাকে। এক অধ্যয়নে দেখা গেছে — এক ঘণ্টার বেশি স্ক্রিন টাইম থাকলে অনিদ্রার ঝুঁকি প্রায় ৫৯ শতাংশ বাড়ে। Healthline+1 পুরো শরীরে ক্লান্তি বা মনোবলহ্রাস শুরু হতে পারে।

আরেক গবেষণা বলছে, ফোন ব্যবহারের কারণে ঘুমের জন্য সময় লাগতে পারে বেশি (sleep latency বাড়ে) এবং ঘুমের মধ্যে বারবার জেগে ওঠার সময়ও বেশি হয়। PMC+1

চোখ এবং স্ক্রিনের ‘চাপ’

সিনেমা দেখার মতো বা সোশ্যাল মিডিয়া স্ক্রল করার মতো রাতবেলা স্ক্রিনের আলো শুধু ঘুমে বাধা না দেয় — চোখের স্বাস্থ্যের ওপরও চাপ ফেলে। স্ক্রিনের দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকার ফলে চোখ শুষ্ক হয়ে যায়, ঝাপসা দেখা যায়, মাথায় ব্যথা ধরা দিতে পারে।
উৎস বলছে, “স্মার্টফোন ব্যবহারের ফলে ঘুম ঘাটতি ও চোখের ক্লান্তি একত্রে বাড়ছে”। The Times of India

মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব

রাতের শেষ মুহূর্তে ফোনে স্ক্রল করা মানে শুধু শারীরিক নয় — মানসিক স্তরেও নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে আসে। নোটিফিকেশন, আপডেট, ভিডিও বা চ্যাট — এসব আমাদের মস্তিষ্ককে শেষ মুহূর্তে সক্রিয় রাখে। ফলে শরীর এবং মন শিথিল হতে পারে না। বিশেষভাবে, উদ্বেগ, মনোসংযোগহ্রাস, পরের দিনের ক্লান্তি বা নির্বিকারতা এসব এই অবস্থার ফল হতে পারে।

দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি: ঘুমের ঘাটতি ও বিপাকীয় সমস্যা

রাতবেলা অতিরিক্ত ফোন ব্যবহারে শুধু একরাতের ঘুম ভাঙে না — দীর্ঘমেয়াদে এটি বিপাক, হরমোন, রক্তচাপসহ বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার ঝুঁকি বাড়ায়। নীল আলো ও ঘুমের ব্যাঘাত একসাথে থাকলে শরীরের ঘড়ি (circadian rhythm) বিকৃত হতে পারে। CDC এতে দীর্ঘমেয়াদে বৃদ্ধি পায় স্থূলতা, টাইপ-২ ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ইত্যাদির সম্ভাবনা।

আধুনিক জীবনে ফোন ব্যবহার এবং ঘুমের মান

কর্মজীবী মানুষের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে দেখা গেছে — রাতবেলা মোবাইলে কাজ চালিয়ে যাওয়ার কারণে ঘুমের আগেই সতর্কতা হারায়। পরের দিন উৎপাদনশীলতা কমে যায়, মনোযোগ নষ্ট হয়। এমন অভ্যাস যদি নিয়ম হয়ে ওঠে, তাহলে শুধু ঘুমের ঘাটতি নয় — কর্মক্ষমতা ও জীবনের গুণমানও কমে যেতে পারে।

ব্লু লাইট ফিল্টার বা নাইট মোড কি সমাধান?

অনেক স্মার্টফোনে এক ধরনের নাইট মোড, ব্লু-লাইট ফিল্টার থাকে। এগুলো কিছুটা সাহায্য করে। তবে গবেষণা বলছে — এটি পুরো সমাধান নয়। স্ক্রিনের আলো বন্ধ না করার কারণে হরমোন নিঃসরণ ও ঘুমের গুণমানের ক্ষতি কম হয় না। PubMed+1 মূল সমাধান হলো — শুবার ঠিক আগে স্ক্রিন থেকে দূরে থাকা।

শিশু ও কিশোরদের ঝুঁকি

শিশু ও কিশোররা রাতবেলায় ফোন বেশি ব্যবহার করলে তাদের ঘুমের ধরণ ও মান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পড়াশোনায় মনোযোগ কমে যায়, স্মৃতিশক্তি দুর্বল হতে পারে। একটি অধ্যয়নে দেখা গেছে — ১৬ ঘন্টা আগে-স্ক্রিন ব্যবহারের কারণে ঘুমের মান অন্যদের তুলনায় বেশি খারাপ। PMC+1

রাতে ঘুমানোর আগে ফোন দেখা ক্ষতিকর? | Blue Light Sleep Impact Explained

ঘুম ভালো রাখতে ভালো অভ্যাস গড়ুন

বিশেষজ্ঞরা নিচের অভ্যাসগুলো অনুসরণ করার পরামর্শ দেন —

  • শুবার অন্তত ৩০-৬০ মিনিট আগে মোবাইল, ট্যাব বা টিভি বন্ধ করুন।
  • ঘরে ফোন রাখুন হাত থেকে দূরে বা অন্য রুমে রাখুন যাতে উঠে গিয়ে বন্ধ করতে হয়।
  • শোবার আগে একটি বই পড়ুন, হালকা সঙ্গীত শুনুন বা ধ্যান করুন। এমন ‘ওয়াইন্ডডাউন রুটিন’ ঘুমের জন্য সহায়ক।
  • ঘুমের ঘরে আলো হালকা রাখুন, স্ক্রিনের আলো যতটা সম্ভব কমান।
  • সময়ে সময়ে বিশ্রাম, পর্যাপ্ত ঘুম ও নিয়মিত ব্যায়াম ঘুমের গুণমান বাড়ায়।

রাতের শেষ মুহূর্তে মোবাইল ফোন হাতে নেওয়া এখন অনেকের দৈনন্দিন রুটিন। কিন্তু গবেষণা ও বিশেষজ্ঞদের অভিমত স্পষ্ট — এই অভ্যাস ঘুমের ‌প্রাকৃতিক ধরণ, চোখ ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। শুধু স্ক্রিনের আলো নয়, এমন সময়ের ব্যবহার যা মন ও শরীরকে শান্ত হতে দেয় না, সেটিও সমস্যা।

এক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ হলো — শোবার অন্তত আধঘণ্টা আগে ফোন বন্ধ রাখা, হালকা মনোযোগহীন কাজে মন দেওয়া এবং ঘুমের জন্য নির্ধারিত সময় ও পরিবেশ গঠন করা। জীবনের গতিতে প্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ — কিন্তু তার নিয়ন্ত্রণই হয় সবচেয়ে বড় সচেতনতাভিত্তিক চ্যালেঞ্জ। সুস্থ ঘুম, শান্ত মন ও ভালো স্বাস্থ্যের জন্য আজই এই পরিবর্তন শুরু করুন।

Sources & References

  • “The influence of blue light on sleep, performance and wellbeing in individuals” – PMC review. PMC
  • “Blue light has a dark side” – Harvard Health. Harvard Health
  • “The effect of smartphone use at bedtime on sleep quality among adults” – PMC study. PMC
  • “Effect of restricting bedtime mobile phone use on sleep, arousal, mood” – PLoS ONE. PLOS
  • “How Electronics Affect Sleep” – Sleep Foundation. Sleep Foundation
]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *