তুলসী গাছকে হিন্দু ধর্মে অত্যন্ত পবিত্র ও শুভ বলে মনে করা হয়। এটি শুধুমাত্র ধর্মীয় কারণেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং এর অসাধারণ ঔষধি গুণাগুণের জন্যও এটি বহু যুগ ধরে বিশেষ সম্মানের সঙ্গে পূজিত হয়ে আসছে। তুলসী গাছ বাড়ির পরিবেশ শুদ্ধ রাখে, রোগ-ব্যাধি দূর করতে সাহায্য করে এবং ইতিবাচক শক্তির সঞ্চার ঘটায়। তবে বাস্তু শাস্ত্র মতে, তুলসী গাছ কোথায় রাখা হচ্ছে, সেটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভুল স্থানে তুলসী গাছ রাখলে তা পরিবারে দারিদ্র্য, অশান্তি ও নানা ধরনের অমঙ্গল ডেকে আনতে পারে। তাই তুলসী গাছের পূর্ণ সুফল পেতে হলে এটি সঠিক দিক ও নিয়ম মেনে রাখা উচিত।
বাস্তু শাস্ত্র অনুসারে, তুলসী গাছ বাড়ির দক্ষিণ দিকে রাখা একেবারেই উচিত নয়। দক্ষিণ দিককে পিতৃপুরুষদের দিক বলা হয় এবং এটি অগ্নি তত্ত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত। তুলসী গাছ দেবতার প্রতীক হওয়ায়, এটি দক্ষিণ দিকে রাখলে পরিবারের সদস্যদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। বিশেষ করে আর্থিক অনটন, মানসিক অস্থিরতা ও স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই তুলসী গাছ কখনোই দক্ষিণ দিকে রাখা উচিত নয়।
তুলসী গাছ রাখার জন্য সবচেয়ে শুভ দিক হলো বাড়ির উত্তর, পূর্ব বা উত্তর-পূর্ব দিক। বাস্তু মতে, এই দিকগুলিতে তুলসী গাছ রাখলে তা পরিবারের ওপর শুভ প্রভাব ফেলে এবং ইতিবাচক শক্তি বৃদ্ধি করে। বিশেষ করে পূর্ব দিক সূর্যের দিক হওয়ায়, এই স্থানে তুলসী গাছ রাখা অত্যন্ত শুভফলদায়ক বলে মনে করা হয়। এতে পরিবারের সদস্যদের মানসিক শান্তি বজায় থাকে, স্বাস্থ্য ভালো থাকে এবং আর্থিক সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পায়।
তুলসী গাছের সঙ্গে আরও কিছু বাস্তু নিয়ম মেনে চলা উচিত। প্রথমত, তুলসী গাছ সবসময় পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন স্থানে রাখা উচিত। শুকনো বা নষ্ট হয়ে যাওয়া পাতা নিয়মিত পরিষ্কার করা দরকার, কারণ বাস্তু মতে, নোংরা ও অব্যবহৃত গাছ নেতিবাচক শক্তি সৃষ্টি করে। দ্বিতীয়ত, তুলসী গাছ কখনোই সরাসরি মাটিতে লাগানো উচিত নয়, বরং এটি টব বা উঁচু জায়গায় রাখা শুভ বলে মনে করা হয়। এতে পরিবারের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হয় এবং বাড়িতে পজিটিভ এনার্জি প্রবাহিত হয়।
বাস্তু মতে, তুলসী গাছের চারপাশে কোন শুকনো বা কাঁটাযুক্ত গাছ রাখা ঠিক নয়। বিশেষ করে ক্যাকটাস বা দুধবতী জাতীয় গাছ তুলসীর আশেপাশে রাখলে তা বাস্তু দোষ সৃষ্টি করতে পারে। তুলসীর চারপাশে শুধুমাত্র শুভ গাছ যেমন বেল, অশোক বা আমলকী গাছ রাখা যেতে পারে, যা ইতিবাচক শক্তিকে আরও বৃদ্ধি করে।
তুলসী গাছের পূজার ক্ষেত্রেও কিছু বাস্তু নিয়ম রয়েছে। প্রতিদিন সকালে তুলসী গাছে জল দেওয়া শুভ বলে মনে করা হয়, তবে সন্ধ্যায় বা রাতে জল দেওয়া উচিত নয়। বৃহস্পতিবার তুলসী গাছে জল দেওয়া অত্যন্ত শুভ, কারণ এটি বিষ্ণু দেবের পবিত্র দিন হিসেবে বিবেচিত হয়। তুলসী গাছের নিচে প্রদীপ জ্বালানো অত্যন্ত শুভ বলে ধরা হয়, যা বাড়ির সমস্ত অশুভ শক্তিকে দূর করে এবং ইতিবাচক শক্তির সঞ্চার ঘটায়।
বাস্তু মতে, তুলসী গাছ শুকিয়ে গেলে বা মারা গেলে সঙ্গে সঙ্গে তা পরিবর্তন করা উচিত। শুকনো তুলসী গাছ বাড়িতে রাখলে তা বাস্তু দোষের সৃষ্টি করতে পারে এবং নেতিবাচক শক্তি আনতে পারে। নতুন তুলসী গাছ রোপণ করার সময় কিছু তুলসী বীজ মাটিতে ছড়িয়ে দেওয়া শুভ বলে মনে করা হয়, যাতে নতুন গাছ দ্রুত বৃদ্ধি পায়।
তুলসী গাছ শুধু বাস্তু শাস্ত্র নয়, বৈজ্ঞানিক দিক থেকেও অত্যন্ত উপকারী। এটি বাতাস পরিশুদ্ধ করতে সাহায্য করে, প্রচুর পরিমাণ অক্সিজেন নির্গত করে এবং বিভিন্ন রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। তুলসী পাতার নির্যাস রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক এবং ঠান্ডা-কাশি, সর্দি ও শ্বাসকষ্টের মতো সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে।
তাই তুলসী গাছ শুধু সৌভাগ্য ও ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতীক নয়, এটি বাস্তব জীবনেও শান্তি ও সুস্থতার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে এর পূর্ণ সুফল পেতে হলে সঠিক দিক ও নিয়ম মেনে তুলসী গাছ রোপণ করা জরুরি। বাস্তু শাস্ত্রের নিয়ম অনুযায়ী, তুলসী গাছ বাড়ির ভুল স্থানে রাখলে তা শুভফল না দিয়ে উল্টো অমঙ্গল আনতে পারে। তাই তুলসী গাছ লাগানোর আগে অবশ্যই এর সঠিক দিক ও অন্যান্য নিয়ম সম্পর্কে জানা উচিত।
প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রগুলোর মধ্যে বাস্তু শাস্ত্র এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। এটি শুধু বাড়ি নির্মাণ বা স্থাপত্যের নিয়মকানুন বলে দেয় না, বরং গৃহস্থের সুখ-শান্তি বজায় রাখতে গৃহের পরিবেশ কেমন হবে, কী কী জিনিস রাখা উচিত এবং কোন দিক কোন বিষয়ের জন্য শুভ—এসব বিষয় নিয়েও বিস্তারিত নির্দেশনা দেয়। গাছপালা আমাদের পরিবেশকে যেমন শুদ্ধ করে, তেমনই বাস্তু শাস্ত্র অনুযায়ী কিছু গাছ সৌভাগ্য, অর্থ, সুখ-সমৃদ্ধি এবং শান্তির প্রতীক হিসেবেও কাজ করে। তবে শুধু গাছ লাগালেই হবে না, কোন দিকের জন্য কোন গাছ উপযুক্ত এবং কোন গাছ কোথায় লাগালে অশুভ ফল বয়ে আনতে পারে, তা জানা জরুরি। সঠিক স্থানে ভুল গাছ লাগালে তা হতে পারে বিপদের কারণ।
শমি গাছ বাস্তু শাস্ত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি গাছ হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি শনিদেবের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বলে মনে করা হয়। বাড়িতে শমি গাছ রাখা শুভ হলেও, এর সঠিক স্থান নির্বাচন অত্যন্ত জরুরি। বাস্তু মতে, দক্ষিণ দিকে শমি গাছ লাগানো উচিত নয়। এর ফলে বাস্তু দোষ সৃষ্টি হতে পারে এবং পরিবারের সদস্যদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তবে পূর্ব দিকে বা ঈশান কোণে এই গাছ লাগালে তা শুভফল দেয় এবং বাস্তু দোষ দূর হয়। যারা শনির কৃপা পেতে চান এবং জীবনের বিভিন্ন বাধাবিপত্তি দূর করতে চান, তারা অবশ্যই শমি গাছ লাগাতে পারেন, তবে অবশ্যই সঠিক স্থানে।
তুলসী গাছ হিন্দু ধর্মে অত্যন্ত পবিত্র ও পূজনীয় বলে বিবেচিত হয়। এটি কেবলমাত্র ধর্মীয় কারণেই নয়, বরং ঔষধি গুণের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তুলসী গাছ বাড়ির পরিবেশ পবিত্র করে এবং রোগবালাই দূর করতে সহায়তা করে। তবে তুলসী গাছ লাগানোর ক্ষেত্রেও দিকের দিকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাস্তু মতে, দক্ষিণ দিকে তুলসী গাছ রাখা অত্যন্ত অশুভ বলে ধরা হয়। এই দিকটিকে পূর্বপুরুষদের দিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়, আর তুলসী গাছ দেবতার প্রতীক। তাই দক্ষিণ দিকে তুলসী গাছ রাখলে পারিবারিক সমৃদ্ধির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে এবং আর্থিক সংকট দেখা দিতে পারে। তুলসী গাছ উত্তর বা পূর্ব দিকে লাগানো সবচেয়ে শুভ বলে মনে করা হয়, কারণ এটি ইতিবাচক শক্তি আনতে সহায়ক।
কলা গাছ হিন্দু ধর্মে অত্যন্ত শুভ এবং পবিত্র বলে মনে করা হয়। বিষ্ণু দেবের প্রিয় গাছগুলোর মধ্যে কলা অন্যতম। বাস্তু শাস্ত্র মতে, কলা গাছ বাড়ির পশ্চিম বা দক্ষিণ দিকে লাগানো উচিত নয়, কারণ এটি বাস্তু দোষ সৃষ্টি করতে পারে। তবে বাড়ির ঈশান কোণে অর্থাৎ উত্তর-পূর্ব দিকে কলা গাছ লাগানো সর্বাধিক শুভ। এটি কেবলমাত্র বাস্তু দোষ দূর করে না, বরং পরিবারের সুখ-সমৃদ্ধিও বৃদ্ধি করে। কলা গাছ নিয়মিত পূজা করলে বিষ্ণু দেবের আশীর্বাদ পাওয়া যায় এবং সংসারে শান্তি বজায় থাকে। বৃহস্পতিবার কলা গাছের পূজা করা বিশেষভাবে শুভফলদায়ক বলে মনে করা হয়।
মানি প্ল্যান্ট হলো সৌভাগ্যের প্রতীক এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সাথে সম্পর্কিত একটি উদ্ভিদ। আধুনিক যুগে প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই এই গাছ দেখা যায়, কারণ এটি সহজেই জন্মায় এবং বিশেষ যত্ন ছাড়াই বেঁচে থাকে। বাস্তু শাস্ত্র অনুসারে, বাড়িতে মানি প্ল্যান্ট রাখা শুভ হলেও, এটি কোথায় রাখা হচ্ছে সেটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভুল দিক মানি প্ল্যান্ট রাখলে পরিবারের আর্থিক অবস্থার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। বাস্তু মতে, মানি প্ল্যান্ট দক্ষিণ দিকে রাখা একেবারেই উচিত নয়, কারণ এটি অর্থনৈতিক ক্ষতি আনতে পারে এবং পরিবারে আর্থিক অনটন তৈরি করতে পারে। উত্তর বা পূর্ব দিকে এই গাছ রাখা সবচেয়ে শুভ বলে মনে করা হয়, কারণ এটি বাড়ির ইতিবাচক শক্তিকে বৃদ্ধি করে এবং অর্থ প্রবাহ নিশ্চিত করে।
গাছপালা শুধু আমাদের জীবনযাত্রাকে সবুজ ও শীতল করে না, বরং সঠিক দিকের গাছপালা আমাদের জীবনে সৌভাগ্য, সুখ-শান্তি এবং সমৃদ্ধি নিয়ে আসতে পারে। বাস্তু শাস্ত্র অনুযায়ী সঠিক স্থানে সঠিক গাছ রোপণ করলে জীবনের নানা বাধাবিপত্তি দূর হতে পারে এবং শুভ শক্তির প্রবাহ বৃদ্ধি পায়। তাই শুধুমাত্র সৌন্দর্যের জন্য নয়, বরং গাছপালার বাস্তুমত বিশ্লেষণ করে সঠিক স্থানে গাছ লাগানো উচিত। এটি কেবলমাত্র ধর্মীয় দিক থেকেই নয়, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকেও গুরুত্বপূর্ণ, কারণ নির্দিষ্ট দিক অনুযায়ী গাছপালার উপস্থিতি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে এবং আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।