বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রাথমিক শিক্ষা থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্তরে শিক্ষার বিস্তার এবং মান উন্নয়নের ক্ষেত্রে গত কয়েক দশকে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। তবে এই অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে রয়েছে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ, যা মোকাবিলা করা দেশের ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত জরুরি। এই প্রবন্ধে বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার একটি বিশদ পর্যালোচনা তুলে ধরা হবে।
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা মূলত তিনটি স্তরে বিভক্ত — প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষা। প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তির হার বর্তমানে প্রায় ৯৮ শতাংশ, যা একটি বড় অর্জন। এছাড়া মাধ্যমিক পর্যায়েও শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার মান নিয়ে এখনও অনেক প্রশ্ন থেকে যায়।
উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে মোট ১৬০টিরও বেশি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণামূলক কার্যক্রমে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। তবে উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য আরও গবেষণা, প্রযুক্তি ব্যবহার এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উন্নীত হওয়া প্রয়োজন।
বাংলাদেশ সরকার প্রতি বছর জাতীয় বাজেটের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ শিক্ষাখাতে বরাদ্দ করে। তবে এই বরাদ্দ দেশের শিক্ষার প্রয়োজন অনুযায়ী এখনও পর্যাপ্ত নয় বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। অনেক গ্রামীণ এলাকায় এখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাব রয়েছে এবং বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোর অবকাঠামো উন্নত করার প্রয়োজন।
সরকারি উদ্যোগে স্কুল-কলেজে ডিজিটাল লার্নিং বা প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা চালু করা হয়েছে। তবে এই প্রচেষ্টা এখনও সারা দেশে সমানভাবে পৌঁছায়নি। গ্রামীণ এলাকায় ইন্টারনেট সংযোগের অভাব এবং আধুনিক সরঞ্জামের অপ্রতুলতা বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশে নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে ছাত্রীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তারা ছেলেদের তুলনায় ভালো ফলাফল করছে। সরকারের গৃহীত উদ্যোগ, যেমন উপবৃত্তি প্রদান এবং মেয়েদের জন্য আলাদা স্কুল নির্মাণ, এই উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তবে উচ্চশিক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণ এখনও পুরুষদের তুলনায় কম। এই ক্ষেত্রে আরও সচেতনতা এবং সহায়তা প্রয়োজন।
প্রধান চ্যালেঞ্জসমূহ
বর্তমান পাঠ্যক্রম অনেক ক্ষেত্রেই আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। অনেক বিষয় এখনও পুরনো পদ্ধতিতে পড়ানো হয়, যা বাস্তব জীবনের প্রয়োজন মেটাতে ব্যর্থ।
শিক্ষক সংকট দেশের শিক্ষার মান উন্নয়নের বড় চ্যালেঞ্জ। অনেক স্কুলে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক নেই। পাশাপাশি, বিদ্যমান শিক্ষকদের অনেকেরই পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ নেই, যা শিক্ষার মান প্রভাবিত করে।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের ড্রপআউট হার এখনও একটি বড় সমস্যা। দারিদ্র্য, বাল্যবিবাহ এবং শিক্ষার প্রতি অনীহা এর প্রধান কারণ। বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় এই হার বেশি।
যদিও ডিজিটাল লার্নিং প্রচলিত হয়েছে, তবে শহর ও গ্রামের মধ্যে একটি বড় বৈষম্য দেখা যায়। গ্রামীণ এলাকায় প্রযুক্তির অপ্রতুলতা এবং ইন্টারনেট সংযোগের অভাব শিক্ষার্থীদের পিছিয়ে রাখছে।
উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে গবেষণার অভাব স্পষ্ট। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত তহবিল এবং সুযোগ নেই, যা নতুন জ্ঞান সৃষ্টির ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করছে।
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে, তা সত্ত্বেও এর উন্নয়নের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে পাঠ্যক্রম উন্নত করা এবং শিক্ষার্থীদের বাস্তব জীবনের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন।
শিক্ষকদের প্রশিক্ষণকে বাধ্যতামূলক করা এবং নতুন শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে গুণগত মান বজায় রাখা জরুরি। এতে শিক্ষার মান অনেকাংশে উন্নত হবে।
ডিজিটাল শিক্ষা শহর থেকে গ্রামে ছড়িয়ে দিতে হবে। প্রতিটি স্কুলে আধুনিক প্রযুক্তি এবং ইন্টারনেট সংযোগ নিশ্চিত করা গেলে শিক্ষার্থীদের শেখার পদ্ধতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।
নারীদের উচ্চশিক্ষায় আরও বেশি অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এর পাশাপাশি কর্মজীবনে প্রবেশে তাদের জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার জন্য তহবিল বরাদ্দ বাড়াতে হবে এবং শিক্ষার্থীদের নতুন নতুন ধারণা উদ্ভাবনে উৎসাহিত করতে হবে।
বাংলাদেশে ক্ষমতার পালাবদলের পর থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পরিবারের নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার পরিকল্পনা কার্যত বাস্তবায়ন করছে ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এ বিষয়ে একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম হলো দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং মেডিক্যাল কলেজের নাম পরিবর্তন।
সম্প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে, যেখানে ঘোষণা করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করা হবে। জানা গেছে, এই সিদ্ধান্তের আওতায় রয়েছে মোট ১৩টি বিশ্ববিদ্যালয়। এর মধ্যে ১১টি বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধুর নামে, একটি শেখ ফজিলাতুন্নেসার নামে এবং একটি শেখ হাসিনার নামে।
ইউনূস সরকার প্রথম থেকেই বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি মুছে ফেলার পরিকল্পনা হাতে নেয়। এর আগে দেশের ছ’টি মেডিক্যাল কলেজের নাম পরিবর্তন করা হয়। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একটি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এই নাম পরিবর্তনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। এসব উদ্যোগের মাধ্যমে মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক বঙ্গবন্ধুকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

ইউনূস সরকার শুধু প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করেই থেমে থাকেনি। তারা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায়ও ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে বঙ্গবন্ধুর নাম এবং তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়গুলো। ভাষা আন্দোলন নিয়ে বঙ্গবন্ধুর লেখা বই ‘বায়ান্নোর দিনগুলো’ পাঠ্যক্রম থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের জন্য আরবি ভাষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
ইতিমধ্যেই বিভিন্ন সরকারি দফতর থেকে বঙ্গবন্ধুর ছবি সরিয়ে ফেলা হয়েছে। এমনকি রাষ্ট্রপতি ভবনের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো থেকেও তাঁর ছবি অপসারণ করা হয়েছে। এই উদ্যোগ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভূমিকা এবং দেশের স্বাধীনতার জন্য তাঁর অবদানের স্মৃতি মুছে ফেলার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
দেশজুড়ে মোট ১৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম মুছে ফেলার জন্য সমীক্ষা চালিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সমীক্ষায় উঠে আসা তথ্য অনুযায়ী, এগুলোর মধ্যে ১১টি বঙ্গবন্ধুর নামে, একটি শেখ ফজিলাতুন্নেসার নামে এবং একটি শেখ হাসিনার নামে। নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন মহলে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধরনের পদক্ষেপের মাধ্যমে দেশের তরুণ প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক গুরুত্বকে আড়াল করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
ওয়াকিবহাল মহলের মতে, ক্ষমতা বদলের পর থেকেই বঙ্গবন্ধুর ঐতিহ্যকে মুছে ফেলার জন্য ইউনূস সরকার ধারাবাহিকভাবে কাজ করছে। শিক্ষা ব্যবস্থার খোলনলচে বদলে নতুন প্রজন্মকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ এবং দেশের স্বাধীনতার ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এ ধরনের পদক্ষেপ দেশের ঐতিহ্য এবং মূল্যবোধের জন্য একটি বড় হুমকি। তারা বলছেন, বঙ্গবন্ধুর নাম এবং তাঁর অবদান মুছে ফেলার চেষ্টা শুধু একটি পরিবারকে নয়, পুরো জাতির ইতিহাসকেই বিকৃত করার শামিল।
এ ধরনের পদক্ষেপের কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানে জনগণের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। সাধারণ মানুষ এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলার এই প্রচেষ্টা শুধু ইতিহাসের প্রতি অশ্রদ্ধা নয়, এটি জাতির প্রতি একটি বড় ধরনের বিশ্বাসঘাতকতা।
ইউনূস সরকারের উদ্যোগে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলার প্রচেষ্টা দেশের ইতিহাস এবং সংস্কৃতির উপর একটি গভীর আঘাত। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে শুধুমাত্র একটি পরিবারের নাম মুছে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে না; বরং দেশের স্বাধীনতার ইতিহাসকেও বিকৃত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। দেশের জনগণ এই ধরনের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে, যা ভবিষ্যতে ইতিহাস রক্ষার লড়াইকে আরও জোরালো করবে।
এই ঘটনাগুলো প্রমাণ করে, ইতিহাস বিকৃতির মাধ্যমে একটি জাতিকে নিজের শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা কোনোভাবেই সফল হতে পারে না। জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি এবং ঐতিহ্য আগামীর প্রজন্মের কাছে ঠিকই সংরক্ষিত থাকবে।