আত্মসমপর্ণের পরে পাকিস্তানের জেনারেলের কি অবস্থা হয়েছিল, জানলে চমকে উঠবেন!

Spread the love

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পাকিস্তানি বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করেন। এই আত্মসমর্পণের মাধ্যমে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের অবসান ঘটে এবং বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে।

যুদ্ধ চলাকালীন নিয়াজী পাকিস্তানি বাহিনীর অন্যতম প্রধান সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন এবং তাঁর অধীনে পরিচালিত বাহিনী বাঙালিদের ওপর গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাটসহ নানা ধরনের বর্বরতা চালায়। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী তাকে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অভিযানের দায়িত্ব দিলেও তিনি প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হন এবং ভারত ও মুক্তিবাহিনীর যৌথ অভিযানের মুখে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন।

আত্মসমর্পণের পর নিয়াজীকে ভারতীয় বাহিনীর হেফাজতে নেওয়া হয় এবং পরে পাকিস্তানে ফেরত পাঠানো হয়। পাকিস্তানে ফিরে তিনি চরম অপমান ও অবজ্ঞার সম্মুখীন হন। তাকে বিশ্বাসঘাতক ও পরাজিত সেনাপতি হিসেবে দেখা হতো। জনগণ ও সামরিক বাহিনীর একাংশ তাকে ঘৃণা করত, কারণ তিনি পাকিস্তানের এক বিশাল অংশ হারানোর দায় বহন করছিলেন। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো তাকে সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত করেন এবং পাকিস্তানের সামরিক ইতিহাসে তিনি এক লজ্জাজনক অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হন। নিজের দেশের মানুষের কাছেও তিনি অগ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেন এবং বাকি জীবন অবহেলা ও অপমানের মধ্যে কাটান।

জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজীর আত্মসমর্পণের পর পাকিস্তানে তার অবস্থান ছিল অত্যন্ত দুর্দশাপূর্ণ। ১৯৭২ সালে ভারত সরকার সিমলা চুক্তির মাধ্যমে নিয়াজীসহ ৯৩ হাজার যুদ্ধবন্দিকে পাকিস্তানে ফেরত পাঠায়। তবে দেশে ফিরে তিনি কোনো সম্মান বা সহানুভূতি পাননি, বরং তাকে বিশ্বাসঘাতক ও অপমানিত পরাজিত সেনাপতি হিসেবে দেখা হতো।

পাকিস্তানের সাধারণ জনগণ এবং সামরিক বাহিনীর অনেকেই তাকে ‘অযোগ্য’ ও ‘কাপুরুষ’ হিসেবে বিবেচনা করত। তাকে দোষারোপ করা হতো যে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) স্বাধীনতা যুদ্ধ দমনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন এবং পাকিস্তানের এক বিশাল অংশকে হারানোর কারণ হয়েছেন। এমনকি তার সামরিক সহকর্মীরাও তার সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখতেন।

পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো ক্ষমতায় এসে নিয়াজীকে সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত করেন এবং সামরিক ইতিহাসে কলঙ্কিত অধ্যায় হিসেবে তার ভূমিকা তুলে ধরা হয়। ১৯৭৪ সালে হামুদুর রহমান কমিশনের রিপোর্টে তাকে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক ব্যর্থতার জন্য অন্যতম প্রধান দায়ী ব্যক্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয়। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অযোগ্যতা, নারীদের প্রতি অনৈতিক আচরণ এবং যুদ্ধকালীন নিষ্ঠুরতার অভিযোগও আনা হয়।

এই অপমানজনক জীবনযাপনের কারণে নিয়াজী ধীরে ধীরে জনসমক্ষে এক ঘৃণিত চরিত্র হয়ে ওঠেন। পাকিস্তানে তিনি একাকী জীবন কাটান এবং ২০০৪ সালে নিঃসঙ্গ অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি তার সম্মান পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করলেও, পাকিস্তানের ইতিহাসে তিনি একজন ব্যর্থ ও বিতর্কিত সামরিক কর্মকর্তা হিসেবেই রয়ে যান।

লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজী, যিনি একে নিয়াজী নামে পরিচিত, ছিলেন ১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ডার। ১৯৭৫ সালের এপ্রিলে ভারতীয় সেনাবাহিনী তাকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করে, যা ছিল সেই সময়ের শেষ যুদ্ধবন্দির আনুষ্ঠানিক প্রত্যাবর্তন। লাহোরের ওয়াঘা পোস্টে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাকে পাকিস্তানের কাছে হস্তান্তর করে, যেখানে উপস্থিত ছিলেন তার ভাতিজা শের আফগান খান নিয়াজী। সেই সময় শের আফগান পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদানের জন্য এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ব্রিগেডিয়ার পদ পর্যন্ত উত্তীর্ণ হয়ে অবসর গ্রহণ করেন।

শের আফগান জানান, যখন জেনারেল নিয়াজীকে পাকিস্তানে ফিরিয়ে আনা হয়, তখন পরিবারের কেউই তার সঙ্গে দেখা করার বা কথা বলার অনুমতি পাননি। তাকে লাহোর ক্যান্টনমেন্টের কর্পস হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যাওয়া হয়, যা জিন্নাহ হাউজ নামে পরিচিত ছিল। সেখানে তাকে দীর্ঘ সময় ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এর পর তিনি সড়কপথে তার নিজ শহর মিয়ানওয়ালীতে যান, যেখানে পুরো নিয়াজী গোষ্ঠীর মানুষ তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান। এই সংবর্ধনার ঘটনাটি স্থানীয় লোককথার অংশ হয়ে গেছে বলে উল্লেখ করেন শের আফগান।

১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারিতে জেনারেল নিয়াজীর পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে শের আফগান খান নিয়াজী জানান, তার বাবা তখন লাহোরের একটি ডিভিশনের কমান্ডার ছিলেন। একদিন জেনারেল নিয়াজীর স্টাফ অফিসার তার বাবাকে ফোন করে দেখা করতে বলেন। এরপর লাহোরে গিয়ে তারা জানতে পারেন, জেনারেল নিয়াজীকে পূর্ব পাকিস্তানের কমান্ডিং অফিসার হিসেবে পাঠানো হচ্ছে। সেই সন্ধ্যায় তার প্রস্থানের আগে সেটাই ছিল পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তার শেষ সাক্ষাৎ। বিদায়ের সময় তিনি পরিবারের সদস্যদের তার জন্য দোয়া করতে বলেন।

সেনাবাহিনীর ইন্টার সার্ভিসেস পাবলিক রিলেশন্সের (আইএসপিআর) তখনকার প্রধান ব্রিগেডিয়ার এ আর সিদ্দিকী ২০০৪ সালে এক প্রবন্ধে লিখেছিলেন, সাহসিকতার জন্য পরিচিত জেনারেল নিয়াজী পূর্ব পাকিস্তানে পোস্টিং গ্রহণ করেছিলেন, যখন অন্য কয়েকজন সিনিয়র জেনারেল সেই দায়িত্ব নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। তবে, পূর্ব পাকিস্তানে যাওয়ার পর থেকেই তার সিদ্ধান্ত গ্রহণের ধরন নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। সেনাবাহিনীর অন্যান্য শাখার কর্মকর্তাদের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন তৈরি হয়। বিশেষ করে তার পূর্বসূরি জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে মতপার্থক্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

শের আফগান নিয়াজী বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষার জন্য বিভিন্ন কৌশল নিয়ে নিয়াজী আলোচনা করতেন এবং স্থানীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি বিকেন্দ্রীভূত সামরিক প্রতিরক্ষার পক্ষে ছিলেন, যা পূর্ব পাকিস্তানে কার্যকর করা হয়েছিল। তবে যুদ্ধের বাস্তবতায় তা ব্যর্থ হয়। তার পরিকল্পনার যথার্থতা নিয়ে অনেক বিতর্ক থাকলেও তিনি বিশ্বাস করতেন, রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বের ভুল সিদ্ধান্তের কারণেই পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পরাজিত হয়।

পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি হামুদুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিশন ১৯৭১ সালের যুদ্ধ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে জেনারেল নিয়াজীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও নৈতিক স্খলনের অভিযোগ আনা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, তিনি দায়িত্ব পালনের সময় নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিলেন এবং সেনাবাহিনীর আদেশ লঙ্ঘন করেছেন। যদিও তিনি এই অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করেছেন। তার মতে, পাকিস্তানের সামরিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতাই পরাজয়ের প্রধান কারণ।

শের আফগান বলেন, পাকিস্তানের সেনাবাহিনীতে নিয়াজীর আত্মসমর্পণ নিয়ে বিতর্ক চললেও তার পরিবার তাকে সম্মানের চোখে দেখে। তাদের বিশ্বাস, তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের নিরাপত্তার স্বার্থে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। জেনারেল ইয়াহিয়া খান তাকে বলেছিলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এই কারণেই তিনি যুদ্ধ শেষ করার সিদ্ধান্ত নেন। তবে পাকিস্তানের অনেক মহল তাকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করে।

জেনারেল নিয়াজী বন্দি অবস্থায় চার বছর কাটান এবং ১৯৭৫ সালে মুক্তি পান। তবে তার সেনা জীবনে আর ফিরে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। মুক্তির পর তিনি তার শহরে ফিরে যান এবং অবসর জীবন যাপন করেন। তার পরবর্তী প্রজন্মও সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিল। তিনি ‘দ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান’ নামে একটি বই লেখেন, যেখানে তিনি ১৯৭১ সালের যুদ্ধের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। এই বইয়ে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দুর্বলতা ও রাজনৈতিক নেতাদের ভুল সিদ্ধান্তকে দায়ী করেন।

শের আফগান জানান, তার চাচা জেনারেল নিয়াজী তার পরিবারের কাছে অত্যন্ত স্নেহশীল ছিলেন। বন্দি অবস্থায় থাকার পরও তার ব্যক্তিত্বে কোনো পরিবর্তন আসেনি। তিনি সবসময় সামরিক ইতিহাস ও কৌশল নিয়ে পড়াশোনা করতেন। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সামরিক বিষয় নিয়ে আলোচনায় মগ্ন থাকতেন।

২০০৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি লাহোরে জেনারেল নিয়াজী মৃত্যুবরণ করেন। পাকিস্তানের সামরিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। জীবনের শেষ সময়ে তিনি নিভৃতে সময় কাটান এবং তার অতীত নিয়ে ভাবতেন। সেনাবাহিনীতে তার ভূমিকা ও ১৯৭১ সালের যুদ্ধ নিয়ে বিতর্ক আজও চলছে, তবে তার পরিবার ও অনুসারীরা তাকে একজন দেশপ্রেমিক ও সাহসী সেনানায়ক হিসেবে স্মরণ করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *