বিশ্বের জনসংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। তবে, এক অদ্ভুত আশঙ্কার কথা শোনালেন বিজ্ঞানীরা। একদিন পৃথিবী থেকে পুরুষদের অস্তিত্ব হারিয়ে যেতে পারে। কীভাবে? এর উত্তর লুকিয়ে আছে মানুষের সেক্স ক্রোমোজোমের গঠন এবং বিবর্তনের ইতিহাসে।
মানুষের শরীরের প্রতিটি কোষে একজোড়া সেক্স ক্রোমোজোম থাকে। নারীদের ক্ষেত্রে দুটোই হয় এক্স ক্রোমোজোম, আর পুরুষদের ক্ষেত্রে থাকে এক্স এবং ওয়াই ক্রোমোজোম। এই ওয়াই ক্রোমোজোমই পুরুষের অস্তিত্বের মূল কারণ। কারণ, এটি পুরুষের লিঙ্গ নির্ধারণ এবং শুক্রাণুর উৎপাদনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, বিজ্ঞান বলছে, এই ওয়াই ক্রোমোজোম ধীরে ধীরে সংকুচিত হচ্ছে এবং একসময় এটি সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে যেতে পারে।
মানুষের এক্স ক্রোমোজোমে প্রায় ৯০০টি জিন রয়েছে। কিন্তু ওয়াই ক্রোমোজোমে জিনের সংখ্যা মাত্র ৫৫। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ১৬৬ মিলিয়ন বছর আগে মানুষের পূর্বপুরুষদের ক্ষেত্রে ওয়াই ক্রোমোজোমে অনেক বেশি জিন ছিল। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর বেশিরভাগ জিন হারিয়ে গেছে। গবেষণায় উঠে এসেছে, প্রতি মিলিয়ন বছরে ওয়াই ক্রোমোজোম থেকে গড়ে ৫টি জিন বিলুপ্ত হয়েছে। এই ধারা যদি চলতে থাকে, তাহলে আগামী ১১ মিলিয়ন (১১ লক্ষ) বছরে ওয়াই ক্রোমোজোম পুরোপুরি বিলীন হয়ে যেতে পারে।
প্রফেসর জেনি গ্রেভস, যিনি অস্ট্রেলিয়ার একজন খ্যাতনামা গবেষক, এ বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেন, “প্লাটিপাস নামের স্তন্যপায়ী প্রাণীর ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে তাদের XY ক্রোমোজোম জোড়ায় সমান সংখ্যক জিন রয়েছে। তবে মানুষের ক্ষেত্রে, এক্স এবং ওয়াই ক্রোমোজোমের মধ্যে বিশাল ফারাক। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ওয়াই ক্রোমোজোম তার অনেক জিন হারিয়ে ফেলেছে। এটি একটি ক্রমাগত প্রক্রিয়া এবং একদিন এটি সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হতে পারে।”
পুরুষশূন্য পৃথিবী: কল্পনা নাকি বাস্তবতা?
এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠছে, যদি ওয়াই ক্রোমোজোম ধ্বংস হয়ে যায়, তবে কি পৃথিবী থেকে পুরুষদের অস্তিত্ব মুছে যাবে? বিজ্ঞান বলছে, পুরুষদের অস্তিত্ব নির্ভর করে ওয়াই ক্রোমোজোমের উপর। এটি যদি না থাকে, তবে পুরুষরা আর সন্তান উৎপাদন করতে পারবে না।
এই প্রসঙ্গে গবেষণা বলছে, এমন পরিস্থিতিতে পৃথিবীতে শুধুমাত্র কন্যাসন্তানের জন্ম হবে। কারণ, পুরুষের শুক্রাণুতে থাকা ওয়াই ক্রোমোজোমই লিঙ্গ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু যদি এটি বিলুপ্ত হয়ে যায়, তবে কেবল এক্স ক্রোমোজোম বহনকারী ডিম্বাণু নিষিক্ত হবে এবং জন্মাবে কন্যাসন্তান।
এই সংকটের মধ্যেও বিজ্ঞানীরা কিছুটা আশার কথা শুনিয়েছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, ভবিষ্যতে নতুন কোনো লিঙ্গ নির্ধারণকারী জিন উদ্ভাবিত হতে পারে। অর্থাৎ, পুরুষের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য নতুন কোনো জিন বিবর্তিত হতে পারে।

তবে প্রফেসর জেনি গ্রেভস এই বিষয়ে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেছেন, “নতুন লিঙ্গ নির্ধারণকারী জিনের উদ্ভব হতে পারে, কিন্তু এর সঙ্গে অনেক ঝুঁকিও রয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এই বিবর্তন ভিন্নভাবে ঘটতে পারে। ফলে এক প্রজাতির মানুষ বিভক্ত হয়ে একাধিক প্রজাতিতে রূপান্তরিত হতে পারে।”
১১ মিলিয়ন বছর পর পৃথিবীর কী চেহারা হবে?
প্রফেসর গ্রেভসের বক্তব্য অনুযায়ী, ১১ মিলিয়ন বছর পর পৃথিবী একেবারেই আলাদা হতে পারে। তখন হয়তো বর্তমান মানুষের অস্তিত্ব আর থাকবে না। তার বদলে থাকবে ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির মানুষ। এই বিবর্তন কি ইতিবাচক হবে নাকি নেতিবাচক, তা সময়ই বলবে।
তবে তিনি আরও বলেন, “মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকতে পারে। নতুন জিনের উদ্ভব হলে হয়তো পুরুষের অস্তিত্ব রক্ষা পাবে। তবে সেই সময়ের মানুষ হয়তো আজকের মানুষের মতো হবে না। তারা হবে নতুন কোনো প্রজাতি।”
ওয়াই ক্রোমোজোমের সংকোচন শুধু মানুষের ক্ষেত্রেই নয়, অন্য স্তন্যপায়ী প্রাণীদের ক্ষেত্রেও ঘটে। অনেক প্রজাতির প্রাণীর ক্ষেত্রেও দেখা গেছে, তাদের ওয়াই ক্রোমোজোম হারিয়ে গেছে। তবে তারা নতুন লিঙ্গ নির্ধারণ প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করেছে।
উদাহরণস্বরূপ, কিছু ইঁদুর এবং তিলচোখা প্রাণীর ক্ষেত্রে দেখা গেছে, তাদের ওয়াই ক্রোমোজোম সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়েছে। তবে তারা নতুন কোনো জিনের সাহায্যে তাদের প্রজনন প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে।
কেন ওয়াই ক্রোমোজোম সংকুচিত হচ্ছে?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বিজ্ঞানীরা একাধিক তত্ত্ব দিয়েছেন।
১. নন-কোডিং ডিএনএ: ওয়াই ক্রোমোজোমে অনেক নন-কোডিং ডিএনএ রয়েছে, যা কার্যকরী জিনের তুলনায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
২. জিনের ঘনত্ব কম: এক্স ক্রোমোজোমের তুলনায় ওয়াই ক্রোমোজোমে জিনের ঘনত্ব অনেক কম। ফলে এটি বিবর্তনের সময় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
৩. প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রভাব: সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে কম প্রয়োজনীয় জিন বিলুপ্ত হয়ে যায়।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, ওয়াই ক্রোমোজোমের সংকোচন অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত। এটি শুধু মানুষের বিবর্তনের দিকেই আলোকপাত করে না, বরং ভবিষ্যতের সম্ভাব্য সংকট সম্পর্কেও সতর্ক করে।
তবে আশার কথা হলো, মানুষের মস্তিষ্ক এবং প্রযুক্তিগত ক্ষমতা এই সংকট কাটিয়ে উঠতে পারে। জিন এডিটিং এবং কৃত্রিম প্রজনন প্রযুক্তি ভবিষ্যতে পুরুষদের অস্তিত্ব রক্ষায় সাহায্য করতে পারে।

এই মুহূর্তে মানবজাতির জন্য সবচেয়ে বড় কাজ হলো গবেষণার মাধ্যমে বিষয়টি আরও ভালোভাবে বোঝা। পাশাপাশি, জিন গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়ে একাধিক প্রশ্নের মুখোমুখি হলেও, এই সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য আমাদের বুদ্ধিমত্তা এবং প্রযুক্তিই সবচেয়ে বড় হাতিয়ার।
ওয়াই ক্রোমোজোমের সংকোচন একটি ধীর প্রক্রিয়া। এটি কোনো হঠাৎ বিপর্যয়ের কারণ নয়, তবে এটি ভবিষ্যতে মানুষের অস্তিত্বের প্রশ্ন তুলতে পারে। বিজ্ঞানীরা এই বিষয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন এবং নতুন সম্ভাবনার কথা বলছেন।
একদিকে, এটি বিবর্তনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। অন্যদিকে, এটি মানবজাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে একটি বড় প্রশ্নচিহ্ন। তবে প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞানের অগ্রগতির মাধ্যমে আমরা হয়তো এই চ্যালেঞ্জের সমাধান খুঁজে পেতে সক্ষম হব।
অনেক স্তন্যপায়ী প্রাণীর ক্ষেত্রে দেখা গেছে, তারা নতুন জিনের উদ্ভাবনের মাধ্যমে তাদের প্রজনন প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে। মানুষ যদি একই পথে বিবর্তিত হয়, তবে ভবিষ্যতে হয়তো আমরা এমন এক পৃথিবী দেখতে পারব, যেখানে নতুন ধরনের ক্রোমোজোমের ভিত্তিতে পুরুষের অস্তিত্ব রক্ষা পাবে।
তবে যেকোনো পরিবর্তনই একটি জটিল প্রক্রিয়া। বিবর্তনের এই ধারা মানবজীবনের প্রভাব কতটা ফেলবে, তা নির্ভর করছে আগামী গবেষণার উপর। বিজ্ঞানীরা এই বিষয়ে আরও কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন, যাতে মানুষের ভবিষ্যৎ নিরাপদ রাখা সম্ভব হয়।