এইসময়ে কেন হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ে জানেন? জেনে নিন আসল কারণ

Spread the love

বিশ্বব্যাপী শারীরিক অঙ্গগত সমস্যা গুলির মধ্যে হার্ট অ্যাটাক অন্যতম একটি বড় সমস্যা। পৃথিবীজুড়ে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ মানুষ হার্টের সমস্যার কারণে মৃত্যুবরণ করে। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, শীতকালে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি সাধারণত বেড়ে যায়। বিশেষত যাদের উচ্চ রক্তচাপ থাকে তাদের মধ্যে এই ঝুঁকি আরও বেশি থাকে। তবে কেন এমনটা হয়? এই প্রশ্নের উত্তর জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ আমাদের স্বাস্থ্য এবং জীবন রক্ষার জন্য এইসব ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন থাকা খুবই জরুরি।

শীতকালে শরীরের রক্তনালীগুলি সঙ্কুচিত হয়ে যায়, যাকে ভাসোকনস্ট্রিকশন বলা হয়। এই সঙ্কুচিত রক্তনালীর কারণে শরীরের রক্তচাপ বাড়ে, যা হৃদপিণ্ডের উপর চাপ সৃষ্টি করে। একে বলা হয় ‘লেভেল অব স্ট্রেস’। এই স্ট্রেসের কারণে শরীরের অন্যান্য অঙ্গগুলিও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলেন যে, শীতকালে হার্টের সমস্যার সম্ভাবনা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। বিশেষত উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের জন্য শীতকাল খুবই বিপজ্জনক হতে পারে।

উচ্চ রক্তচাপের কারণে রক্তনালীতে চাপ বেড়ে গিয়ে হৃদযন্ত্রে অতিরিক্ত কাজের চাপ সৃষ্টি হয়। শরীরের তাপমাত্রা কমে যাওয়ার সাথে সাথে রক্তনালীগুলি সংকুচিত হয়ে যায়, ফলে রক্তচাপ স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি হয়ে যায়। শীতকালে এটি একটি বড় ঝুঁকি হয়ে দাঁড়ায়, কারণ হৃদযন্ত্রে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হলে হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা বাড়ে।

শীতকালে যাদের উচ্চ রক্তচাপ বা হৃদরোগ রয়েছে, তাদের জন্য বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। বিশেষজ্ঞরা কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করেছেন যেগুলি শীতকালে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করতে পারে। প্রথমত, শীতকালে শরীরের তাপমাত্রা কম থাকার কারণে বাইরে বের হওয়ার সময় গরম জামা কাপড় পরা অত্যন্ত জরুরি। কারণ ঠাণ্ডা হাওয়ায় শরীরের তাপমাত্রা হঠাৎ কমে গেলে রক্তনালীগুলি সঙ্কুচিত হয়ে যেতে পারে, যা হার্টের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে।

অন্যদিকে, শীতকাল হলো কম তাপমাত্রার সময়, তাই বেশিরভাগ মানুষ বাড়ির ভিতরে থাকেন এবং শারীরিক কার্যকলাপ কমে যায়। শারীরিক কার্যকলাপের অভাব হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। বিশেষজ্ঞরা শারীরিক কার্যকলাপ বাড়ানোর জন্য নিয়মিত ব্যায়াম এবং হালকা হাঁটার পরামর্শ দেন।

শীতকালে হার্ট অ্যাটাকের অন্যান্য লক্ষণ গুলি সাধারণত গা-ছমছম, বুকে চাপ অনুভব, ঘাম হওয়া, বুকের মাঝখানে ব্যথা বা অস্বস্তি ইত্যাদি হতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে, সব ধরনের বুকে ব্যথা হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ নয়। হার্ট অ্যাটাকের ক্ষেত্রে সাধারণত ব্যথা শরীরের অন্যান্য অংশেও ছড়িয়ে যেতে পারে, যেমন চোয়াল, বাম বা ডান কাঁধ এবং পিঠেও হতে পারে।

হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি

অন্য একটি লক্ষণ হল, অনেকে শীতকালে ঘুম থেকে ওঠার পর হঠাৎ দুর্বল বা অস্বস্তি অনুভব করেন। এটি হৃৎপিণ্ডের চাপ বেড়ে যাওয়ার একটি সূচনা হতে পারে। সেই কারণে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সকালে ঘুম থেকে ওঠার আগে কিছু সময় বিশ্রাম নেওয়া উচিত। তাছাড়া, যদি কোনো ব্যক্তি হঠাৎ ঘাম, অস্বস্তি, উদ্বেগ বা ধড়ফড়ানি অনুভব করে, তাহলে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ সতর্কতা সংকেত হতে পারে।

শীতকাল এমন একটি সময়, যখন শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা কমে যায় এবং এর প্রভাব আমাদের শারীরিক সুস্থতার উপর স্পষ্টভাবে পড়ে। শীতের ঠাণ্ডা পরিবেশ শুধু শারীরিকভাবে অসুবিধা সৃষ্টি করে না, বরং এটি আমাদের হৃদযন্ত্র এবং মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যকেও বিপদে ফেলতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, শীতকালে ব্রেন স্ট্রোকের ঝুঁকি সাধারণত বেড়ে যায়, এবং এর অনেক কারণ রয়েছে যা আমাদের সচেতন হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ব্রেন স্ট্রোক তখন ঘটে, যখন মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহে বাধা আসে অথবা মস্তিষ্কের কোনো একটি অংশে রক্তনালী ফেটে যায়। এই কারণে মস্তিষ্কের কোষগুলোর পর্যাপ্ত অক্সিজেন ও পুষ্টি পাওয়া বন্ধ হয়ে যায় এবং দ্রুত ক্ষতি হতে শুরু করে। স্ট্রোকের ফলে একজন মানুষের স্বাভাবিক শারীরিক কার্যকলাপ মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হতে পারে এবং কখনও কখনও স্থায়ী অক্ষমতা হতে পারে।

শীতকালে ব্রেন স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ার অন্যতম প্রধান কারণ হলো তাপমাত্রা কমে যাওয়ার কারণে শরীরের রক্তনালীগুলির সংকোচন (ভাসোকনস্ট্রিকশন)। এই সংকোচন প্রক্রিয়ার ফলে শরীরের রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়, যা ব্রেন স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। শীতকালে আমাদের শরীর তাপমাত্রা বজায় রাখার জন্য অতিরিক্ত শক্তি খরচ করে, এবং এর ফলে শরীরের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের কর্মক্ষমতাও প্রভাবিত হতে পারে। রক্তচাপের বৃদ্ধি এবং রক্তনালী সংকোচনের কারণে মস্তিষ্কের রক্ত প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হয়, যা স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
শীতকালীন তাপমাত্রা কমে যাওয়ার ফলে শরীর রক্তনালীগুলিকে সংকুচিত করতে থাকে যাতে শরীরের তাপমাত্রা রক্ষা করা যায়। এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, তবে এর পাশাপাশি রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ায় মস্তিষ্কের রক্তনালীগুলিতে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হতে পারে, যা স্ট্রোকের কারণ হতে পারে। বিশেষত, যাদের উচ্চ রক্তচাপ বা হৃদরোগের সমস্যা রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি অনেক গুণ বেড়ে যায়।

একইভাবে, শীতকালে রক্তনালী সংকোচনের ফলে মস্তিষ্কে রক্ত প্রবাহ সীমিত হয়ে যেতে পারে, যা ব্রেন স্ট্রোকের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। তাছাড়া, শীতকালে মানুষের শারীরিক কার্যকলাপ কমে যাওয়ার ফলে রক্তের সঞ্চালনও ধীর হয়ে যায়, যা মস্তিষ্কের অন্যান্য অংশে অক্সিজেন এবং পুষ্টির সরবরাহে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
উচ্চ রক্তচাপ ব্রেন স্ট্রোকের অন্যতম প্রধান কারণ। শীতকালে রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ার ফলে উচ্চ রক্তচাপের রোগীরা বিশেষভাবে বিপদের মুখে পড়েন। উচ্চ রক্তচাপের কারণে রক্তনালীতে চাপ সৃষ্টি হয়, যা মস্তিষ্কের রক্তনালীকে দুর্বল করে দিতে পারে এবং ফেটে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়।

একটি জরুরি বিষয় হল যে, শীতকালে অনেক মানুষ বাড়ির ভিতরে থাকেন এবং শারীরিক কার্যকলাপ কমিয়ে দেন। এর ফলে তাদের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সমস্যা হতে পারে, এবং অনেক সময় তারা সচেতন হন না যে, শীতের প্রভাবের কারণে তাদের রক্তচাপ বাড়ছে।

শীতকাল আসলেই শরীরের জন্য কিছুটা কঠিন সময় হতে পারে, কিন্তু কিছু সহজ এবং কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে এই ঝুঁকি কমানো সম্ভব। বিশেষজ্ঞরা কিছু স্বাস্থ্যকর অভ্যাসের পরামর্শ দিয়েছেন যেগুলি শীতকালে আমাদের হার্ট এবং ব্রেনের সুরক্ষায় সাহায্য করতে পারে।

নিয়মিত ব্যায়াম: শীতকালে শারীরিক কার্যকলাপ কমে যেতে পারে, কিন্তু তা যেন না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। নিয়মিত হালকা ব্যায়াম, হাঁটা বা যোগব্যায়াম হার্ট এবং মস্তিষ্কের জন্য উপকারী। শীতে বাইরে বের হতে সমস্যা হলে, ঘরের ভিতরেই কিছু হালকা শারীরিক কার্যকলাপ করা যেতে পারে।
গরম জামা কাপড় পরা: শীতকালে গরম জামা কাপড় পরা খুবই জরুরি। ঠাণ্ডার কারণে রক্তনালী সংকুচিত হয়ে যেতে পারে, যার ফলে হার্টের উপর চাপ বাড়ে। সুতরাং, গরম পোশাক পরিধান করতে হবে।
হার্ট-স্বাস্থ্যকর ডায়েট: শীতকালে খাবারের প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন। উচ্চ ক্যালোরি খাবারের প্রতি প্রবণতা থাকলে তা হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। তাই শাকসবজি, ফল, উচ্চ ফাইবারযুক্ত খাবার, এবং পর্যাপ্ত প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া উচিত।

নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা: শীতকালে নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা করানো এবং হার্টের স্বাস্থ্য সম্পর্কে ডাক্তারকে জানানোর গুরুত্ব রয়েছে। বিশেষত, যাদের পূর্বে হার্টের সমস্যা ছিল, তাদের জন্য এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
মানসিক চাপ কমানো: শীতকালে শারীরিক চাপের পাশাপাশি মানসিক চাপও বাড়তে পারে। দীর্ঘ সময় একাকী থাকার কারণে বা শীতের কারণে মনমরা ভাব হতে পারে। তাই মানসিক চাপ কমানোর জন্য কিছু সময় ধরে শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যায়াম বা ধ্যান করা যেতে পারে।
শীতকালে হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে, তবে সচেতনতা এবং কিছু সতর্ক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে এই ঝুঁকি কমানো সম্ভব। বিশেষত, উচ্চ রক্তচাপ এবং হার্টের সমস্যার পেছনে থাকা ব্যক্তিদের জন্য শীতকাল হতে পারে একটি চ্যালেঞ্জ। সুতরাং, আপনার শরীরের প্রতি সচেতন থাকুন এবং শীতকালেও সুস্থ ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *