Rohit Sharma Captaincy: শুভমন গিল পেলেন নেতৃত্ব, রোহিত শর্মার যুগের ইতি ভারতীয় ওয়ানডে ক্রিকেটে

Spread the love

ভারতীয় ক্রিকেটে শুরু হচ্ছে এক নতুন অধ্যায়। অস্ট্রেলিয়া সফরের আগে বড় ঘোষণা করেছে বিসিসিআই—ভারতের নতুন ওয়ানডে অধিনায়ক হচ্ছেন শুভমন গিল। দীর্ঘদিন ভারতের ওয়ানডে দলের নেতৃত্বে থাকা রোহিত শর্মাকে সরিয়ে এই তরুণ ব্যাটারকে দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচক কমিটি। এই পরিবর্তন কেবল নেতৃত্বের নয়, এটি ভারতের ভবিষ্যৎ ক্রিকেট পরিকল্পনার প্রতিফলনও বটে।


রোহিত শর্মা: এক যুগের সফল সমাপ্তি

২০১৯ সালের মে মাসে, ওডিআই বিশ্বকাপের আগে লন্ডনে যাওয়ার সময় রোহিত শর্মা তাঁর “চূড়ান্ত স্বপ্ন” নিয়ে কথা বলেছিলেন—একদিন আইসিসি ট্রফি তুলে নেওয়া। ক্রিকবাজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “এটি এমন রূপকথার গল্প যা প্রতিটি তরুণ স্বপ্ন দেখে বড় হয়।”

রোহিতের সেই স্বপ্ন পূরণের খুব কাছাকাছি পৌঁছেও দু’বার হোঁচট খেতে হয়েছিল। ২০১৯ সালে রেকর্ড গড়া ব্যাটিং পারফরম্যান্স সত্ত্বেও ভারত সেমিফাইনালে হেরে যায়। চার বছর পরে, ঘরের মাঠে ২০২৩ বিশ্বকাপে ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে পরাজয় ছিল তাঁর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বেদনাদায়ক মুহূর্ত।

রোহিত শর্মা ভারতের ইতিহাসে অন্যতম সফল ওয়ানডে অধিনায়ক। তাঁর নেতৃত্বে ভারত ৫৬টি ম্যাচে জয় পেয়েছে ৪২টিতে, জয় শতাংশ প্রায় ৭৫%—যা ভারতের সর্বকালের সেরাদের মধ্যে অন্যতম। ২০২৪ সালে বার্বাডোসে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ের পর তিনি ভারতের নেতৃত্বে দ্বিতীয় আইসিসি ট্রফি জয় করেন—যা তাঁর অধিনায়কত্বের স্বর্ণ অধ্যায়।

কিন্তু সময়ের স্রোতে ক্রিকেটে নতুন পরিকল্পনা আসে। বিসিসিআই এবার দীর্ঘমেয়াদী ভাবনায় বিশ্বাস করে তরুণ নেতৃত্বে ভরসা রেখেছে। শুভমন গিল, যিনি টেস্ট ও একদিনের ক্রিকেটে ধারাবাহিক পারফরম্যান্সে নজর কেড়েছেন, এখন দেশের ভবিষ্যৎ হিসেবে বিবেচিত।


শুভমন গিলের হাতে নতুন দায়িত্ব

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজকে সামনে রেখে বোর্ড শনিবার ঘোষণা করে—ভারতের নতুন অধিনায়ক শুভমন গিল। ঘোষণার পর গিল বলেন, “ওয়ানডেতে ভারতকে নেতৃত্ব দেওয়া আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সম্মান। আমি চাই দেশকে গর্বিত করতে এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত ২০২৭ বিশ্বকাপের আগে দলকে সম্পূর্ণ প্রস্তুত রাখতে।”

তিনি আরও যোগ করেন, “আমাদের হাতে প্রায় ২০টি ওয়ানডে ম্যাচ আছে। এই সময়েই আমরা দল তৈরি করব, পরিকল্পনা চূড়ান্ত করব এবং প্রতিটি খেলোয়াড়কে আত্মবিশ্বাসী করব। আমি আশা করি আমরা বিশ্বকাপের আগে পুরোপুরি প্রস্তুত থাকতে পারব।”

২৫ বছর বয়সেই এই দায়িত্ব পাওয়া শুভমন গিলের জন্য এটি বিশাল এক মাইলফলক। একদিকে এটি সম্মানের, অন্যদিকে এটি তাঁর নেতৃত্বগুণ প্রমাণের প্রথম বড় সুযোগ।


অজিত আগরকরের ব্যাখ্যা: কেন এখন এই সিদ্ধান্ত

প্রধান নির্বাচক অজিত আগরকর স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন—এই পরিবর্তনটি শুধুমাত্র বর্তমান পারফরম্যান্সের উপর ভিত্তি করে নয়, বরং ভবিষ্যতের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য জরুরি ছিল। তাঁর কথায়, “এখনই হোক বা ছয় মাস পরে, এই সিদ্ধান্তটা নেওয়া অনিবার্য ছিল। ওয়ানডে ক্রিকেট এখন আগের মতো ঘন ঘন হয় না, তাই তরুণ অধিনায়ককে যথেষ্ট সময় দিতে চেয়েছি যাতে সে নিজের জায়গা তৈরি করতে পারে।”

তিনি আরও বলেন, “তিন ফরম্যাটে তিনজন আলাদা অধিনায়ক রাখলে দলের স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়। কোচের জন্যও সমস্যা হয়। তাই টেস্ট ও টি-টোয়েন্টির মতো ওয়ানডেতেও নেতৃত্ব একত্রিত করাই যুক্তিযুক্ত।”

যদিও আগরকর গৌতম গম্ভীরের নাম সরাসরি উচ্চারণ করেননি, তবে স্পষ্ট যে নতুন কোচের পরামর্শেই এই সিদ্ধান্ত এসেছে। গম্ভীর সবসময়ই “এক নেতা, এক দিশা” নীতিতে বিশ্বাসী—যেখানে দলের ঐক্যই সাফল্যের মূলমন্ত্র।

রোহিতের প্রতিক্রিয়া ও বিসিসিআইয়ের অবস্থান

রোহিত শর্মাকে হঠাৎ করেই সরানো হয়নি। আগরকর জানিয়েছেন, সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে রোহিতের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলা হয়েছে। রোহিত এই সিদ্ধান্তকে পরিপক্বতার সঙ্গে গ্রহণ করেছেন এবং দলের ভবিষ্যতের জন্য শুভমনকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।

বিসিসিআই সূত্র জানায়, রোহিতকে পুরো বিষয়টি জানানো হয় এবং তিনি নিজেও বুঝেছিলেন যে ভারতের ক্রিকেট এখন পরবর্তী প্রজন্মের দিকে এগোচ্ছে। তাঁর অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতেও দলের পরামর্শদাতা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।


কোহলি-রোহিত কি তবে শেষ অধ্যায়ে?

এই পরিবর্তনের পরই প্রশ্ন উঠেছে—কোহলি ও রোহিত কি আর ২০২৭ বিশ্বকাপে খেলবেন না? অজিত আগরকর সেই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেননি, তবে বলেছেন, “দু’জনেই ফিটনেস টেস্টে পাশ করেছে। তবে আমরা এখন দলের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবছি, তাই নিশ্চিত কিছু বলা সম্ভব নয়।”

ক্রিকেট বিশ্লেষকদের মতে, এই সিদ্ধান্ত এক ধরনের ট্রানজিশন—যেখানে রোহিত ও কোহলির অভিজ্ঞতা তরুণ নেতৃত্বের পেছনে শক্ত ভিত্তি হয়ে থাকবে, কিন্তু মূল নেতৃত্বের দায়িত্ব ধীরে ধীরে তরুণদের হাতে যাবে।


রোহিতের উত্তরাধিকার: গিলের প্রেরণা

রোহিত শর্মার নেতৃত্বের এক বড় গুণ ছিল তাঁর ঠান্ডা মাথা এবং দলের প্রতি বিশ্বাস। এই জায়গায় গিলেরও সেই ধৈর্য ও সংযম প্রয়োজন হবে। গিল নিজেও বলেছেন, রোহিত তাঁর কাছে এক বিশাল অনুপ্রেরণা।

তিনি বলেন, “রোহিত ভাই আমাকে সবসময় বলেছেন, দলকে আগে ভাবো। নিজের ইনিংসের থেকেও দলের প্রয়োজন বড়। আমি তাঁর নেতৃত্বে অনেক কিছু শিখেছি।”

তরুণ এই ব্যাটার জানেন, নেতৃত্ব মানে শুধু কৌশল নয়, বরং সতীর্থদের আস্থা অর্জন করা। সেটাই হবে তাঁর সবচেয়ে বড় পরীক্ষা।


রোহিতের পরিসংখ্যান ও উত্তরাধিকার

রোহিত শর্মা ভারতের ইতিহাসে অন্যতম সফল অধিনায়ক। তাঁর অধিনায়কত্বে ভারত ৫৬টি ম্যাচে ৪২টিতে জয় পেয়েছে—যা প্রায় ৭৫% জয়ের হার। তাঁর নেতৃত্বেই ভারত জিতেছে ২০২৪ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি এবং এর আগেই ২০২৪ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ।

তবে আগরকর ও গম্ভীর দু’জনেই মনে করেন, “অর্জন যতই বড় হোক, সময়ের সঙ্গে ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে হয়।” সেই যুক্তিতে এখন ভারতের ফোকাস আগামী প্রজন্মের হাতে নেতৃত্ব তুলে দেওয়া।


জাডেজা, বুমরাহ, সিরাজ প্রসঙ্গ

দল ঘোষণার সময় আরেকটি প্রশ্ন উঠেছিল—কেন রবীন্দ্র জাডেজা নেই? আগরকর ব্যাখ্যা দিয়েছেন, “অস্ট্রেলিয়ার কন্ডিশনে দু’জন বাঁহাতি স্পিনার নেওয়া যুক্তিসঙ্গত নয়। কুলদীপ যাদব ও ওয়াশিংটন সুন্দরকে সুযোগ দেওয়া হয়েছে। জাডেজাকে বিশ্রাম দেওয়া হয়েছে, বাদ দেওয়া হয়নি।”

একইভাবে বুমরাহ ও সিরাজকেও আলাদা সিরিজে বিশ্রাম দেওয়া হবে বলে জানান তিনি। এর কারণ, “দীর্ঘমেয়াদে ক্রিকেটারদের ফিটনেস বজায় রাখা।”


আগামী দিনের পথচলা

শুভমন গিলের সামনে এখন এক কঠিন কিন্তু সোনালী সুযোগ—দল গঠন, পরিকল্পনা নির্ধারণ এবং নেতৃত্বে পরিণতি দেখানো। রোহিতের মতো সিনিয়রদের পরামর্শ কাজে লাগাতে পারলে তাঁর পথ অনেক সহজ হবে।

অস্ট্রেলিয়া সিরিজই হবে গিলের প্রথম বড় চ্যালেঞ্জ। তাঁর নেতৃত্বের সাফল্যই ঠিক করে দেবে ভারতীয় ক্রিকেটের পরবর্তী অধ্যায় কতটা উজ্জ্বল হতে চলেছে।

ভারতীয় ক্রিকেটে রোহিত শর্মার অধ্যায় নিঃসন্দেহে এক গৌরবময় ইতিহাস। শান্ত, স্থির, কৌশলগত এবং অদম্য মানসিক শক্তির অধিকারী এই ক্রিকেটার দীর্ঘ এক দশক ধরে ভারতীয় দলে নেতৃত্ব দিয়েছেন অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গে। তাঁর অধিনায়কত্বে ভারত জিতেছে একাধিক বড় টুর্নামেন্ট, ধারাবাহিক সিরিজ জয় এবং আইসিসি ট্রফি—যা তাকে ভারতের অন্যতম সফল অধিনায়কের মর্যাদা দিয়েছে। তবে সময়ের সঙ্গে পরিবর্তন অনিবার্য। রোহিত নিজেও জানতেন, প্রতিটি নেতার যাত্রার একটি সীমা থাকে। এবার সেই নেতৃত্বের মশাল তুলে দেওয়া হয়েছে ভারতের নতুন প্রজন্মের হাতে—শুভমন গিলের কাঁধে।

শুভমন গিলের নেতৃত্বের সূচনা মানে কেবল অধিনায়ক বদল নয়, বরং ভারতীয় ক্রিকেটে এক নতুন যুগের শুরু। রোহিতের মতো অভিজ্ঞ নেতার ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে নিজের কৌশল, চিন্তাভাবনা ও সাহসী সিদ্ধান্তের মাধ্যমে গিলকে নিজের পরিচয় তৈরি করতে হবে। তাঁকে শুধু ম্যাচ জেতানো নয়, দলের সংস্কৃতি গড়ে তোলা এবং তরুণ ক্রিকেটারদের আত্মবিশ্বাস জোগানো—এই তিন দিকেই নেতৃত্ব দিতে হবে। গিল নিজেই বলেছিলেন, “আমাদের সামনে ২০টা ম্যাচ আছে, এখান থেকেই শুরু হবে প্রস্তুতির আসল পরীক্ষা।” এই কথার মধ্যেই ফুটে উঠেছে তাঁর নেতৃত্বের মানসিকতা—পরিকল্পনা, ধৈর্য এবং দূরদর্শিতা।

রোহিত শর্মার “চূড়ান্ত স্বপ্ন” ছিল ভারতের হাতে আরেকটি আইসিসি ট্রফি তোলা। সেই স্বপ্ন হয়তো তাঁর হাতে অসম্পূর্ণ রয়ে গেল, কিন্তু সেটিই এখন গিলের লক্ষ্য। ভারতীয় দলের নতুন অধ্যায়ের প্রথম পাতায় লেখা হচ্ছে সেই স্বপ্নপূরণের প্রতিশ্রুতি। কোচ গৌতম গম্ভীর ও নির্বাচক কমিটি পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে—এই সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র বর্তমান পারফরম্যান্স নয়, বরং আগামী দশকের পরিকল্পনা।

রোহিত শর্মার অভিজ্ঞতা এবং গিলের উদ্যম—এই দুই প্রজন্মের সংমিশ্রণই এখন ভারতীয় দলের শক্তি। গিল যদি রোহিতের মতো ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, কোহলির মতো আগ্রাসন দেখাতে পারেন এবং নিজের ছন্দে দলকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন, তাহলে ২০২৭ সালের বিশ্বকাপের আগে ভারতীয় ক্রিকেট এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে।

ইতিহাস বলছে, প্রতিটি মহান দলের জন্ম হয় যখন পুরনো প্রজন্ম নতুন প্রজন্মকে স্থান দেয়। রোহিত শর্মা সেই দায়িত্ব কাঁধে তুলে দিয়েছেন পরবর্তী প্রজন্মের কাছে। এখন সময় শুভমন গিলের—ভারতীয় ক্রিকেটের আগামী যুগের নেতা হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করার। হয়তো রোহিতের অসম্পূর্ণ গল্পের শেষ লাইনটা লিখবেন গিলই—দক্ষিণ আফ্রিকার আকাশে ভারতীয় পতাকা উড়িয়ে।

]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *