১৯৮০ সালে পরিচালক তরুণ মজুমদারের হাত ধরে তাপস পালের প্রথম সিনেমায় অভিনয়। ছবির নাম ছিল “দাদার কীর্তি”।
তাপস পাল ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্র জগতের এক অতি জনপ্রিয় ও প্রতিভাবান অভিনেতা। তাঁর অভিষেকের কাহিনীও ছিল একেবারে সিনেমার মতো। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হয়েও তিনি ছোটবেলা থেকেই অভিনয়ের প্রতি আগ্রহী ছিলেন। পড়াশোনা করেছেন কৃষ্ণনগরের বিদ্যানগর কলেজে, জীববিদ্যা নিয়ে। কিন্তু ভাগ্য তাঁকে টেনে নিয়ে যায় অভিনয়ের জগতে।
১৯৮০ সালে পরিচালক তরুণ মজুমদারের হাত ধরে তাপস পালের প্রথম সিনেমায় অভিনয়। ছবির নাম ছিল “দাদার কীর্তি”। এই ছবিতেই তিনি নায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ছবিটি মুক্তি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাপস পাল রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তাঁর অভিনীত “কৃষ্ণনগরের সরল, ভদ্র যুবক অঙ্কুর” চরিত্র দর্শকের মনে দাগ কেটে যায়।
“দাদার কীর্তি” ছবিটি বাণিজ্যিকভাবে ভীষণ সফল হয় এবং এর পর থেকেই তাঁকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর এক ছবিতে তিনি নায়ক চরিত্রে সুযোগ পেতে থাকেন। নব্বইয়ের দশকে এসে তিনি প্রায় বাংলা সিনেমার সুপারস্টার হয়ে উঠেছিলেন।
অভিষেকের পর তাঁর ক্যারিয়ার যেভাবে এগিয়েছিল, তা বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক বিশেষ অধ্যায়। সরল, ভদ্র, গ্রামের ছেলে কিংবা প্রেমে পড়া তরুণ— এই ধরনের চরিত্রে তিনি ছিলেন অনন্য। এর ফলেই তিনি খুব দ্রুতই দর্শকদের হৃদয়ে জায়গা করে নেন।
তাপস পালের সিনেমায় অভিষেককে যদি বিশ্লেষণ করা হয়, তাহলে বোঝা যায় যে এটি শুধু একজন অভিনেতার যাত্রার শুরু নয়, বাংলা চলচ্চিত্রে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা ছিল। আশির দশকে বাংলা সিনেমা একধরনের পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। সেই সময় উত্তমকুমার সদ্য প্রয়াত, আর সুপারস্টারের শূন্যতা পূরণ করার জন্য দর্শক অপেক্ষায় ছিল। ঠিক তখনই তাপস পালের আবির্ভাব ঘটে, আর দর্শক তাঁকে নিজেদের ঘরের ছেলের মতো গ্রহণ করে নেয়।
তরুণ মজুমদারের দাদার কীর্তি ছবিতে তাপস পাল ছিলেন অত্যন্ত সহজ-সরল এক যুবক, যিনি কলকাতা থেকে গ্রামে আসেন পড়াশোনা করতে। তাঁর ভদ্রতা, সরলতা এবং নিরীহ প্রেমিক চরিত্র এতটাই বাস্তব মনে হয়েছিল যে দর্শকরা যেন নিজেদের জীবনের কারও সঙ্গে তাঁর মিল খুঁজে পেয়েছিলেন। এই ছবির গান এবং চিত্রনাট্যও দর্শকদের মন কেড়ে নিয়েছিল, তবে মূল আকর্ষণ ছিলেন নতুন নায়ক তাপস পাল।

এই ছবির সাফল্যের পরই প্রযোজক-পরিচালকরা তাঁকে নিয়ে একের পর এক ছবি বানাতে শুরু করেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি হয়ে ওঠেন পারিবারিক ও রোমান্টিক ছবির প্রথম পছন্দ। নায়িকা মহল থেকেও তাঁর সঙ্গে জুটি গড়ার প্রবল আগ্রহ দেখা যায়। মহুয়া রায়চৌধুরী, দেবশ্রী রায়, শতাব্দী রায়দের সঙ্গে তাঁর রোমান্টিক জুটি একের পর এক হিট ছবি উপহার দেয়।
তাঁর অভিনয়ের ধরণ ছিল অত্যন্ত প্রাকৃতিক। তিনি কোনও অতিরিক্ত মেকআপ বা ভঙ্গি ছাড়াই সাধারণ মানুষের চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে পারতেন। ফলে গ্রামীণ দর্শক থেকে শুরু করে শহুরে বুদ্ধিজীবী—সবাই তাঁকে সমানভাবে আপন করে নিয়েছিল। আশির ও নব্বইয়ের দশকে তিনি প্রায় পরিবারের সদস্যের মতো প্রতিটি বাঙালি দর্শকের ঘরে পৌঁছে গিয়েছিলেন তাঁর অভিনীত চরিত্রগুলোর মাধ্যমে।
তাপস পালের সিনেমায় প্রবেশকে আরও বিশেষ করে তুলেছিল তাঁর অল্প বয়সে এত বড় সাফল্য অর্জন। খুব অল্প সময়ের মধ্যে তিনি জাতীয় স্তরেও স্বীকৃতি পান। সাহেব ছবিতে তাঁর অভিনয় তাঁকে জাতীয় পুরস্কারের মনোনয়ন এনে দেয়। এতে স্পষ্ট হয়ে যায় যে তিনি শুধু বাণিজ্যিক অভিনেতা নন, বরং গুণী অভিনেতার পর্যায়েও পৌঁছে গেছেন।
বাংলা চলচ্চিত্রে তাপস পালের অভিষেক এক নতুন নায়ককে জন্ম দিয়েছিল, যিনি ছিলেন সাদামাটা কিন্তু হৃদয়স্পর্শী। তাঁর যাত্রার শুরুটা যে কতটা শক্তিশালী ছিল, তা তাঁর দীর্ঘ ক্যারিয়ারের সাফল্যই প্রমাণ করে। দর্শক তাঁকে শুধু একজন অভিনেতা হিসেবে নয়, তাঁদের আবেগের অংশ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। সেই কারণেই আজও তাঁর প্রথম ছবির কথা উঠলেই ভক্তদের চোখে nostalgia ভেসে ওঠে।
তবে তাপস পালকে নিয়ে বিতর্ক বরাবরই ছিল। আজ থেকে অনেক বছর আগে, ২০১৪ সালে, কেন্দ্রীয় সরকারের নির্বাচনের কিছুদিন আগে একটি নির্বাচনী প্রচার সভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে মহা বিতর্কে জড়িয়ে পড়লেন তাপস পাল। সূত্রের খবর, উক্ত সভায় তাপস পাল নিজেকে নিয়ে বলেন, “চন্দননগরের মাল”। হ্যাঁ, এই বলেই তিনি পরিচয় দেন এবং জানান যে তিনি পকেটে “মাল” নিয়ে ঘুরে বেড়ান। এছাড়া তিনি ছেলে পাঠিয়ে বিরোধী পক্ষের সমর্থকদের অত্যাচার করার ইচ্ছাও প্রকাশ করেন। পরে এই নিয়ে বিতর্ক তৈরী হলে তিনি প্রকাশ্যে ক্ষমা চান। এরপর, ২০১৬ সালের শেষ ভাগে তাপস পাল আবার সংবাদ শিরোনামে আসেন। রোজ ভ্যালি নামে একটি চিট ফান্ডের সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। এবং তার হাজতবাস হয়। এই সময়ে তাকে একটি পরচুলাও পরতে দেখা যায়।