নতুন বছরের প্রথম ভাইরাল গান যদি কোনোটি হয়ে থাকে, তাহলে সেটি নিঃসন্দেহে ওড়িয়া ভাষার ‘ছিঃ ছিঃ ননী ছিঃ’। গানটি হঠাৎ করেই ট্রেন্ডে উঠে এসেছে এবং গোটা ভারতজুড়ে এটি নিয়ে চলছে ব্যাপক আলোচনা। ২০ বছর আগে প্রকাশিত এই গানটি বর্তমান প্রজন্মের মধ্যেও তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
গানটি মূলত এক প্রেমে ব্যর্থ গ্রাম্য যুবকের কষ্টের বহিঃপ্রকাশ। প্রেমিকার কাছে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার যন্ত্রণা গানের মধ্যে ফুটে উঠেছে, যা অনেকেই নিজেদের জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে পাচ্ছেন। কেউ এই গানের তালে কোমর দোলাচ্ছেন, কেউ মজার মিম বানাচ্ছেন, আবার কেউ গানটির গভীর অর্থ নিয়ে আলোচনা করছেন। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, গানটির মূল নায়ক কে? কোথায় আছেন তিনি? এখন কী করছেন?
এই গানটির যাত্রা শুরু হয় ১৯৯৫ সালে, যখন ওড়িশার একজন জনপ্রিয় সংগীত পরিচালক গানটি লিখেছিলেন এবং সুর দিয়েছিলেন। পরে ২০০৫ সালে এই গানটি ‘বালিফুল’ নামক এক অ্যালবামের আওতায় মুক্তি পায়। যদিও সেই সময় গানটি জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, তবে তা ছিল ওড়িশার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু এখন, ২০ বছর পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বদৌলতে এটি পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
গানটির ভিডিওতে অভিনয় করেছেন বিভূতি বিসওয়াল। তিনি এক সাধারণ থিয়েটার অভিনেতা, যিনি এতদিন শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু দর্শকের মধ্যেই পরিচিত ছিলেন। কিন্তু এখন, রাতারাতি তিনি হয়ে উঠেছেন জাতীয় তারকা।
বিভূতি বিসওয়াল: ভাইরাল গানের নায়কের পরিচয়
বিভূতি বিসওয়াল ওড়িশার সম্বলপুর জেলার বাসিন্দা। পেশায় তিনি একজন থিয়েটার অভিনেতা এবং নাটকের প্রতি তার ভালোবাসা দীর্ঘদিনের। তিনি একাধিক থিয়েটার দলের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন এবং পাশাপাশি আকাশবাণী সম্বলপুরের সঙ্গেও কাজ করেন। তবে অভিনয় ছাড়াও তিনি একজন শিল্প শিক্ষক (আর্ট টিচার) হিসেবে পার্ট-টাইম কাজ করেন।
২০০৫ সালে ‘ছিঃ ছিঃ ননী ছিঃ’ গানের জন্য পরিচালক মনভঞ্জন নায়ক বিভূতিকে বেছে নিয়েছিলেন। তার সহজ-সরল চেহারা ও বাস্তবসম্মত অভিনয় দেখে পরিচালকের মনে হয়েছিল, তিনিই চরিত্রটির জন্য সঠিক ব্যক্তি। যদিও বিভূতির আগে কোনো মিউজিক ভিডিওতে কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিল না, তবে তিনি তার স্বাভাবিক অভিনয় দক্ষতা দিয়েই চরিত্রটিকে বাস্তব করে তুলেছিলেন।
গানটি যখন প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল, তখন স্থানীয় পর্যায়ে কিছুটা জনপ্রিয়তা পেলেও এটি কখনোই মূলধারার জনপ্রিয়তা পায়নি। কিন্তু ২০২৪ সালে, হঠাৎ করেই গানটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায়। বিভূতি নিজেও এতদিন ক্যামেরার সামনে বড়ভাবে আসেননি, তাই যখন তিনি দেখলেন তার পুরনো একটি কাজ কোটি কোটি ভিউ পাচ্ছে, তখন তিনি অবাক হয়ে গিয়েছিলেন।
কেন ভাইরাল হলো এই গান?
বর্তমানে ইন্টারনেটের যুগে পুরনো গানও নতুন করে জনপ্রিয় হতে পারে, এর আগেও এমন ঘটনা ঘটেছে। তবে ‘ছিঃ ছিঃ ননী ছিঃ’ কেন এত ভাইরাল হলো, তা বোঝার জন্য কয়েকটি কারণ দেখা যেতে পারে—
- গানের আবেগ ও কাহিনি: গানের মধ্যে রয়েছে এক ব্যর্থ প্রেমিকের আক্ষেপ, যা অনেকেই নিজের জীবনের সঙ্গে মেলাতে পারছেন।
- সাধারণ ও বাস্তব ভিডিও: বিভূতি বিসওয়ালের সরল অভিনয় এবং গানটির গ্রামীণ প্রেক্ষাপট এটিকে আরও বেশি আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
- সোশ্যাল মিডিয়ার শক্তি: ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুক ও ইউটিউবে যখন কেউ এই গানটি রিমিক্স করে আপলোড করতে শুরু করলো, তখনই এটি দ্রুত ভাইরাল হতে থাকে।
- মিম কালচার: বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ায় মিম তৈরির একটি বড় ট্রেন্ড রয়েছে। এই গানটি সহজেই মিম তৈরির জন্য উপযুক্ত ছিল, ফলে এটি আরও দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
এতদিন তিনি থিয়েটারের মঞ্চে অভিনয় করলেও বড় পরিসরে তাকে তেমন কেউ চিনত না। কিন্তু এখন, এই একটি গানই তাকে রাতারাতি পরিচিত করে তুলেছে। এই প্রসঙ্গে বিভূতি বিসওয়াল বলেন—
“আমি কখনো ভাবিনি, ২০ বছর আগের একটা কাজ আমাকে এমনভাবে পরিচিত করে তুলবে। আমি খুবই আনন্দিত, একইসঙ্গে অবাক। আমি এখনো থিয়েটারেই কাজ করি, আর সেটাই করতে চাই। কিন্তু এই ভালোবাসা সত্যিই অবিশ্বাস্য।”
গানটি নতুনভাবে ভাইরাল হওয়ার কারণে অনেকেই আশা করছেন, এটি নিয়ে হয়তো নতুন কিছু করা হতে পারে।
- কেউ কেউ বলছেন, গানটির নতুন সংস্করণ তৈরি করা যেতে পারে, যেখানে বিভূতি বিসওয়াল আবার অভিনয় করবেন।
- বলিউড বা দক্ষিণ ভারতীয় ইন্ডাস্ট্রির কোনো সংগীত পরিচালক যদি এই গানটির রিমেক করেন, তাহলে সেটি আরও বড় পরিসরে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
- বিভূতি বিসওয়াল যদি অভিনয় জগতে আরও সক্রিয় হন, তাহলে তাকে নতুন কোনো ওয়েব সিরিজ বা সিনেমায় দেখা যেতে পারে।
এখনকার দিনে ভাইরাল কনটেন্ট মানেই শুধু গান শোনা নয়, বরং সেটি নিয়ে বিভিন্ন ধরনের ভিডিও ও মিম তৈরি হয়।
- ইনস্টাগ্রামে বহু মানুষ এই গানের তালে নাচছেন।
- ফেসবুকে নানা মজার পোস্ট ও কমেন্টের মাধ্যমে গানটি নিয়ে মজার আলোচনা চলছে।
- কেউ কেউ আবার গানের গভীর অর্থ নিয়ে চিন্তা করছেন এবং এটিকে বাস্তব জীবনের ঘটনার সঙ্গে মিলিয়ে দেখছেন।
গানটি শুধুমাত্র একটি ট্রেন্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি এটি দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলবে, সেটিই এখন দেখার বিষয়।
‘ছিঃ ছিঃ ননী ছিঃ’ গানটি আমাদের শিখিয়ে দিল যে, একটি সৃষ্টিকর্ম কখন জনপ্রিয়তা পাবে, তা বলা যায় না। ২০ বছর আগে করা একটি কাজ হঠাৎ করেই ভাইরাল হতে পারে এবং একজন সাধারণ থিয়েটার অভিনেতাও রাতারাতি তারকা হয়ে যেতে পারেন।
বিভূতি বিসওয়ালের গল্পটি শুধুমাত্র বিনোদন দুনিয়ার জন্য নয়, বরং সাধারণ মানুষের জন্যও একটি শিক্ষা— কঠোর পরিশ্রম ও ভালো কাজ কখনোই হারিয়ে যায় না। সময়মতো সেটি মানুষের ভালোবাসা পাবেই!