সরস্বতী পুজোতে কী আপনিও গায়ে হলুদ মেখে স্নান করেছেন? কিন্ত কারণটা জানেন তো!

Spread the love

যতই ঠান্ডা লাগুক না কেন, বাটিতে সরষের তেল বা নারকেল তেলের সঙ্গে মেশানো হলুদ মেখে স্নান করা মাস্ট। এই নিয়মের পিছনে শুধু ধর্মীয় রীতি নয়, রয়েছে আরও এক কারণ। যার সঙ্গে যোগ রয়েছে সুস্থ থাকার।

বাঙালির জীবনে সরস্বতী পুজোর গুরুত্ব অপরিসীম। জ্ঞান ও বিদ্যার দেবী সরস্বতীর আরাধনায় এই দিনটিকে বিশেষভাবে পালন করা হয়। বই-খাতা পুজো দেওয়া, অঞ্জলি দেওয়া, নতুন পোশাক পরা— সবকিছুর সঙ্গেই জড়িয়ে আছে এক বিশেষ প্রথা, যা ছোটবেলা থেকেই আমরা দেখে আসছি। আর তা হলো— পুজোর দিন সকালে গায়ে হলুদ মেখে স্নান করা।

শীতের সকালে ঠান্ডা জল দিয়ে স্নান করা খুব একটা সহজ কাজ নয়, তবুও এই রীতি মেনে চলে অধিকাংশ বাঙালি পরিবার। অনেকেই হয়তো ভাবেন, এটি নিছকই একটি ধর্মীয় আচার, তবে এর পেছনে রয়েছে একাধিক কারণ— স্বাস্থ্যের যত্ন থেকে শুরু করে ঋতু পরিবর্তনের প্রস্তুতি, এমনকি রূপচর্চার ক্ষেত্রেও এর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

কিন্তু কেন সরস্বতী পুজোর দিন বিশেষভাবে গায়ে হলুদ মাখার রীতি রয়েছে? শুধুই কি ধর্মীয় কারণ, নাকি এর পেছনে লুকিয়ে রয়েছে আরও গভীর কোনও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা? এই প্রতিবেদন সেই বিষয়েই বিস্তারিত আলোচনা করবে।

হলুদের প্রাকৃতিক গুণাগুণ ও শরীরের উপকারিতা

হলুদ শুধুমাত্র রান্নার উপকরণ বা রূপচর্চার সামগ্রী নয়, এটি একটি শক্তিশালী প্রাকৃতিক অ্যান্টিসেপটিক ও অ্যান্টিফাঙ্গাল উপাদান। বহু শতাব্দী ধরে আয়ুর্বেদে হলুদ ব্যবহৃত হয়ে আসছে বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধের জন্য।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ঋতু পরিবর্তনের সময় শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। শীত থেকে বসন্তে যাওয়ার সময় ঠান্ডা, সর্দি-কাশির প্রকোপ বাড়ে, ত্বকের সমস্যাও দেখা দেয়। ঠিক এই সময় হলুদ ব্যবহার করলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং ত্বকের নানা সমস্যা কমে।

গায়ে হলুদ মাখার উপকারিতাগুলো হলো—

✅ ত্বক পরিষ্কার রাখে: হলুদে থাকা জীবাণুনাশক উপাদান ত্বকের জীবাণু দূর করে, ব্রণ ও অ্যালার্জির সমস্যা কমায়।
✅ প্রাকৃতিক ময়েশ্চারাইজার: শীতের শুষ্ক আবহাওয়ায় ত্বক রুক্ষ ও ফাটা ফাটা হয়ে যায়। হলুদ ও সরষের তেল একসঙ্গে ব্যবহার করলে ত্বক নরম থাকে।
✅ রক্ত সঞ্চালন বাড়ায়: হলুদ গরম প্রকৃতির, তাই এটি রক্ত সঞ্চালন বাড়িয়ে শরীরকে সতেজ রাখে।
✅ শরীরের ব্যথা কমায়: সরষের তেলের সঙ্গে হলুদ মাখলে পেশির ব্যথা কমে এবং শীতজনিত জড়তা দূর হয়।
✅ ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ায়: হলুদ মাখলে ত্বকের মরা কোষ উঠে যায়, ফলে ত্বক আরও উজ্জ্বল দেখায়।

শুধু হলুদই নয়, সরস্বতী পুজোর সকালে হলুদের সঙ্গে সরষের তেল মিশিয়ে গায়ে মাখার রীতি প্রচলিত। এই প্রথারও একটি বৈজ্ঞানিক ভিত্তি রয়েছে।

  • সরষের তেল গরম প্রকৃতির: শীতের সকালে ঠান্ডা জল দিয়ে স্নান করলে শরীর ঠান্ডা হয়ে যায়, কিন্তু সরষের তেল শরীরকে উষ্ণ রাখতে সাহায্য করে।
  • ত্বকের আর্দ্রতা ধরে রাখে: শীতকালে ত্বক শুষ্ক হয়ে যায়। সরষের তেল প্রাকৃতিক ময়েশ্চারাইজার হিসেবে কাজ করে।
  • সংক্রমণ প্রতিরোধ করে: সরষের তেলে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল উপাদান থাকে, যা ত্বকের নানা সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে।
  • চুলের যত্নেও উপকারী: অনেকে পুজোর সকালে শুধু গায়ে নয়, চুলেও হলুদ ও সরষের তেল মাখেন। এটি খুশকি দূর করে ও চুলের গোড়া মজবুত করে।

প্রাচীনকালে হলুদের ব্যবহার

হলুদের ব্যবহার আজকের নয়, বহু প্রাচীন যুগ থেকে এটি রূপচর্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

  • কথিত আছে, মিসরের রানী ক্লিওপেট্রা নিয়মিত হলুদ ও দুধ মিশিয়ে স্নান করতেন, যাতে তার ত্বক দীর্ঘদিন সতেজ ও উজ্জ্বল থাকে।
  • ভারতের রাজপরিবারের নারীরা রূপচর্চার জন্য হলুদ মাখতেন এবং বিয়ের আগে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান করা হতো, যাতে বর-কনের ত্বক আরও উজ্জ্বল ও সংক্রমণমুক্ত থাকে।
  • অনেক প্রাচীন আয়ুর্বেদ গ্রন্থেও ত্বকের যত্নে হলুদের ব্যবহার সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য রয়েছে।

এমনকি বর্তমান যুগেও অনেক স্কিনকেয়ার ব্র্যান্ড তাদের পণ্যে হলুদ ব্যবহার করে, কারণ এটি ত্বকের জন্য অত্যন্ত উপকারী।

সরস্বতী পুজোকে অনেকেই “বাঙালির ভ্যালেন্টাইনস ডে” বলে থাকেন। এই দিন অনেক তরুণ-তরুণী নতুন সম্পর্কের সূচনা করেন, কেউ কেউ প্রেমে প্রস্তাব দেন। স্কুল-কলেজের বন্ধুদের মধ্যে আলাদা উচ্ছ্বাস দেখা যায়।

তাই এই দিনে অনেকেই নিজেকে সবচেয়ে ভালোভাবে উপস্থাপন করতে চান। হলুদ মাখলে ত্বক উজ্জ্বল দেখায়, যা সৌন্দর্য বাড়ায়। শুধু ধর্মীয় রীতি নয়, বরং এই দিনটি সুন্দরভাবে কাটানোর জন্যও অনেকে সকালে হলুদ মেখে স্নান করেন।

ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও হলুদকে অত্যন্ত শুভ মনে করা হয়।

  • হিন্দু শাস্ত্রে হলুদকে পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয়।
  • কোনও শুভ কাজের আগে হলুদ মাখার রীতি রয়েছে, যেমন বিয়ের গায়ে হলুদ অনুষ্ঠান।
  • সরস্বতী দেবীকে শুভ্র বস্ত্র পরিহিতা বলে মনে করা হলেও, হলুদের রংও জ্ঞানের প্রতীক।

আজকের দিনে এই রীতির প্রাসঙ্গিকতা

যদিও সময় বদলেছে, তবুও সরস্বতী পুজোর সকালে গায়ে হলুদ মাখার রীতি আজও অনেক বাড়িতে প্রচলিত।

তবে আধুনিক প্রজন্মের অনেকেই হয়তো এই রীতির গুরুত্ব জানেন না এবং এটিকে শুধুই একটি ধর্মীয় নিয়ম বলে মনে করেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, এটি স্বাস্থ্য, রূপচর্চা এবং ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার একটি দারুণ উপায়।

অনেকে হয়তো মনে করেন, এখন বাজারে এত ভালো স্কিনকেয়ার প্রোডাক্ট পাওয়া যায়, তাহলে হলুদ মাখার দরকার কী? কিন্তু প্রাকৃতিক উপাদানের মতো নিরাপদ ও কার্যকর কিছুই হতে পারে না।

সরস্বতী পুজোর সকালে গায়ে হলুদ মাখে স্নান করা শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় রীতি নয়, এটি আমাদের সুস্থ ও সুন্দর রাখার এক চিরন্তন প্রথা। এটি ত্বকের যত্ন নেয়, ঋতু পরিবর্তনের ধকল সামলাতে সাহায্য করে এবং শরীরকে সতেজ রাখে।

তাই এবার সরস্বতী পুজোয় সকাল সকাল উঠুন, হলুদ মেখে স্নান করুন, এবং দিনটি সুন্দরভাবে উপভোগ করুন!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *