নোবেল শান্তি পুরস্কার বিশ্বে এতটা জনপ্রিয় কেন? পেছনের ইতিহাসটা জানেন কী?

Spread the love

নোবেল শান্তি পুরস্কার হল বিশ্বের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ এবং সম্মানজনক পুরস্কার, যা মানবজাতির মধ্যে শান্তি, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারীদের প্রদান করা হয়। এটি শুধুমাত্র সামরিক বিরোধ ও যুদ্ধের অবসান ঘটানোর প্রচেষ্টাকেই স্বীকৃতি দেয় না, বরং সামাজিক ন্যায়বিচার, মানবাধিকার, শিক্ষা ও দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রেও অসামান্য অবদান রাখা ব্যক্তিদেরও সম্মানিত করে।

এই পুরস্কারের প্রবর্তন ও পরিচালনার পেছনে রয়েছেন সুইডিশ বিজ্ঞানী, উদ্ভাবক এবং শিল্পপতি আলফ্রেড নোবেল। তিনি ছিলেন ডিনামাইট আবিষ্কারক, যার ফলে তার বিশাল পরিমাণ সম্পদ অর্জিত হয়। তবে, জীবনের শেষ দিকে তিনি উপলব্ধি করেন যে তার আবিষ্কার ধ্বংসাত্মক কাজে ব্যবহৃত হতে পারে, এবং সেই অনুশোচনার ফলস্বরূপ তিনি তার সমগ্র সম্পত্তি মানবতার কল্যাণে দান করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।

১৮৯৬ সালে তার মৃত্যুর পর তার উইল মোতাবেক একটি তহবিল গঠন করা হয়, যার মাধ্যমে পাঁচটি পৃথক ক্ষেত্রে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়। এই ক্ষেত্রগুলো হল: পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, চিকিৎসাবিজ্ঞান বা শারীরবিদ্যা, সাহিত্য এবং শান্তি। শান্তি পুরস্কারটি বিশেষভাবে সেইসব ব্যক্তি বা সংস্থার জন্য নির্ধারিত, যারা জাতির মধ্যে ভ্রাতৃত্ব স্থাপন, অস্ত্রশস্ত্র হ্রাস, শান্তি সম্মেলনের প্রসার এবং বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অনন্য অবদান রেখেছেন।

নোবেল শান্তি পুরস্কার শুধুমাত্র একটি সম্মানজনক স্বীকৃতি নয়, বরং এটি মানবজাতির একতা, ন্যায়বিচার এবং সহানুভূতির প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এই পুরস্কার এক শক্তিশালী বার্তা বহন করে—যে শান্তি ও মানবিকতা সর্বোচ্চ মূল্যবান সম্পদ।

আলফ্রেড নোবেল একজন বিজ্ঞানী ও উদ্ভাবক ছিলেন, যার আবিষ্কারের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হল ডিনামাইট। তার ব্যবসা থেকে অর্জিত বিপুল সম্পদ তাকে বিশ্বের অন্যতম ধনী ব্যক্তিদের মধ্যে পরিণত করে। কিন্তু, জীবনের শেষ দিকে তিনি উপলব্ধি করেন যে তার আবিষ্কার মানবজাতির উপকারের চেয়ে ক্ষতির কারণ হতে পারে। এই উপলব্ধি থেকেই তার মনে একটি গভীর অনুশোচনা তৈরি হয় এবং মানবকল্যাণের জন্য কিছু করার সংকল্প করেন।

১৮৯৫ সালের ২৭ নভেম্বর তিনি তার উইল তৈরি করেন, যেখানে তিনি তার সমগ্র সম্পদের একটি বিশাল অংশ একটি তহবিল গঠনের জন্য বরাদ্দ করেন, যা থেকে প্রতি বছর পাঁচটি পৃথক ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখা ব্যক্তিদের পুরস্কৃত করা হবে। এই ক্ষেত্রগুলো হল পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, চিকিৎসাবিজ্ঞান বা শারীরবিদ্যা, সাহিত্য এবং শান্তি।

তার মৃত্যুর পর, ১৮৯৬ সালে, উইলে উল্লিখিত শর্তগুলো কার্যকর করার জন্য নানা ধরনের আইনি জটিলতা দেখা দেয়। নোবেলের পরিবারের কিছু সদস্য তার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন এবং তারা চান যে সম্পদ পরিবারের মধ্যেই থাকুক। কিন্তু, দীর্ঘ আলোচনার পর, ১৯০০ সালে সুইডেনে নোবেল ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই ফাউন্ডেশন নোবেল পুরস্কারের পরিচালনা ও অর্থ সংস্থানের দায়িত্ব গ্রহণ করে।

আলফ্রেড নোবেলের উইল মানবজাতির জন্য এক অনন্য দৃষ্টান্ত। তার সম্পদ কীভাবে ব্যবহৃত হবে তা নির্ধারণ করতে গিয়ে তিনি সম্পূর্ণরূপে মানবকল্যাণের কথা চিন্তা করেছিলেন। উইলটিতে তিনি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন যে, তার রেখে যাওয়া সম্পদ থেকে পাঁচটি পৃথক ক্ষেত্রে পুরস্কার প্রদান করা হবে। এই ক্ষেত্রগুলো হল‌ পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, চিকিৎসাবিজ্ঞান বা শারীরবিদ্যা, সাহিত্য, শান্তি
শান্তি পুরস্কারের ক্ষেত্রে তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন, এটি সেই ব্যক্তি বা সংগঠনের জন্য বরাদ্দ থাকবে যারা “জাতিগুলোর মধ্যে ভ্রাতৃত্ব স্থাপন, অস্ত্রশস্ত্রের হ্রাস, এবং শান্তি সম্মেলনের প্রসার ও উন্নতির জন্য সর্বোত্তম বা সর্বাধিক কাজ করেছেন।

উইলে তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, এই পুরস্কার সুইডেনের একাধিক সংস্থা এবং নরওয়ের এক নির্দিষ্ট সংস্থার মাধ্যমে পরিচালিত হবে। পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, চিকিৎসাবিজ্ঞান ও সাহিত্য পুরস্কার সুইডেনের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দ্বারা প্রদান করা হবে, কিন্তু শান্তি পুরস্কার নরওয়ের সংসদ কর্তৃক নির্বাচিত একটি কমিটি প্রদান করবে। এই সিদ্ধান্তের কারণ সম্পর্কে স্পষ্টভাবে কিছু বলা না থাকলেও অনেক গবেষকের মতে, আলফ্রেড নোবেল তার সময়ে নরওয়েকে শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন, যা তাকে এই দায়িত্ব নরওয়েকে প্রদান করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল।

আলফ্রেড নোবেল তার উইলে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছিলেন যে শান্তি পুরস্কারটি নরওয়ের পার্লামেন্ট (Storting) কর্তৃক নির্বাচিত পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি প্রদান করবে। ১৮৯৭ সালের এপ্রিল মাসে নরওয়ের সংসদ এই দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং একই বছরের আগস্ট মাসে নোবেল কমিটি গঠিত হয়। পরবর্তীতে এই কমিটি “নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি” নামে পরিচিতি লাভ করে।

নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি গঠনের পর থেকে এটি শান্তি পুরস্কারের যোগ্য ব্যক্তি বা সংস্থা নির্বাচন করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। কমিটির সদস্যরা সাধারণত নরওয়ের রাজনীতিবিদ, কূটনীতিক, শিক্ষাবিদ এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ থেকে মনোনীত হন।
বিশ্বজুড়ে শান্তি ও মানবাধিকারের ক্ষেত্রে অবদান রাখা ব্যক্তিদের মনোনয়ন গ্রহণ করা। মনোনীতদের মধ্যে বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করা। গোপন ভোটের মাধ্যমে বিজয়ী নির্ধারণ করা। নোবেল পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করা।

প্রতিবছর অসংখ্য ব্যক্তি ও সংস্থা শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন, এবং নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি কঠোর যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে চূড়ান্ত বিজয়ী নির্বাচন করে। এই কমিটি সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করে এবং তাদের সিদ্ধান্ত নরওয়ের সরকার বা অন্য কোনো সংস্থার দ্বারা প্রভাবিত হয় না।
নোবেলের উইল ঘোষণার পর তার পরিবারের কিছু সদস্য এর বিরোধিতা করেন, ফলে সুইডেনে দীর্ঘদিন আইনি লড়াই চলতে থাকে। উইলের আইনি বৈধতা নিয়ে বিতর্ক শুরু হলে সুইডেনের আদালতে একাধিক মামলা দায়ের করা হয়।

নোবেলের উইল বাস্তবায়নে জটিলতার মূল কারণ ছিল তার সম্পত্তির পরিমাণ এবং ব্যবস্থাপনার নিয়মাবলি। সুইডিশ সরকারও শুরুতে এ বিষয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল, কারণ এত বড় তহবিল পরিচালনার জন্য নির্দিষ্ট কাঠামোর প্রয়োজন ছিল।
আইনি লড়াই ও আলোচনার পর, ১৯০০ সালে সুইডেনে “নোবেল ফাউন্ডেশন” প্রতিষ্ঠিত হয়। এই ফাউন্ডেশনের মূল দায়িত্ব ছিল নোবেলের রেখে যাওয়া সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা করা এবং পুরস্কার প্রদানের পুরো প্রক্রিয়াটি তত্ত্বাবধান করা।

নোবেল ফাউন্ডেশনের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর মধ্যে ছিল তহবিলের বিনিয়োগ নিশ্চিত করা, যাতে তা দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকতে পারে।পুরস্কারের আর্থিক মূল্য নির্ধারণ করা ও তা সময়োপযোগী করা। পুরস্কার কমিটিগুলোর সঙ্গে সমন্বয় সাধন করা। নোবেল পুরস্কারের সুনাম ও নিরপেক্ষতা বজায় রাখা।
১৯০১ সালে প্রথমবারের মতো নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়। শান্তি পুরস্কার যৌথভাবে পান ফরাসি শান্তিবাদী ফ্রেডরিক প্যাসি এবং রেড ক্রসের প্রতিষ্ঠাতা সুইস মানবতাবাদী জাঁ অঁরি ডুনান।

ফ্রেডরিক প্যাসি ছিলেন একজন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ শান্তিবাদী, যিনি আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করেছেন। তিনি বিভিন্ন শান্তি সম্মেলনের আয়োজন করেন এবং যুদ্ধের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের জন্য অবিরাম প্রচেষ্টা চালান। অপরদিকে, জাঁ অঁরি ডুনান ছিলেন একজন মানবতাবাদী ও সমাজসেবক, যিনি যুদ্ধক্ষেত্রে আহত সৈন্যদের সেবার জন্য রেড ক্রস সংস্থার ভিত্তি স্থাপন করেন। তার প্রচেষ্টার ফলে যুদ্ধকালীন মানবাধিকার রক্ষার উদ্দেশ্যে জেনেভা কনভেনশন গৃহীত হয়। এই দুই ব্যক্তির অবদান মানবতার ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে এবং নোবেল শান্তি পুরস্কারের মাধ্যমে তাদের স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

নোবেল শান্তি পুরস্কার বিশ্ব শান্তির ক্ষেত্রে এক অনন্য স্বীকৃতি হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি শুধুমাত্র যুদ্ধবিরোধী প্রচেষ্টার জন্যই নয়, বরং মানবাধিকারের প্রসার, দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষার উন্নয়ন এবং বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টার জন্যও প্রদান করা হয়। এটি বিশ্বব্যাপী শান্তিপ্রিয় নেতাদের অনুপ্রেরণা জোগায় এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে উৎসাহিত করে।

নোবেল শান্তি পুরস্কার মানবতার মঙ্গলার্থে কাজ করা অসাধারণ ব্যক্তিদের স্বীকৃতি প্রদান করে। এটি বিশ্ববাসীর জন্য অনুপ্রেরণা এবং শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। আলফ্রেড নোবেলের দূরদর্শিতা ও তার রেখে যাওয়া ঐতিহ্য আজও বিশ্বব্যাপী মানবতার সেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *