‘ছোট্ট কারণে’ই শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ — জানেন কী সেই ছোট্ট কারণটি?

Spread the love

এক ছোট্ট সিদ্ধান্ত, যার প্রভাব আজও থামেনি

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ — আধুনিক বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ সংঘর্ষগুলোর একটি। অথচ এই যুদ্ধের সূত্রপাত হয়েছিল একটি ‘ছোট্ট কারণ’ থেকেই।
২০১৪ সালে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ হঠাৎই ইউরোপীয় ইউনিয়নের (EU) সঙ্গে স্বাক্ষর হতে যাওয়া অর্থনৈতিক সহযোগিতা চুক্তি বাতিল করে রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়েন।
এই সিদ্ধান্ত ইউক্রেনের সাধারণ জনগণের কাছে ছিল এক বিশ্বাসঘাতকতার মতো — কারণ তারা চেয়েছিল ইউরোপের সঙ্গে আরও নিবিড় সম্পর্ক। ঠিক তখনই শুরু হয় ইউরোমাইদান আন্দোলন (Euromaidan Movement) — ইউক্রেনের ইতিহাসে এক মোড় ঘোরানো মুহূর্ত।

ইউরোমাইদান আন্দোলনের জেরে ইয়ানুকোভিচ ক্ষমতাচ্যুত হন। আর সেখান থেকেই ধীরে ধীরে শুরু হয় সেই উত্তেজনা, যা ২০২২ সালে গিয়ে পরিণত হয় এক পূর্ণমাত্রার যুদ্ধে।

বিস্তারিত পড়ুন – Britannica: The 2022 Russian invasion of Ukraine


রাশিয়ার উদ্বেগ: ইউক্রেন যদি পশ্চিমা দলে যোগ দেয়

রাশিয়ার দৃষ্টিতে, ইউক্রেনের ইউরোপ ও ন্যাটোর দিকে ঝোঁকা মানেই ছিল নিরাপত্তার ওপর সরাসরি হুমকি। কারণ ইউক্রেন ভৌগোলিকভাবে রাশিয়ার পশ্চিম সীমান্তে — এমন এক কৌশলগত অবস্থানে, যেখানে কোনো শত্রুপক্ষের ঘাঁটি তৈরি হলে তা সরাসরি রাশিয়ার হৃদয়ভূমিকে বিপদে ফেলতে পারে।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন প্রকাশ্যেই বলেছিলেন,

“যদি ইউক্রেন ন্যাটোর অংশ হয়, তবে সেটি রাশিয়ার অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।”
(সূত্র: CFR Backgrounder – Ukraine conflict)

এই ভূরাজনৈতিক বাস্তবতাই যুদ্ধের গভীরতর শিকড়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর থেকে ইউক্রেন স্বাধীন হলেও, রাশিয়া কখনোই তাকে পুরোপুরি ‘নিজের প্রভাববলয়’ থেকে বেরিয়ে যেতে দেয়নি।


ক্রিমিয়া দখল: প্রথম বড় পদক্ষেপ

২০১৪ সালের মার্চে, ইউক্রেনের রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে রাশিয়া ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখল করে নেয়। কৃষ্ণসাগরের তীরে অবস্থিত এই অঞ্চল রাশিয়ার জন্য কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ — কারণ এখানেই রয়েছে সেভাস্তোপোল নৌঘাঁটি, যা কৃষ্ণসাগরের প্রবেশদ্বার হিসেবে কাজ করে।

রাশিয়া বলেছিল, তারা ক্রিমিয়ার “রুশ ভাষাভাষী মানুষদের সুরক্ষা দিচ্ছে”; কিন্তু বাস্তবে এটি ছিল একপাক্ষিক দখল।
জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই দখলকে অবৈধ ঘোষণা করে।
এই ঘটনাই ছিল ভবিষ্যতের বড় সংঘাতের প্রথম পদক্ষেপ — রাশিয়া ও ইউক্রেনের সম্পর্ক স্থায়ীভাবে ভেঙে যায়।

বিস্তারিত পড়ুন – Reuters: Crimea annexation 2014


ডনবাসে আগুন: রাশিয়াপন্থী বিদ্রোহের উত্থান

ক্রিমিয়া দখলের পরেই ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় ডনবাস অঞ্চল (দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক) রূপ নেয় নতুন যুদ্ধক্ষেত্রে। রাশিয়াপন্থী বিদ্রোহীরা সেখানে “স্বাধীনতা” দাবি করে বসে।
ইউক্রেনের সেনারা তাদের দমন করতে গেলে শুরু হয় গৃহযুদ্ধের মতো সংঘর্ষ।

রাশিয়া প্রকাশ্যে সাহায্য না করলেও, বিদ্রোহীদের হাতে রুশ অস্ত্র ও আর্থিক সহায়তা পৌঁছতে থাকে। এতে ইউক্রেন সরকারের পক্ষে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে।
একসময় এই সংঘর্ষ এতটাই ভয়াবহ হয় যে, আন্তর্জাতিক মহল মধ্যস্থতা করতে বাধ্য হয় — কিন্তু শান্তি চুক্তিগুলো বেশিদিন টেকে না।

বিস্তারিত পড়ুন – Al Jazeera: Donbas conflict timeline


পশ্চিমা শক্তির ভূমিকা: ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন

ইউক্রেন ধীরে ধীরে পশ্চিমা বিশ্বের দিকে এগিয়ে গেলে, পশ্চিমা দেশগুলোও তাদের পাশে দাঁড়াতে শুরু করে।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইউক্রেনকে অর্থনৈতিক সহায়তা, অস্ত্র ও সামরিক প্রশিক্ষণ দিতে থাকে।
রাশিয়ার কাছে এটি ছিল সরাসরি ‘ন্যাটো-বিস্তার’ (NATO Expansion)-এর প্রতিফলন।

রাশিয়ার ধারণা ছিল, পশ্চিমা জোটগুলো ইউক্রেনকে নিজেদের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করবে। এই আশঙ্কাই শেষ পর্যন্ত রাশিয়াকে পূর্ণমাত্রায় সামরিক পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করে

বিস্তারিত পড়ুন – The Guardian: How NATO expansion fuelled Russian fears


২০২২: “বিশেষ সামরিক অভিযান” থেকে পূর্ণ যুদ্ধ

২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি, রাশিয়া ঘোষণা করে “বিশেষ সামরিক অভিযান” (Special Military Operation)।
পুতিনের ভাষায় এর উদ্দেশ্য ছিল “ইউক্রেনকে নাৎসিমুক্ত করা” ও “রাশিয়াপন্থী মানুষদের সুরক্ষা দেওয়া”।
কিন্তু বাস্তবে এটি ছিল ইউক্রেনকে পুনরায় রাশিয়ার প্রভাববলয়ে টেনে আনার চেষ্টা।

রাশিয়া শুরুতে ভেবেছিল, কয়েক সপ্তাহেই ইউক্রেনকে দখল করা যাবে। কিন্তু ইউক্রেনের প্রতিরোধ ও পশ্চিমা দেশগুলোর সহায়তা যুদ্ধকে দীর্ঘস্থায়ী করে তোলে।
এই সংঘর্ষ এখন পর্যন্ত চলমান — এবং এটিকে অনেক বিশ্লেষক “ঠান্ডা যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ের সবচেয়ে বড় যুদ্ধ” বলে অভিহিত করেছেন।

বিস্তারিত পড়ুন – BBC: Full-scale invasion of Ukraine


মানবিক বিপর্যয় ও বৈশ্বিক প্রভাব

এই যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে হাজার হাজার মানুষ।
জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, লক্ষাধিক ইউক্রেনীয় পরিবার গৃহহীন বা শরণার্থী হিসেবে প্রতিবেশী দেশে আশ্রয় নিয়েছে।
স্কুল, হাসপাতাল, বিদ্যুৎকেন্দ্র — সবই ধ্বংস হয়ে গেছে বহু এলাকায়।
এ যুদ্ধ কেবল ইউক্রেন-রাশিয়া সীমায় সীমাবদ্ধ নয়; এর প্রভাব পড়েছে পুরো বিশ্বের অর্থনীতিতে।

  • ইউরোপে গ্যাস ও জ্বালানি সরবরাহ বিপর্যস্ত হয়েছে,
  • খাদ্য সংকটে পড়েছে আফ্রিকা ও এশিয়ার বহু দেশ,
  • আন্তর্জাতিক মুদ্রা বাজারেও অস্থিরতা বেড়েছে।

এ যুদ্ধ তাই এখন শুধু ভূরাজনীতি নয়, মানবতার সংকট হিসেবেও দেখা হচ্ছে।

বিস্তারিত পড়ুন – UNHCR: Refugee impact of Ukraine war

যুদ্ধের সূচনা, ইউরোপমুখী সিদ্ধান্ত থেকেই রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের শুরু

মূল কারণ: ‘ছোট্ট’ একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত

সবশেষে ফিরে যাই মূল প্রশ্নে — যুদ্ধটা শুরু হয়েছিল কোন ছোট্ট কারণে?
উত্তর হলো:
একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত — ইউক্রেনের ইউরোপীয় ইউনিয়নের দিকে ঝোঁকে পড়া এবং রাশিয়ার কাছে তার অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক সম্পর্ককে দূরে সরিয়ে রাখা।

এই সিদ্ধান্ত প্রথমে সাধারণ মনে হলেও, সেটিই রাশিয়ার কাছে “হুমকি” হয়ে দেখা দেয়।
ক্রিমিয়া দখল, ডনবাস সংঘর্ষ, ন্যাটো-বিরোধিতা — সবই সেই এক সিদ্ধান্তের চেইন রিঅ্যাকশন।

অর্থাৎ, ছোট্ট কারণ থেকে শুরু হওয়া ঘটনাই ইতিহাসে এক ভয়াবহ যুদ্ধের জন্ম দেয়, যা এখনো চলছে —
এবং যার পরিণতি আজও কেউ সঠিকভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারছে না।


উপসংহার

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আমাদের মনে করিয়ে দেয় — আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জগতে “ছোট্ট কারণ” বলে কিছু নেই।
একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, একটি কূটনৈতিক ঘোষণা, কিংবা একটি জোট-চুক্তি — কোনো একদিন ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে।
আজ ইউক্রেনের মানুষ যুদ্ধের আগুনে পুড়ছে, রাশিয়ার অর্থনীতি অবরুদ্ধ, আর বিশ্ব তাকিয়ে আছে —
কবে থামবে এই সংঘর্ষ, যার শুরু হয়েছিল এক ছোট্ট কারণেই।

]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *