দুর্গাপূজা ২০২৬ ধীরে ধীরে ঘনিয়ে আসছে। শরতের হাওয়া, কাশফুল আর ঢাকের আওয়াজে বাঙালির মন ইতিমধ্যেই মেতে উঠছে উৎসবের আবহে। তবে আনন্দের মাঝেও পূজোর কিছু অলিখিত নিয়ম আছে, যেগুলো মেনে চললে পূজোর পরিবেশ আরও পবিত্র, শান্ত ও ভক্তিময় হয়। এই প্রতিবেদনে জানুন—দুর্গাপূজার আগে ও সময়কালে কোন ১০ টি কাজ একদম করা উচিত নয়, আর কীভাবে মা দুর্গার আশীর্বাদ পাওয়া যায়।
দুর্গাপূজা শুধু একটা উৎসব নয়, এটা বাঙালির আবেগ, ভালোবাসা আর ভক্তির মেলবন্ধন। শরতের কাশফুল, ঢাকের আওয়াজ, ধুনো ধূপের গন্ধ—সবকিছু মিলে এক অনন্য আবহ তৈরি করে। মা দুর্গা কেবল শক্তির প্রতীক নন, তিনি আশ্রয়, স্নেহ, আর আশীর্বাদের প্রতিমূর্তি। তাঁর আগমনের মধ্যেই যেন জীবনের ক্লান্তি দূর হয়, মন জেগে ওঠে নতুন আলোয়।
কিন্তু আনন্দের পাশাপাশি পূজোর সময় আমাদের আচরণ, মনোভাব এবং চিন্তাধারা যেন ভক্তির মর্যাদা রক্ষা করে। অনেক সময় উৎসবের উচ্ছ্বাসে আমরা কিছু নিয়ম ভুলে যাই, যা অজান্তেই ভক্তির পবিত্রতা নষ্ট করে। তাই আসুন দেখে নিই, দুর্গাপূজার আগে এবং সময়কালে কোন বিষয়গুলো মনে রাখা সবচেয়ে জরুরি, যাতে মা দুর্গার আশীর্বাদ আমাদের জীবনে পূর্ণভাবে প্রবাহিত হয়।
১. পবিত্র শরীর ও মন নিয়ে পূজায় অংশগ্রহণ করুন
দেবী আরাধনার মূল মন্ত্রই হলো শুদ্ধতা—শরীরেরও, মনেরও। প্রতিদিনের মতো নয়, পূজার সময়ে একটু বেশি যত্ন নিতে হয় নিজের। সকালে স্নান করে, পরিষ্কার পোশাক পরে, মনের মধ্যে ইতিবাচক ভাব নিয়ে মণ্ডপে প্রবেশ করাই শ্রেয়।
ধূমপান, মদ্যপান বা অপরিষ্কার অবস্থায় পূজায় অংশ নেওয়া কখনোই শোভন নয়। শাস্ত্রেও বলা আছে, “যে মন শান্ত, যে দেহ শুচি, তার ভক্তিই সত্য ভক্তি।”
অর্থাৎ পূজার সময়ে বাইরের পরিচ্ছন্নতার সঙ্গে সঙ্গে ভেতরের শান্তিটাও জরুরি। তাই চেষ্টা করুন—
- সকালে স্নান করে তারপর দেবীর আরাধনায় বসতে।
- মনোযোগ ভক্তির দিকে রাখুন, মোবাইল বা অন্য চিন্তায় নয়।
- মণ্ডপে প্রবেশের আগে এক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করে মনে মনে বলুন—“মা, আমাকে শান্তি দাও।”
২. সত্যবাদিতা ও শুভ চিন্তা বজায় রাখুন
দুর্গাপূজার আসল শিক্ষা হলো শুভ শক্তির জয় এবং অশুভ শক্তির পরাজয়। মিথ্যা, হিংসা, লোভ, প্রতারণা বা অন্যের প্রতি খারাপ চিন্তা—এসবই অশুভ শক্তির প্রতীক। এই সময় ভক্তির সঙ্গে এসব ভাবনা একদম মানায় না।
মা দুর্গা তখনই খুশি হন, যখন আমরা সত্যনিষ্ঠা, সততা এবং ন্যায়ের পথে থাকি। তাই পূজার সময়ের কিছু সৎ প্রতিজ্ঞা করা যায়—
- কখনো মিথ্যা বলব না, এমনকি ছোট ব্যাপারেও নয়।
- কাউকে কষ্ট দেব না, বরং সাহায্য করব।
- ঈর্ষা বা রাগের পরিবর্তে সহানুভূতি রাখব।
এইভাবে আচরণ করলে পূজার দিনগুলো সত্যিই হয়ে উঠবে মানসিক শান্তি ও শক্তি লাভের সময়।
৩. প্রাণী ও প্রকৃতির প্রতি দয়া ও ভালোবাসা রাখুন
দেবী দুর্গা মা রূপে সমস্ত জীবের রক্ষক। তাই তাঁর আরাধনার সময়ে প্রাণীহিংসা বা নিষ্ঠুরতা থেকে দূরে থাকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পূজার সময়ে ছোট ছোট দয়ার কাজই বড় আশীর্বাদ ডেকে আনে।
একটি পাখিকে জল দেওয়া, পথের কুকুরকে একটু খাবার খাওয়ানো, গাছের যত্ন নেওয়া—এই সামান্য কাজগুলোই মায়ের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা। কারণ মা দুর্গা নিজেই প্রকৃতির প্রতীক, সৃষ্টির মমতার রূপ।
৪. দেবীর প্রসাদকে অবহেলা করবেন না
প্রসাদ মানে আশীর্বাদ। দেবীর উদ্দেশ্যে নিবেদিত প্রসাদ শুধু খাদ্য নয়, এটি ভক্তি ও কৃতজ্ঞতার প্রতীক। অনেক সময় দেখা যায়, কেউ প্রসাদ না নিয়ে চলে যান বা অবহেলায় ফেলে দেন। এটা অশোভন আচরণ।
যে অন্ন দেবীর সামনে উৎসর্গ করা হয়, সেটির প্রতি শ্রদ্ধা থাকা দরকার।
তাই—
- যতটুকু নেবেন, মনোযোগ দিয়ে গ্রহণ করুন।
- প্রসাদ গ্রহণের সময় মনে করুন—“মায়ের কৃপা আমার জীবনে প্রবেশ করছে।”
- অযথা অপচয় করবেন না, সম্ভব হলে অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নিন।
এই কৃতজ্ঞতা থেকেই ভক্তির পরিপূর্ণতা আসে।
৫. মণ্ডপে আচরণ রাখুন শান্ত ও শালীন
দুর্গাপূজা আনন্দের উৎসব ঠিকই, কিন্তু ভক্তির স্থানে শালীনতা ও সংযম থাকা প্রয়োজন। মণ্ডপে বা প্যান্ডেলে উচ্চস্বরে গালাগালি, ধাক্কাধাক্কি বা অসৌজন্য আচরণ করা দেবীর অসম্মান।
পূজার আসল আনন্দ হলো সৌহার্দ্য ও সমবেত ভক্তি। তাই—
- অন্যদের প্রতি ভদ্রতা বজায় রাখুন।
- শিশু, বয়স্ক ও মহিলাদের প্রতি সহমর্মিতা রাখুন।
- মণ্ডপে ভিড় থাকলে ধৈর্য ধরুন, ঠেলাঠেলি করবেন না।
এই ভদ্রতা ও শান্ত মনোভাবই ভক্তির সৌন্দর্য বাড়ায়।

৬. অতিরিক্ত ভোজন বা মদ্যপান থেকে বিরত থাকুন
পূজার আনন্দে অনেক সময় আমরা খাওয়া-দাওয়াতে একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলি। তবে মনে রাখবেন, সংযমও এক ধরনের ভক্তি। অতিরিক্ত ভোজন শরীরের ক্ষতি করে, আবার মনকেও ভারাক্রান্ত করে তোলে।
মদ্যপান বা অসংযমী আচরণ থেকে বিরত থাকুন, কারণ এতে ভক্তির ভাব নষ্ট হয়। আনন্দ করুন, কিন্তু পরিমিতভাবে। শরীর সুস্থ থাকলেই তো মন দেবীময় হবে।
৭. দেবীর মূর্তির সামনে শ্রদ্ধা বজায় রাখুন
আজকাল অনেকেই মণ্ডপে গিয়ে ছবি তুলতে তুলতে ভুলে যান—মূর্তিটি শুধু একটি শিল্পকর্ম নয়, এটি ভক্তির প্রতীক, আমাদের মায়ের প্রতিরূপ। তাই দেবীর সামনে সবসময় শ্রদ্ধার সঙ্গে আচরণ করা উচিত।
মূর্তির কাছে গিয়ে জোরে চিৎকার, হাসাহাসি বা অসাবধান আচরণ করা ঠিক নয়। দেবীর সামনে দাঁড়িয়ে নীরবে প্রণাম করুন, নিজের মনে একটি প্রার্থনা বলুন। এই নীরবতাই সবচেয়ে বড় ভক্তি।
৮. সবাইকে ভালোবাসুন, কাউকে অপমান করবেন না
দুর্গাপূজা হলো মিলনের উৎসব। ধর্ম, বর্ণ, বয়স, লিঙ্গ—সব ভেদাভেদ ভুলে সবাই একসঙ্গে আনন্দ করে। তাই কারও সঙ্গে দুর্ব্যবহার বা অপমানের আচরণ করা উচিত নয়।
যত বেশি আমরা একে অপরের সঙ্গে সৌহার্দ্য ও ভালোবাসা ভাগ করে নিই, তত বেশি সমাজে শুভ শক্তির বিস্তার ঘটে।
- পরিচিত হোক বা অপরিচিত, সবার প্রতি নম্র থাকুন।
- কেউ ভুল করলেও কঠিন কথা বলার আগে নিজেকে শান্ত করুন।
- একটুখানি হাসি, একটুখানি সহযোগিতা—এই ছোট ছোট কাজেই পূজার প্রকৃত আনন্দ।
৯. অলসতা বা উদাসীনতা নয়, মনকে রাখুন সক্রিয় ও আনন্দে ভরা
পূজার সময় মন যেন অলস বা উদাসীন না হয়। দেবী দুর্গার আরাধনার আসল উদ্দেশ্য হলো মনকে শক্তিশালী করা।
এই কয়েকটা দিন যতটা সম্ভব ইতিবাচক কাজে সময় দিন—
- সকালে বা রাতে একটু সময় প্রার্থনায় কাটান।
- পরিবার, বন্ধু ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে মিলেমিশে সময় কাটান।
- পূজার আলো, ধুনো ও ধ্বনিতে নিজের মনকে নবজীবনে ভরিয়ে তুলুন।
এই ভক্তিমূলক ইতিবাচক মনোভাবই দুর্গাপূজার প্রকৃত অর্থকে পূর্ণতা দেয়।
১০. কৃতজ্ঞতা ও আত্মসমালোচনার সময় হিসেবে ব্যবহার করুন
দুর্গাপূজা শুধু আনন্দের সময় নয়, এটি কৃতজ্ঞতা জানানোর সময়ও। মা দুর্গার কাছে ধন্যবাদ জানান—গত বছরের সমস্ত আশীর্বাদের জন্য। আর নিজের জীবনের ভুলগুলো ভেবে দেখুন, কোথায় একটু পরিবর্তন আনা যায়।
যে মানুষ নিজের ভুল বুঝে সংশোধনের চেষ্টা করে, তার ভক্তিই প্রকৃত ভক্তি। মা দুর্গা তাঁর সন্তানদের সৎ চেষ্টা সবসময় আশীর্বাদ করেন।

উপসংহার
দুর্গাপূজা মানে কেবল উৎসবের বাহার নয়, এটি এক আধ্যাত্মিক যাত্রা—নিজের ভেতরের অন্ধকারকে জয় করে আলোর পথে এগিয়ে যাওয়ার এক আহ্বান। মা দুর্গা আমাদের শেখান, জীবনের প্রতিটি বাধাকে সাহস, ভালোবাসা এবং বিশ্বাস দিয়ে জয় করা যায়।
তাই এই পূজোয় আমরা সবাই একটা ছোট প্রতিজ্ঞা করতে পারি—
“আমি সত্য বলব, শুদ্ধ থাকব, অন্যকে ভালোবাসব, এবং মায়ের আশীর্বাদে সমাজে আলো ছড়াব।”
এই মনোভাব নিয়েই যদি আমরা পূজো করি, তবে সত্যিই এই উৎসব হয়ে উঠবে ভক্তি, শান্তি ও আনন্দের এক পরিপূর্ণ উৎসব।
দুর্গাপূজা ২০২৬ হোক এক শুদ্ধ ও আলোকিত অভিজ্ঞতা। এই সময়টিতে শরীর, মন ও আচরণ যদি পবিত্র থাকে, তবে মা দুর্গার আশীর্বাদ অবধারিত। নিজের ভেতরের অন্ধকার জয় করে শুভ শক্তির দিকে অগ্রসর হওয়াই এই উৎসবের আসল বার্তা।
References:
Hindustan Times: Durga Puja 2022 Rituals and Traditions
IndiaTimes বাংলা: Durga Puja 2025: কী করবেন, কী করবেন না
News18 বাংলা: Durga Puja Dos and Don’ts