মহাকুম্ভ মেলা শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় সমাবেশ নয়, এটি বিশ্বব্যাপী অন্যতম বৃহত্তম মানবসমাগমের একটি ঘটনা। প্রতি ১২ বছর পর পর ভারতের প্রয়াগরাজে (আগের নাম এলাহাবাদ) অনুষ্ঠিত হয় এই মহামেলা, যেখানে দেশ-বিদেশ থেকে কোটি কোটি মানুষ অংশ নেয়। কিন্তু এই বিশাল আয়োজন শুধু আধ্যাত্মিক দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং এটি ব্যবসা ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও এক অসাধারণ উদাহরণ। ভারতের অন্যতম শীর্ষ ধনী গৌতম আদানি এবারের মহাকুম্ভে অংশ নিয়ে এই শিক্ষাই নিয়েছেন।
তিনি মনে করেন, মহাকুম্ভ শুধু ধর্মীয় গন্তব্য নয়, এটি এক বিশাল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও বটে। এত বিশাল জনসমাগম, এত বড় পরিকাঠামো, অথচ নেই কোনো কর্পোরেট বোর্ড মিটিং, নেই কোনো পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন, নেই কোনো ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট। তবুও কীভাবে এত নিখুঁতভাবে পরিচালিত হয় এই আয়োজন? আদানি বলছেন, এখান থেকেই ব্যবসার গুরুত্বপূর্ণ পাঠ নেওয়া সম্ভব।
মহাকুম্ভে আদানির অভিজ্ঞতা
গৌতম আদানি সম্প্রতি তাঁর পরিবারের সঙ্গে কুম্ভ মেলায় অংশ নেন এবং নিজের অভিজ্ঞতা একটি ব্লগ পোস্টে শেয়ার করেন। তিনি জানান, কুম্ভ মেলা সম্পর্কে জানার পর থেকেই তিনি এর বিশালতা নিয়ে বিস্মিত ছিলেন। তবে সরাসরি অংশ নেওয়ার পর তিনি উপলব্ধি করেন, এটি শুধু একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং এটি ব্যবস্থাপনা, নেতৃত্ব এবং টেকসই উন্নয়নের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
তিনি বলেন, “আমাদের আদানি গ্রুপ বন্দর, বিমানবন্দর, এনার্জি পার্ক তৈরি করে। কিন্তু আমাদের পূর্বপুরুষেরা কুম্ভের মাধ্যমে এক আধ্যাত্মিক কাঠামো গড়ে তুলেছেন, যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে টিকে আছে। এটি কেবলমাত্র বিশ্বাসের শক্তি নয়, বরং এটি একটি সুগঠিত পরিকল্পনা ও পরিচালনার শক্তিরও প্রতিফলন।”
বিশ্বের বৃহত্তম অস্থায়ী শহর!
গৌতম আদানি কুম্ভ মেলার বিশালতা সম্পর্কে বলেন, প্রতি ১২ বছর পর ভারতের প্রয়াগরাজে এক অস্থায়ী শহর গড়ে ওঠে, যার আকার নিউইয়র্ক শহরের চেয়েও বড়। কয়েক মাসের জন্য এখানে কোটি কোটি মানুষ অবস্থান করেন, অথচ প্রতিটি কাজ অত্যন্ত সুচারুভাবে সম্পন্ন হয়।
বিশ্বের অন্যতম সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল পর্যন্ত কুম্ভ মেলার লজিস্টিকস ব্যবস্থাপনা নিয়ে গবেষণা করেছে। কীভাবে মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে এত বড় একটি শহর তৈরি হয় এবং কীভাবে এত বিশাল জনসমাগমকে সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনা করা হয়, তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন গবেষকরা।
কী শেখার আছে ব্যবসায়ীদের?
গৌতম আদানি তাঁর ব্লগে উল্লেখ করেছেন যে, কুম্ভ মেলা থেকে যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ব্যবসায়ীদের শেখা উচিত, তা হলো:
- বড় চিন্তা করুন: কুম্ভ মেলা আমাদের শেখায় যে, ছোট পরিকল্পনা করলে ছোট ফলাফল আসে। তবে যদি আমরা বড় চিন্তা করি এবং বৃহৎ পরিসরে পরিকল্পনা করি, তাহলে সাফল্য আরও বড় হতে পারে। ব্যবসার ক্ষেত্রেও এই নীতি গুরুত্বপূর্ণ।
- সকলকে সঙ্গে নিয়ে চলুন: কুম্ভ মেলায় ধর্ম, বর্ণ, ভাষা নির্বিশেষে সবাই অংশ নেয়। এখান থেকে বোঝা যায়, ব্যবসাতেও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি (Inclusive Growth) জরুরি। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলতে পারলে সাফল্য দীর্ঘস্থায়ী হয়।
- কঠোর পরিশ্রম ও পরিকল্পনা: বিশাল জনসমাগম, অস্থায়ী শহর, বিশুদ্ধ খাবার ও পানীয়ের ব্যবস্থা, বিশাল নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা—এগুলো সম্ভব হয় কঠোর পরিশ্রম ও নিখুঁত পরিকল্পনার মাধ্যমে।
- পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া: কুম্ভ মেলা প্রতি ১২ বছর পর হয়, কিন্তু প্রতিবারই এটি নতুনভাবে আয়োজন করা হয়। ব্যবসায়ও ঠিক তেমনই, পরিবর্তন আসবেই, কিন্তু নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া এবং নতুন পদ্ধতি গ্রহণ করাই সফলতার মূলমন্ত্র।
- কোনো কিছুই অসম্ভব নয়: যদি মাত্র কয়েক মাসের পরিকল্পনায় নিউইয়র্ক শহরের চেয়েও বড় একটি অস্থায়ী শহর গড়ে তোলা সম্ভব হয়, তাহলে ব্যবসায়ও যে কোনো বড় লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব, যদি সঠিক পরিকল্পনা ও পরিশ্রম থাকে।
অর্থনীতির আধ্যাত্মিক দিক
গৌতম আদানি বলেন, কুম্ভ মেলার একটি বিশেষ দিক হলো ‘অর্থনীতির আধ্যাত্মিক স্কেল’। এটি দেখায় যে, কোনো উদ্যোগ যদি সঠিকভাবে পরিচালিত হয়, তাহলে তা ক্রমাগত বড় হতে পারে।
তিনি বলেন, “কুম্ভ মেলা আমাদের শেখায়, টেকসই উন্নয়ন এবং পরিবেশবান্ধব পরিকল্পনা কেমন হওয়া উচিত। এটি সার্কুলার ইকোনোমির (Circular Economy) একটি আদর্শ উদাহরণ।”
ভারতের সফট পাওয়ার ও সংস্কৃতির গুরুত্ব
গৌতম আদানি মনে করেন, কুম্ভ মেলা শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি ভারতের সবচেয়ে বড় সফট পাওয়ারও বটে। তিনি বলেন, “আমরা আজ ডিজিটাল উদ্ভাবন নিয়ে অনেক এগিয়েছি, কিন্তু কুম্ভ আমাদের শেখায়, কীভাবে মানবিক সম্পর্কের ব্যবস্থাপনা করতে হয়। এটি আমাদের শিকড়ের সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে শেখায়।”
তিনি আরও বলেন, “বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় হুমকি হলো মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা। কিন্তু কুম্ভ আমাদের দেখায়, কীভাবে মানসিক ও আধ্যাত্মিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যেতে হয়। এটি আমাদের আত্মপরিচয় এবং সংস্কৃতির প্রতি গর্বিত করে।”
১০ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির পথে ভারত
গৌতম আদানি মনে করেন, ভারত এখন ১০ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির দিকে এগোচ্ছে। সেখানে কুম্ভ মেলা অন্তর্ভুক্তিমূলক বৃদ্ধির একটি বাস্তব উদাহরণ। এখানে রাজনীতিবিদ, শিল্পপতি, সাধারণ মানুষ, বিদেশি পর্যটক—সবাই একসঙ্গে অংশ নেয়। তিনি বলেন, “একটি সফল দেশ গড়তে গেলে ব্যবসায়িক বৃদ্ধি যেমন দরকার, তেমনি প্রয়োজন ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সকলকে সঙ্গে নিয়ে চলার মানসিকতা।”
কেন কুম্ভ মেলা ব্যবসার জন্য গুরুত্বপূর্ণ?
কয়েক কোটি মানুষের উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও এখানে বিশৃঙ্খলা নেই। এটি পরিচালনার ক্ষমতা দেখিয়ে দেয়, বিশাল ব্যবসা পরিচালনার Adjective কীভাবে পরিকল্পনা করা উচিত। কুম্ভে বিভিন্ন জাতি, ধর্ম, ভাষার মানুষ একত্রিত হয়, যা বোঝায় বৈচিত্র্যকে গ্রহণ করাই হলো সফলতার মূলমন্ত্র।
কুম্ভে প্রচলিত ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে নতুন কৌশল অবলম্বন করা হয়। একইভাবে, ব্যবসায়ও উদ্ভাবনী চিন্তাধারার প্রয়োজন হয়।
কুম্ভের মূল উদ্দেশ্য আত্মিক উন্নতি, যা একজন ব্যবসায়ীর ক্ষেত্রেও জরুরি। সফল ব্যবসায়ী হতে হলে শুধু লাভের কথা ভাবলে হবে না, সামাজিক দিকও বিবেচনা করতে হবে।