অযোধ্যার বাবরি মসজিদ এবং রাম জন্মভূমি সংক্রান্ত বিতর্ক ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এটি শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় স্থান বা স্থাপনার ইতিহাস নয়, বরং ভারতীয় সমাজের সাম্প্রদায়িক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক গতিধারা কীভাবে গঠিত হয়েছে, সেই প্রতিফলনও বটে। এই বিতর্কের শিকড় বহু শতাব্দী প্রাচীন, তবে আধুনিক যুগে এটি ভারতের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।
এই গবেষণায় আমরা বাবরি মসজিদের প্রতিষ্ঠা, এর বিরুদ্ধে উত্থাপিত বিতর্ক, বিভিন্ন সময়ের রাজনৈতিক চালচিত্র, বাবরি মসজিদের ধ্বংস, দীর্ঘ আইনি লড়াই, এবং সুপ্রিম কোর্টের চূড়ান্ত রায়ের আলোকে অযোধ্যার ইতিহাসের একটি সুগভীর বিশ্লেষণ উপস্থাপন করব।
১৫২৬ সালে পানিপথের প্রথম যুদ্ধের মাধ্যমে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবর ভারতে তাঁর শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর রাজত্বকালে বিভিন্ন স্থানে মুঘল স্থাপত্যশৈলীতে মসজিদ নির্মিত হয়। ঐতিহাসিক সূত্র অনুসারে, ১৫২৮ সালে বাবরের সেনাপতি মীর বাকি উত্তর ভারতের অযোধ্যা অঞ্চলে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন, যা পরবর্তীতে ‘বাবরি মসজিদ’ নামে পরিচিত হয়। এটি ছিল তিন গম্বুজবিশিষ্ট একটি মুঘল স্থাপত্যের নিদর্শন, যা দীর্ঘকাল ধরে মুসলিম সম্প্রদায়ের উপাসনালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল।
তবে, হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি অংশ দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছে যে এটি ভগবান রামের জন্মস্থান এবং সেখানে পূর্বে একটি বিশাল মন্দির ছিল, যা ভেঙে মসজিদ নির্মাণ করা হয়। হিন্দু বিশ্বাস অনুসারে, রামচন্দ্র অযোধ্যার ইক্ষ্বাকু বংশের রাজা ছিলেন এবং তাঁর জন্মস্থান বর্তমান বাবরি মসজিদের স্থানেই অবস্থিত ছিল। এই বিশ্বাসের ভিত্তিতে মসজিদ ও মন্দির বিতর্কের সূত্রপাত হয়।
ঔপনিবেশিক শাসনের সময়ে, বিশেষ করে ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পর, ব্রিটিশ প্রশাসন হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হয়। ১৮৫৩ সালে বাবরি মসজিদের মালিকানা ও ব্যবহারের বিষয়ে প্রথম সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এই সময়ে ব্রিটিশ প্রশাসন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ১৮৫৯ সালে মসজিদের চারপাশে একটি বেড়া নির্মাণ করে, যার ফলে মুসলিমদের মসজিদের ভেতর নামাজ পড়ার অনুমতি দেওয়া হয়, আর হিন্দুদের বাইরের চত্বরে পূজা করার অনুমতি দেওয়া হয়।
১৮৮৫ সালে মহন্ত রঘুবীর দাস নামে এক হিন্দু সাধু বাবরি মসজিদের পাশেই একটি মন্দির নির্মাণের জন্য আদালতে আবেদন করেন। তবে, ব্রিটিশ আদালত তাঁর দাবি নাকচ করে দেয়। ব্রিটিশ প্রশাসন বিষয়টি অত্যন্ত সংবেদনশীল বলে ঘোষণা করে এবং দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রাখার কৌশল গ্রহণ করে।
ভারতের স্বাধীনতার পর বাবরি মসজিদ বিতর্ক নতুন মাত্রা পায়। ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বরে, মসজিদের মূল অংশে ‘রামলালার’ মূর্তি পাওয়া যায়। হিন্দু সম্প্রদায় দাবি করে যে এটি অলৌকিকভাবে আবির্ভূত হয়েছে, অন্যদিকে মুসলিম সম্প্রদায় মনে করে যে এটি পরিকল্পিতভাবে মসজিদের ভেতরে স্থাপন করা হয়েছিল। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হলে ভারত সরকার মসজিদটি তালাবদ্ধ করে দেয়, ফলে এটি দীর্ঘদিন ধরে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে।
১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি) ও বিজেপি রাম মন্দির নির্মাণের দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন শুরু করে। ১৯৯০ সালে লালকৃষ্ণ আডবানির নেতৃত্বে ‘রথযাত্রা’ অনুষ্ঠিত হয়, যা এই আন্দোলনকে আরও তীব্র করে তোলে।
১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর কয়েক হাজার করসেবক বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলে। এই ঘটনার ফলে সারা ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে প্রায় ২,০০০ মানুষ নিহত হয়।
বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর দীর্ঘদিন ধরে আইনি লড়াই চলতে থাকে। ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয় যে বিতর্কিত জমিতে রাম মন্দির তৈরি হবে এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য অন্যত্র ৫ একর জমি বরাদ্দ করা হবে।
১৯৪৯ সালের ডিসেম্বরে বাবরি মসজিদের ভেতরে ‘রামলালার’ মূর্তি পাওয়া যায়। হিন্দু সম্প্রদায় দাবি করে যে এটি অলৌকিকভাবে আবির্ভূত হয়েছে, অন্যদিকে মুসলিম সম্প্রদায় মনে করে, এটি পরিকল্পিতভাবে মসজিদের ভেতরে স্থাপন করা হয়েছিল। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হলে ভারত সরকার মসজিদটি তালাবদ্ধ করে দেয়।
১৯৮৬ সালে ফৈজাবাদের জেলা আদালত রামলালার পূজার অনুমতি দেয় এবং বাবরি মসজিদের তালা খুলে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। এর ফলে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয় এবং তারা বাবরি মসজিদ রক্ষার জন্য ‘বাবরি মসজিদ অ্যাকশন কমিটি’ গঠন করে।
১৯৮৪ সালে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি) রাম মন্দির নির্মাণের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। ১৯৯০ সালে বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আডবানি রথযাত্রার মাধ্যমে আন্দোলনকে আরও উগ্র করে তোলেন। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির উত্থান এই সময় থেকে ভারতীয় রাজনীতিতে আরও সুসংহত হতে থাকে।
১৯৯১ সালে বিজেপি ভারতের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে শক্তিশালী হয়ে ওঠে, এবং এই সময় রাম মন্দির ইস্যুকে তারা একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর, হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর ডাকে হাজার হাজার করসেবক বাবরি মসজিদের সামনে জড়ো হয়। উগ্র জনতা মসজিদের গম্বুজ ভেঙে ফেলে এবং ঐতিহাসিক এই স্থাপনাটিকে ধ্বংস করে।

৬ ডিসেম্বর ১৯৯২ সালে হাজার হাজার করসেবক বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলে। এই ঘটনার ফলে সারা ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে প্রায় ২,০০০ মানুষ নিহত হয়। এই ঘটনা ভারতীয় রাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনে এবং হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে দাঁড়ায়।
বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর দীর্ঘদিন ধরে এই বিতর্ক আদালতে চলে। ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয় যে বিতর্কিত জমিতে রাম মন্দির তৈরি হবে এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য অন্যত্র ৫ একর জমি বরাদ্দ করা হবে।
২০২০ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী রাম মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন এবং ২০২৪ সালের ২২ জানুয়ারি ‘প্রাণপ্রতিষ্ঠা’ অনুষ্ঠিত হয়। এই মন্দির বিজেপির হিন্দুত্ব রাজনীতির প্রতীক হয়ে উঠেছে।
বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর দীর্ঘদিন ধরে এই বিতর্ক আদালতে চলে। বিভিন্ন আদালতে বহু বছর ধরে মামলাটি চলতে থাকে। অবশেষে, ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর ভারতের সুপ্রিম কোর্ট চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করে। এই রায়ে বলা হয় যে বিতর্কিত জমিটি হিন্দু সম্প্রদায়ের অধীনে থাকবে এবং সেখানে রাম মন্দির নির্মাণ করা হবে। পাশাপাশি, মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য অন্যত্র ৫ একর জমি বরাদ্দ করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
২০২০ সালের ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আনুষ্ঠানিকভাবে রাম মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০২৪ সালের ২২ জানুয়ারি মন্দিরের ‘প্রাণপ্রতিষ্ঠা’ সম্পন্ন হয়, যা ভারতীয় রাজনীতিতে হিন্দুত্ববাদী আদর্শের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রাম মন্দির নির্মাণ কেবল ধর্মীয় নয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রেও গভীর প্রভাব ফেলেছে। এটি বিজেপির রাজনৈতিক এজেন্ডাকে আরও শক্তিশালী করেছে এবং সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চর্চাকে আরও স্পষ্ট করেছে।
অযোধ্যার বাবরি মসজিদ-রাম মন্দির বিতর্ক ভারতীয় সমাজে ধর্ম ও রাজনীতির আন্তঃসম্পর্ককে গভীরভাবে চিহ্নিত করেছে। এটি শুধুমাত্র অতীতের অংশ নয়, বরং এটি ভারতীয় রাজনৈতিক ভবিষ্যতের উপরও গভীর প্রভাব ফেলতে থাকবে।
রাম মন্দির নির্মাণের মধ্য দিয়ে একটি দীর্ঘদিনের বিতর্কের সমাপ্তি ঘটলেও, এর প্রভাব রাজনৈতিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় ক্ষেত্রে বহুবিধ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। এটি ভারতের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে একদিকে হিন্দু জাতীয়তাবাদ আরও প্রবল হয়েছে, অন্যদিকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা ও ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রশ্ন নতুন করে উত্থাপিত হয়েছে।
এই বিতর্ক থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো, ধর্ম ও রাজনীতি যখন পরস্পরকে প্রভাবিত করে, তখন তা শুধুমাত্র ধর্মীয় বিশ্বাসের ব্যাপার থাকে না, বরং জাতীয় ঐক্য ও সামাজিক সংহতির প্রশ্ন হয়ে ওঠে। ভারতীয় সমাজে বহুত্ববাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতাকে বজায় রাখতে হলে এই বিতর্কের বিভিন্ন দিক নিয়ে আরও গভীর আলোচনা ও বোঝাপড়ার প্রয়োজন।
সর্বোপরি, রাম মন্দির নির্মাণ ভারতের ইতিহাসের একটি যুগান্তকারী ঘটনা যা আগামী দিনেও রাজনৈতিক ও সামাজিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থাকবে।