হিন্দু ধর্মে সাধু-সন্ন্যাসীদের গুরুত্ব অপরিসীম। তাঁদের জীবনধারা, আচার-আচরণ এবং তপস্যার রীতিনীতিগুলি গভীর আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে জড়িত। তবে সাধু-সন্ন্যাসীদের এই বৃহৎ জগতের মধ্যে নাগা সাধু এবং অঘোরি বাবার পরিচিতি অন্য রকম। এঁদের বেশভূষা ও আচার-আচরণ অনেক সময়েই সাধারণ মানুষের বিভ্রান্তির কারণ হয়। অনেকেই মনে করেন নাগা সাধু আর অঘোরি বাবা একই, কিন্তু বাস্তবে এ ধারণা একেবারেই ভুল। এঁরা দু’জনেই ভিন্ন সাধনা-পথে শিব-তপস্যা করেন এবং তাঁদের জীবনযাত্রার ধরন একেবারেই আলাদা।
নাগা সাধু কারা?
নাগা সাধুরা হিন্দু সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের এক বিশেষ গোষ্ঠী। তাঁরা মূলত শৈব ধর্মাবলম্বী, অর্থাৎ মহাদেব শিবের পূজার্চনা এবং তপস্যায় নিবেদিত প্রাণ। নাগা সাধু হওয়ার জন্য কঠোর শৃঙ্খলা এবং দীর্ঘকালীন তপস্যার প্রয়োজন। সাধারণত কেউ নাগা সাধু হওয়ার সংকল্প করলে তাঁকে প্রথমে গুরু-পরম্পরার নিয়মে সন্ন্যাস গ্রহণ করতে হয়।
নাগা সাধুদের সাধনা শুরু হয় তাঁদের আখড়ায়। আখড়া হল একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, যেখানে গুরু-শিষ্যের মধ্যে আধ্যাত্মিক জ্ঞানচর্চা এবং শিক্ষাদান হয়। নাগা সাধু হওয়ার আগে শিষ্যকে ১২ বছরের কঠোর তপস্যা করতে হয়। গুরুর সেবা করা, আখড়ার নিয়ম মেনে জীবনযাপন করা, এবং কঠোর শৃঙ্খলা মেনে চলা নাগা সাধু হওয়ার গুরুত্বপূর্ণ শর্ত।
নাগা সাধুরা নিজেদের দেহে কোনো ধরনের অলংকার ব্যবহার করেন না এবং সম্পূর্ণ নগ্ন থাকেন। তাঁরা শরীর ভস্ম মাখা অবস্থায় ঘুরে বেড়ান। তাঁদের মতে, এই ভস্ম হলো আধ্যাত্মিক বিশুদ্ধতার প্রতীক এবং এটি তাঁরা জীবনের ক্ষণস্থায়ীত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য ব্যবহার করেন।
অঘোরি বাবা কারা?
অঘোরি বাবারা শৈব ধর্মের আরেকটি বিশেষ গোষ্ঠীর অন্তর্গত। তবে তাঁদের সাধনার ধরণ নাগা সাধুদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। অঘোরিরা সাধনা করেন শ্মশানে, যেখানে তাঁরা জীবনের মোহ-মায়া ত্যাগ করে মৃত্যুকে আত্মস্থ করেন। তাঁদের মতে, মৃত্যুই জীবনের চূড়ান্ত সত্য, এবং এই সত্যের মুখোমুখি হওয়ার মাধ্যমেই তাঁরা মোক্ষ লাভের পথ খুঁজে পান।
অঘোরি হওয়ার জন্যও কঠিন তপস্যার প্রয়োজন। তবে তাঁদের জন্য আখড়ার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। অনেক সময় তাঁরা গুরু-পরম্পরা মেনেও শিক্ষালাভ করেন, আবার অনেক সময় নিজেরাই সাধনায় নিমগ্ন হয়ে ওঠেন।
অঘোরিরা সাধারণত মাংসাশী এবং তাঁরা এমন কিছু খাদ্যও গ্রহণ করেন যা সাধারণ মানুষের জন্য অগ্রহণযোগ্য। এমনকি মৃতদেহের মাংসও তাঁদের খাবারের তালিকায় থাকতে পারে। তাঁরা শিবের এমন এক রূপের সাধনা করেন, যেখানে সব কিছু গ্রহণযোগ্য, কিছুই অপবিত্র নয়। তাঁদের বিশ্বাস, এই জগতের কোনও কিছুই অশুচি নয়, সবই শিবময়।
নাগা সাধু ও অঘোরি বাবার মধ্যে পার্থক্য বোঝার জন্য তাঁদের সাধনা-পদ্ধতি, জীবনযাত্রা এবং আচার-আচরণের দিকগুলি আলাদাভাবে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।

১. সাধনা ও তপস্যার জায়গা:
নাগা সাধুরা সাধনা করেন আখড়ায়, যেখানে তাঁরা গুরুর তত্ত্বাবধানে আধ্যাত্মিক জ্ঞানচর্চা করেন। অন্যদিকে, অঘোরিরা সাধনা করেন শ্মশানে। অঘোরিদের মতে, শ্মশান হলো এমন এক জায়গা, যেখানে জীবনের সব মোহ-মায়ার শেষ হয়।
২. জীবনযাত্রার ধরন:
নাগা সাধুরা সম্পূর্ণ নগ্ন থাকেন এবং শরীরে ভস্ম মেখে থাকেন। এটি তাঁদের আধ্যাত্মিকতার প্রতীক। অন্যদিকে, অঘোরিরা শরীরের নীচের অংশ ঢেকে রাখেন। তাঁরা কখনও পশুর চামড়া, কখনও কাপড় ব্যবহার করেন। তবে অঘোরিদের গলায় অনেক সময় খুলি বা হাড়ের মালা দেখা যায়, যা নাগা সাধুদের মধ্যে দেখা যায় না।
৩. খাদ্যাভ্যাস:
নাগা সাধুরা নিরামিষাশী। তাঁরা ফল, শাকসবজি এবং নিরামিষ খাবারের মাধ্যমে জীবনযাপন করেন। অন্যদিকে, অঘোরিরা আমিষভোজী। তাঁরা মাংস, এমনকি মৃতদেহের মাংসও খেয়ে থাকেন।
৪. গুরু-শিষ্য সম্পর্ক:
নাগা সাধু হওয়ার জন্য গুরু-শিষ্য সম্পর্ক বাধ্যতামূলক। শিষ্যরা গুরুর সেবা করেন এবং তাঁর কাছ থেকে জ্ঞানলাভ করেন। অন্যদিকে, অঘোরিদের ক্ষেত্রে গুরুর প্রয়োজন নেই। তাঁরা নিজেরাই সাধনায় লিপ্ত হন।
৫. শিবপুজোর ধরণ:
নাগা সাধুরা শিবপুজো করেন আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। তাঁরা ভক্তিমূলক পদ্ধতিতে ধ্যান করেন এবং প্রার্থনা করেন। অন্যদিকে, অঘোরিরা শিবের ভিন্ন রূপে আরাধনা করেন। তাঁদের পুজোর পদ্ধতি অনেক সময় সাধারণ মানুষের কাছে ভয়ানক বা অস্বাভাবিক মনে হতে পারে।
কুম্ভমেলা হিন্দু ধর্মের একটি অন্যতম বৃহৎ উৎসব, যেখানে লক্ষ লক্ষ সাধু-সন্ন্যাসী এবং তীর্থযাত্রী একত্রিত হন। এই মেলায় নাগা সাধুরা বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। তাঁরা সাধারণত এই মেলায় শোভাযাত্রায় অংশ নেন এবং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেন।
নাগা সাধুদের বিশেষত্ব হল তাঁদের নগ্নতা এবং ভস্মমাখা শরীর। কুম্ভমেলার সময় তাঁরা নদীতে স্নান করে নিজেদের তপস্যার প্রমাণ দেন। সাধারণ মানুষের কাছে তাঁরা এক ধরণের রহস্যময় চরিত্র, কারণ তাঁদের জীবনধারা এবং আচার-অনুষ্ঠান সাধারণ মানুষের চেনা জীবনের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
অঘোরি বাবার জীবনধারা নিয়ে ভুল ধারণা
অঘোরি বাবারা সাধারণ মানুষের মনে অনেকসময় ভয়ের কারণ হন। তাঁদের খাদ্যাভ্যাস এবং শ্মশানে সাধনা করার জন্য তাঁরা রহস্যময় বলে মনে করা হয়। তবে তাঁদের সাধনা জীবনের গভীরতাকে উপলব্ধি করার একটি উপায়। তাঁরা বিশ্বাস করেন, পৃথিবীর কোনও কিছুই অপবিত্র নয় এবং সবকিছুই ঈশ্বরের অংশ।
নাগা সাধু এবং অঘোরি বাবাদের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ মিল হল তাঁরা দু’জনেই শিব-উপাসক। তাঁরা শিবের ভিন্ন ভিন্ন রূপের আরাধনা করেন। নাগা সাধুরা শিবের সন্ন্যাসী রূপে আরাধনা করেন, যেখানে নিরামিষ আহার এবং আচার-অনুষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে, অঘোরিরা শিবের এমন এক রূপে সাধনা করেন, যেখানে জীবনের প্রতিটি দিককে গ্রহণ করা হয়।
তাঁদের জীবনধারা যতই আলাদা হোক, দুই গোষ্ঠীরই লক্ষ্য মোক্ষ লাভ। তাঁরা জাগতিক মোহ-মায়া ত্যাগ করে আধ্যাত্মিকতার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছানোর চেষ্টা করেন।
নাগা সাধু এবং অঘোরি বাবাদের মধ্যে পার্থক্য বোঝার জন্য তাঁদের সাধনা-পদ্ধতি এবং জীবনযাত্রার ধরন বুঝতে হবে। তাঁদের মধ্যে কোনও তুলনা না টেনে, তাঁদের সাধনার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা উচিত। তাঁদের জীবনযাত্রা এবং আচার-আচরণ আমাদের শেখায় কীভাবে জীবনের মোহমুক্ত হয়ে সত্যের সন্ধান করতে হয়। নাগা সাধু এবং অঘোরি বাবা—দু’জনেই আধ্যাত্মিকতার অনন্য রূপ, যা ভারতীয় সংস্কৃতির গভীরতা এবং বহুমুখীতার প্রতীক।