অভয় সিং, হরিয়ানার এক প্রতিভাবান যুবক, ছোট থেকেই স্বপ্ন দেখতেন আকাশ ছোঁয়ার। হরিয়ানার এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া অভয়ের জীবনে চ্যালেঞ্জের কোনো অভাব ছিল না। তবে তার জেদ এবং অধ্যবসায় তাকে দেশের অন্যতম সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আইআইটি বোম্বে-তে নিয়ে যায়। সেখান থেকে তিনি এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বি.টেক সম্পন্ন করেন। এই সময়ে অভয় শুধু প্রযুক্তিগত জ্ঞান অর্জন করেই থেমে থাকেননি; বরং নিজের সৃজনশীলতার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। এই সৃজনশীলতাই তাকে ডিজাইন বিষয়ে মাস্টার্স করার জন্য উদ্বুদ্ধ করে।
তবে তার এই সফলতার যাত্রা সহজ ছিল না। ছোটবেলা থেকেই তিনি শৈল্পিক আগ্রহ এবং প্রযুক্তিগত কৌতূহলের মিশেলে এক অনন্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে গড়ে ওঠেন। স্কুলের বিজ্ঞান মেলাগুলোতে তার প্রোজেক্টগুলো নিয়মিত প্রশংসা কুড়ালেও, সমাজের একাংশ তার স্বপ্নকে অবাস্তব মনে করত। কিন্তু অভয় জানতেন, তার লক্ষ্য অর্জনের জন্য তাকে নিজের সীমাবদ্ধতাগুলোকে অতিক্রম করতে হবে। আইআইটি-তে পড়ার সময়ও তিনি বহুবার ব্যর্থতার সম্মুখীন হয়েছেন। কঠিন পাঠক্রম, নতুন শহরের চ্যালেঞ্জ, এবং পরিবারের আর্থিক সীমাবদ্ধতা—সবকিছু মিলিয়ে তার ওপর চাপ ছিল প্রবল।
তবু Abhay Singhতার প্রতিটি ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়েছেন। এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় তিনি উপলব্ধি করেন, শুধু প্রযুক্তিগত দক্ষতা নয়, সৃজনশীল চিন্তাধারাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। এই উপলব্ধিই তাকে ডিজাইনের প্রতি গভীর আগ্রহী করে তোলে। ডিজাইন বিষয়ে মাস্টার্স করার সময় অভয় এমন কিছু প্রকল্পে কাজ করেন যা প্রযুক্তি ও সৃজনশীলতার মেলবন্ধন ঘটায়। তার গবেষণাগুলো শুধু ভারতের মধ্যে নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও প্রশংসিত হয়।
অভয়ের গল্প কোনো একমুখী সফলতার নয়; এটি এক আত্ম-অন্বেষণের গল্প। আইআইটি-তে পড়ার সময়ই তিনি বুঝতে পারেন যে জীবনের সঠিক পথ খুঁজে পাওয়া কেবল অর্জনের বিষয় নয়, বরং নিজের আগ্রহ ও স্বপ্নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার বিষয়। তিনি প্রমাণ করেছেন, প্রতিভা ও পরিশ্রমের সঙ্গে সৃজনশীলতা এবং আত্মবিশ্বাস যোগ হলে, জীবনের যে কোনো চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করা সম্ভব।
আজ Abhay Singh শুধুমাত্র একজন ইঞ্জিনিয়ার বা ডিজাইনার নন; তিনি একজন উদ্ভাবক, স্বপ্নদ্রষ্টা এবং প্রেরণার প্রতীক। তার জীবনযাত্রা হাজারো যুবক-যুবতীকে শিখিয়েছে যে জীবন গড়ার জন্য কেবল বড় ডিগ্রিই যথেষ্ট নয়; নিজের স্বপ্নকে খুঁজে পাওয়া এবং তা পূরণে সাহসী হওয়াই আসল।
আইআইটি বোম্বে থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন অভয় সিংয়ের জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। স্নাতকোত্তর ডিগ্রির দিনে তার সহপাঠীদের সঙ্গে তোলা ছবিটি সেই স্মৃতির এক অনন্য স্মারক, যা কেবল তার একাডেমিক অর্জন নয়, তার অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও পরিশ্রমের প্রতিফলন। তবে অভয়ের কাহিনি এখানেই শেষ হয়ে যায়নি। তার জীবন কেবলমাত্র একজন সফল প্রকৌশলী ও ডিজাইনার হয়ে ওঠার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং এটি ছিল একটি ভিন্ন পথে চলার সাহসী সিদ্ধান্ত এবং আত্ম-অন্বেষণের এক অবিস্মরণীয় যাত্রা।

আইআইটি বোম্বে থেকে পড়াশোনা শেষ করার পর, অভয় সাধারণ ক্যারিয়ার পথ বেছে নেননি। তিনি চাকরির সুযোগ থাকার পরও নিজেকে নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পথে পা বাড়ান। এক বছর ধরে তিনি একটি কোচিং ইনস্টিটিউটে ফিজিক্স পড়িয়েছেন। ছাত্রদের সঙ্গে কাজ করার সময় তার মধ্যে এক নতুন উপলব্ধি জন্মায়—জ্ঞান শুধু নিজের জন্য নয়, এটি অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমেও পূর্ণতা পায়। ফিজিক্সের কঠিন তত্ত্বগুলোকে সহজ করে পড়ানোর সময় অভয় উপলব্ধি করেন, শিক্ষার প্রকৃত অর্থ হলো ছাত্রদের অনুপ্রাণিত করা এবং তাদের মধ্যে কৌতূহল জাগানো।
এই সময়েই অভয় তার সৃজনশীল প্রতিভার আরেকটি দিক প্রকাশ করেন। পড়ানোর পাশাপাশি, তিনি লিখতে শুরু করেন। তার অভিজ্ঞতা, দার্শনিক ভাবনা এবং ভ্রমণের গল্পগুলো একত্রিত হয়ে জন্ম দেয় তার প্রথম বই “A Beautiful Place to Get Lost”। বইটি ছিল তার আত্ম-অন্বেষণের দলিল। এতে তিনি শুধুমাত্র বিভিন্ন জায়গার ভ্রমণ বিবরণী তুলে ধরেননি; বরং জীবনের গভীর দার্শনিক অর্থ খুঁজে পাওয়ার গল্পও বলেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে প্রকৃতি এবং ভ্রমণের অভিজ্ঞতা মানুষের মন ও আত্মাকে সমৃদ্ধ করতে পারে।
অভয়ের বইটি কেবল ভ্রমণপিপাসুদেরই নয়, এমন অনেকের কাছেও জনপ্রিয় হয়েছিল যারা জীবনের অর্থ খুঁজতে চায় এবং নিজের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে চায়। তার লেখার মধ্যে ছিল এক ধরনের সাদামাটা সরলতা এবং গভীর উপলব্ধি, যা পাঠকদের মনে গভীর দাগ কাটে।
তার এই পথচলা ছিল প্রচলিত সামাজিক কাঠামো থেকে সরে আসার এক ব্যতিক্রমী উদাহরণ। সাধারণত আইআইটি থেকে পাশ করা একজন ইঞ্জিনিয়ারের জন্য নির্দিষ্ট একক গতিপথ থাকে—একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে কাজ করা কিংবা গবেষণা চালিয়ে যাওয়া। কিন্তু অভয় এই গতানুগতিক পথ থেকে সরে এসে নিজের অন্তর্দৃষ্টিকে অনুসরণ করেছেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে প্রকৃত সুখ কেবল পেশাগত সাফল্যে নয়, নিজের ভেতরের স্বপ্নকে পূর্ণতা দেওয়াতেই নিহিত।
আজ অভয় শুধুমাত্র একজন ইঞ্জিনিয়ার বা লেখক নন; তিনি একজন প্রেরণাদায়ক ব্যক্তিত্ব, যিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, জীবনে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টাই হলো সবচেয়ে বড় সাফল্য। তার এই যাত্রা হাজারো তরুণ-তরুণীকে অনুপ্রাণিত করে চলেছে, যারা জীবনের প্রচলিত ছক ভেঙে নিজের পথে চলতে চায়।
মানালি থেকে ২০০০ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে চার ধাম দর্শনের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন জীবনের সহজাত সত্য। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি অকপটে স্বীকার করেছেন, “পৃথিবীতে অনেক কিছু শিখেছি, কিন্তু রান্না করাটা শিখিনি। ছোট ছোট বিষয় জানা এবং শেখা জীবনের বুনিয়াদ।” রান্নার গুরুত্ব বোঝাতে তিনি বলেন, এটি একটি মৌলিক দক্ষতা, যার অভাবকে ব্যর্থতা হিসেবে গণ্য করা উচিত।
অভয় সিং কোনো কিছুই লুকাননি। তিনি স্বীকার করেছেন তার জীবনের ভুলভ্রান্তি, গার্লফ্রেন্ডদের অভিজ্ঞতা এবং সমাজের প্রচলিত নিয়ম ভাঙার কথা। “জীবনে ঠিক-ভুল নয়, জীবন কী সেটা আগে বোঝা দরকার, আর সেটা সম্ভব কেবল অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই,” তার এই উক্তি একটি প্রজন্মের কাছে দার্শনিক শিক্ষার দৃষ্টান্ত।
তিনি আরও বলেন, “আলাদা জিনিসগুলোকে চিহ্নিত করুন, কিন্তু তুলনা করবেন না। ধর্ম, রাজনীতি বা গায়ের রং—সবকিছুতেই ভিন্নতা থাকুক, কিন্তু তাতে বৈষম্য যেন না থাকে।” তার এই বক্তব্য আমাদের শিখিয়ে দেয় সহাবস্থান ও সহনশীলতার মূল্য।
অভয় সিংয়ের জীবনের একটি বড় দিক ছিল তার সমাজবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি বলেন, “ভারতে যারা বয়সে বড় তারা ভাবে তারা বেশি জানে। এটা ঠিক নয়। বড়দের উচিত স্বীকার করা যে তারা সব জানে না।” তিনি এই মনোভাবের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে একটি মুক্তমনা এবং সমতাভিত্তিক সমাজের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন।

তার ধ্যান করার জন্য বাড়ির লোক তাকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমার মধ্যে এই পাপবোধ নেই যে আমি পালিয়েছি। বরং, তারা আমাকে তাড়িয়েছে। এতে আমার জীবন আরও সহজ হয়েছে।”
অনেকে মনে করতে পারেন, অভয় সিং তার প্রতিভা নষ্ট করেছেন। তবে বাস্তবে তিনি তার প্যাশন এবং জীবনদর্শনকে গুরুত্ব দিয়ে চলেছেন। তিনি যে সিদ্ধান্তই নিয়েছেন, তা তার জীবনের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গির প্রমাণ। নিজের জীবনকে মুক্তমনা করে তুলতে তিনি পার্থিব মায়া ত্যাগ করেছেন এবং নিজস্ব দর্শনের আলোকে জীবন কাটাচ্ছে।
অভয় সিং আমাদের শিখিয়ে দেন, জীবনের অর্থ শুধু প্রতিষ্ঠা অর্জন নয়, বরং নিজেকে খুঁজে পাওয়া। তার অকপট হাসি, জীবন উপভোগ করার ক্ষমতা এবং নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের প্রেরণা জোগায়। আমরা যদি তার মতো সমাজের প্রচলিত ধারণাগুলোর বাইরে গিয়ে নিজস্ব সত্যকে খুঁজে নিতে পারি, তবেই জীবনের প্রকৃত অর্থ উপলব্ধি করতে পারব।
অভয় সিংয়ের জীবন আমাদের শেখায়, জীবন এক অদ্ভুত যাত্রা, যা আমাদের কেবল অনুভব এবং অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই বুঝতে হবে। তার মতো করে বাঁচার সাহস আমাদের অনেকের মধ্যেই নেই, তবে তার গল্প আমাদের চিন্তার পথকে প্রসারিত করে।