সীতাকে উদ্ধার করার জন্য লঙ্কা আক্রমণ করতে রাম সেতু নির্মাণ করেছিলেন শ্রীরামচন্দ্র। সমুদ্রের উপর পাথর ফেলে সেতু তৈরি করে তাঁর বানর বাহিনী। কিন্তু কেন পরে সমুদ্রের জলে তলিয়ে গেল এই সেতু। জানুন রাম সেতুর অজানা কাহিনি।
রাম সেতু, যা আদমস ব্রিজ নামেও পরিচিত, একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বিতর্কিত বিষয়। এটি হিন্দু পুরাণের অন্যতম আলোচিত কাহিনির সঙ্গে জড়িয়ে আছে এবং প্রাচীনকালের একটি বিস্ময়কর স্থাপত্য। শ্রীরামচন্দ্র ও তাঁর বানর সেনা লঙ্কা অভিযানের সময় সমুদ্রের উপর দিয়ে এই সেতু তৈরি করেছিলেন বলে বর্ণনা পাওয়া যায়। তবে এই সেতুটি শুধু ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক দিক থেকেই নয়, বৈজ্ঞানিক ও প্রাকৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও মানুষের কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। রাম সেতু সম্পর্কে আরও গভীরে জানতে হলে, এর নির্মাণ, প্রেক্ষাপট, বর্তমান পরিস্থিতি ও তলিয়ে যাওয়ার কারণ বিশদে আলোচনা প্রয়োজন।
রাম সেতুর নির্মাণ
বাল্মীকি রামায়ণের কাহিনিতে উল্লেখ আছে, রাবণ সীতাকে অপহরণ করে লঙ্কায় নিয়ে গেলে রাম ও লক্ষ্মণ তাঁকে উদ্ধার করার জন্য সমুদ্র পেরিয়ে লঙ্কায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু সমুদ্র পার হওয়া তাঁদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। তখনই নল ও নীল নামের দুই বানরের সাহায্যে সমুদ্রের উপর একটি সেতু নির্মাণ করা হয়।
এই সেতুটি ছিল সম্পূর্ণ পাথরের তৈরি। তবে এই পাথরগুলো ভেসে থাকার মতো বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ছিল। নল এবং নীল বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন ছিলেন এবং জলের ওপর ভাসমান পাথর দিয়ে সেতুটি তৈরি করেছিলেন। বাল্মীকি রামায়ণ অনুসারে, সেতুটি তৈরির সময় বানর বাহিনী পাহাড় থেকে বিশাল আকারের পাথর সংগ্রহ করে সমুদ্রের উপর নিক্ষেপ করত। সেই পাথরগুলোই ভেসে থেকে সেতুর কাঠামো তৈরি করেছিল।
সেতুটির দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ১০০ যোজন (প্রায় ১২০০ কিলোমিটার), এবং প্রস্থ ছিল ১০ যোজন (প্রায় ১২০ কিলোমিটার)। মাত্র পাঁচ দিনের মধ্যেই এই সেতুটি নির্মিত হয়। রামচন্দ্রের আদেশে পুরো সেতুটির পরিকল্পনা ও তত্ত্বাবধান করেছিলেন নল।
সেতুর নামকরণ ও ধর্মীয় গুরুত্ব
বাল্মীকি রামায়ণে এই সেতুর নাম রাখা হয়েছিল নল সেতু। তবে মহাভারতে একে রাম সেতু হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই নামই বেশি প্রচলিত। হিন্দু ধর্মে রাম সেতু অত্যন্ত পবিত্র এবং আস্থার প্রতীক। এটি শুধু রামের লঙ্কা অভিযানের একটি স্মৃতিস্তম্ভ নয়, বরং ভক্তদের জন্য একটি আধ্যাত্মিক স্থান।
রাম সেতুর নামের সঙ্গে হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান এবং তীর্থস্থান জড়িত। রামেশ্বরম এবং ধনুষকোড়ি অঞ্চলে আজও সেতুর অস্তিত্ব সম্পর্কে মানুষের মধ্যে অগাধ বিশ্বাস রয়েছে।
রাম সেতুর বর্তমান অবস্থা: বিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণ
রাম সেতু বর্তমানে সমুদ্রের নিচে তলিয়ে আছে। তবে ১৯৯৩ সালে নাসার একটি স্যাটেলাইট ছবি এই সেতুকে নতুন করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে। ছবিতে ভারতের ধনুষকোড়ি এবং শ্রীলঙ্কার পামবান দ্বীপের মধ্যে ৪৮ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি স্থলপথ দেখা যায়। বিজ্ঞানীদের মতে, এটি প্রকৃতপক্ষে রাম সেতু।
গবেষকরা জানিয়েছেন, এই স্থলপথের পাথরের বয়স প্রায় ৭০০০ বছর, এবং যে বালির উপর এই পাথরগুলো রাখা আছে তার বয়স প্রায় ৪০০০ বছর। পাথর ও বালির বয়সের এই অসামঞ্জস্য প্রমাণ করে, এটি প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হয়নি, বরং এটি মানুষের তৈরি একটি কাঠামো।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই স্থলপথে পাথরগুলো এমনভাবে বিন্যস্ত, যা মানুষের হাতের কাজ বলেই মনে হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, পিউমিক স্টোন ব্যবহার করে এই সেতু নির্মাণ করা হয়েছিল, কারণ এই পাথর স্বাভাবিকভাবেই হালকা এবং জলের উপরে ভেসে থাকতে সক্ষম।
রাম সেতু কেন তলিয়ে গেল?
রাম সেতু কীভাবে সমুদ্রের নিচে তলিয়ে গেল, তা নিয়ে বিভিন্ন মতবাদ রয়েছে।
১. প্রাকৃতিক দুর্যোগ:
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৪৮০ সালে একটি ভয়াবহ সাইক্লোন ধনুষকোড়ি ও রামেশ্বরম অঞ্চলে আঘাত হানে। এই সাইক্লোনের কারণে রাম সেতুর একটি বড় অংশ ধ্বংস হয়ে যায়। এর ফলে সেতুটির কিছু অংশ সমুদ্রের নিচে তলিয়ে যায়।
২. সমুদ্রের জলস্তর বৃদ্ধি:
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্রের জলস্তর ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে। এর ফলে রাম সেতু সমুদ্রের কয়েক ফুট গভীরে চলে যায়।
৩. পুরাণ অনুযায়ী সেতু ধ্বংস:
কামবান রামায়ণে উল্লেখ রয়েছে, রাবণ বধের পর বিভীষণ রামের কাছে সেতুটি ধ্বংস করার আবেদন জানান। তিনি বলেন, এই সেতুটি অক্ষত থাকলে ভবিষ্যতে ভারত থেকে বারবার লঙ্কায় আক্রমণের আশঙ্কা থাকবে। বিভীষণের অনুরোধ মেনে রাম তাঁর ধনুকের তীরের সাহায্যে সেতুটিকে সমুদ্রের গভীরে ডুবিয়ে দেন।

রাম সেতু নিয়ে গবেষণা ও বিতর্ক
রাম সেতু নিয়ে বিজ্ঞানী ও গবেষকদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিতর্ক চলছে। অনেকে একে একটি প্রাকৃতিক গঠন হিসেবে দাবি করেন, আবার অনেকের মতে, এটি মানুষের তৈরি।
১. প্রাকৃতিক গঠন:
বিজ্ঞানীদের একাংশ মনে করেন, রাম সেতু একটি প্রাকৃতিক গঠন। তাঁরা দাবি করেন, সমুদ্রের তলদেশে বালি ও পাথরের গতিবিধির ফলে এই ধরনের স্থলপথ তৈরি হতে পারে।
২. মানুষের তৈরি গঠন:
আবার অনেক গবেষকের মতে, রাম সেতু একটি পরিকল্পিত স্থাপত্য। বিশেষ করে পাথরের বিন্যাস এবং তার বয়সের অমিল প্রমাণ করে, এটি একটি কৃত্রিম কাঠামো।
৩. ধর্মীয় বিশ্বাস:
হিন্দু ধর্মের অনুসারীরা বিশ্বাস করেন, এটি রামের নির্দেশে তৈরি একটি পবিত্র সেতু। তাঁদের মতে, এই সেতুর সঙ্গে ধর্মীয় বিশ্বাস এবং আধ্যাত্মিক শক্তি জড়িত।
রাম সেতু ও ভারত সরকারের উদ্যোগ
ভারত সরকার রাম সেতুকে ঐতিহাসিক স্থাপত্য হিসেবে সংরক্ষণ করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। ২০০৫ সালে রাম সেতু সংক্রান্ত গবেষণা এবং সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। বর্তমানে এটি একটি ঐতিহাসিক ধন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
রাম সেতু নিয়ে সাহিত্য ও চলচ্চিত্র
রাম সেতু নিয়ে বহু সাহিত্য রচিত হয়েছে। বিভিন্ন লেখক ও কবি তাঁদের রচনায় এই সেতুর মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। সম্প্রতি, রাম সেতু নিয়ে একটি চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে, যেখানে সেতুটির ঐতিহাসিক, ধর্মীয় এবং বৈজ্ঞানিক দিকগুলি তুলে ধরা হয়েছে।
রাম সেতুর ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
রাম সেতু শুধুমাত্র অতীতের একটি অধ্যায় নয়, এটি ভবিষ্যৎ গবেষণার জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারত এবং আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানীরা একযোগে এই সেতু সম্পর্কে আরও তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করছেন।
গবেষকরা আশা করছেন, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সেতুটির প্রকৃত নির্মাণকাল, গঠন এবং এর সঙ্গে জড়িত রহস্য উন্মোচন করা সম্ভব হবে।
রাম সেতু শুধুমাত্র একটি পুরাণ বা ধর্মীয় কাহিনি নয়, এটি ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের একটি অমূল্য অংশ। এটি একদিকে যেমন ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতীক, তেমনি অন্যদিকে এটি প্রাচীন ভারতীয় স্থাপত্যবিদ্যার সাক্ষী।
রাম সেতুর ইতিহাস, গঠন এবং তলিয়ে যাওয়ার রহস্য ভবিষ্যতেও মানুষের কৌতূহলকে জাগিয়ে তুলবে। এটি প্রমাণ করে, ভারতের অতীত কেবল গল্প নয়, বরং বিজ্ঞানের সঙ্গে ধর্মের এক অদ্ভুত মেলবন্ধন।