শহর কলকাতা, শহরতলি, পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সব জেলা, পশ্চিমবঙ্গের বাইরে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ, ভারতের বাইরেও বহু দেশে ধ্বনি উঠেছে— ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস!’
হল কী? মিছিল বা অবস্থানের জন্য অফিস টাইমে বাস মাঝপথে আটকে গেলেও বাসের যাত্রীরা আন্দোলনকারীদের গালমন্দ করছেন না! বরং চটপট বাস থেকে নামতে নামতে বলছেন, এটুকু হেঁটে চলে যাব, কিছু হবে না। মর্নিং স্কুল ফেরত কাঁধে ভারী ব্যাগ ছেলে যদি বলে, বাবা রে! এত হাঁটতে পারব না আমি, সঙ্গের অভিভাবিকা তাঁর বাবাইসোনার কষ্টে মুখর হয়ে উঠছেন না। বলছেন, ঠিক পারবে। দাদা-দিদিগুলো এত কষ্ট করছে, আর একদিন এইটুকু হাঁটতে পারবে না তুমি? পথের মিছিলের সঙ্গে জীর্ণ বাড়ির দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে এমন উদ্যমে গলা মেলাচ্ছেন সত্তর পেরনো পাঁচ-ছ’জন মহিলা, তাঁদের শরীরের এতখানিই ঝুঁকে বেরিয়ে আছে ফাটল-ধরা বারান্দার পুরনো রেলিংয়ের উপর দিয়ে, যে প্রত্যক্ষদর্শী মনে মনে ভাবছেন, বিপদ না হয় ওঁদের!
দেশের সাতাত্তরতম স্বাধীনতা দিবসের সূচনালগ্নে রাত দখলের ডাক দিয়েছিলেন যাঁরা, তাঁরা কোনও বিশেষ দলের বা বিশেষ বর্ণের নন। তাঁরা নিজেরাও বোধ করি ভাবেননি, হুইলচেয়ারে বসা অশীতিপর বৃদ্ধা, অক্সিজেন মাস্ক-পরা অসুস্থ বৃদ্ধ রাতের পথে বেরিয়ে আসবেন! সাত থেকে সত্তর বছরের মানুষ ১৪ অগস্টের রাত পেরিয়ে একদিন থেকে প্রতিদিনের মিছিলে শামিল হবেন। তাঁদের গলা মিছিলের অভ্যস্ত কন্ঠ নয়, তাঁদের হাতের মোমবাতি কিংবা টর্চ অথবা মোবাইল মিছিলে জ্বলেনি এর আগে।
শহর কলকাতা, শহরতলি, পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সব জেলা, পশ্চিমবঙ্গের বাইরে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ, ভারতের বাইরেও বহু দেশে ধ্বনি উঠেছে— ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস!’ যা কিছু অনর্থ ঘটে যাক, আমাদের দৈনন্দিন জীবিকা-জীবন, বর্তমান-ভবিষ্যতের নিরাপত্তা, পরের প্রজন্মের শুভ-অশুভ, এই সব আগলে আগলে দোরগোড়ায় শব নিয়ে ঘুমোতে যাওয়া অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল আমাদের। ‘নেই’ হয়ে থাকাটাই যে নিরাপদ গোছানো জীবনের সোনার কাঠি! এই মন্ত্রদীক্ষায় ছেলেপুলেকে স্কুলে পাঠানোর আগে বলি, কলম থেকে রং পেন্সিল, ওয়াটার বটলের জল থেকে টিফিন বক্সের ডিম-পরোটা, কিছুর ভাগ অন্যকে দেবে না। যত বড় বিপর্যয় যেখানেই ঘটুক, তা নিয়ে বিচলিত হবে না, এগিয়ে যাবে না, হাত বাড়িয়ে দেবে না। তো সেই আমাদের হঠাৎ হল কী? হঠাৎ কি মনে হল মধ্যবিত্ত গৃহস্থের যে, সব হত্যার সব রক্তই শেষ পর্যন্ত নির্বিরোধী গৃহস্থের চৌকাঠে এসে মেশে?
আসলে ঘটনাটা সম্ভব-অসম্ভবের ভেদরেখা লোপাট করে দিয়েছিল সংবাদপত্রের পাঠকের, টেলিভিশনের দর্শকের, সামাজিক মাধ্যমে অংশগ্রহণকারীর মন থেকে, চিন্তা থেকে। এখন তো সমাজ মনের এমনই হাল যে, ধর্ষণের খবর, ধর্ষণোত্তর হত্যার খবর সে মনে এক রকমের প্রতীক্ষা জাগায়। কবে রাষ্ট্র বলবে ধর্ষিতার (অনেক ক্ষেত্রে মৃতারও বটে) চরিত্রের গোলমাল ছিল, বিবাহ-বহির্ভূত বা অভিভাবক-অননুমোদিত সম্পর্কের সুবাদে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে সে আত্মঘাতী; অথবা, মেয়েরা রাতে এমনকি, দিনেও পথে বেরোলে ও রকম একটু-আধটু ‘দুষ্টুমি’ ছোট ছেলেরা করেই থাকে। দেশের রাজধানীতে গণ যানবাহনে কোনও মেয়ের চরম অসম্মান, শ্লীলতাহানি, এমনকি, মৃত্যু ঘটলেও মেয়েটির সাজপোশাককে দোষারোপ করা যায়। সন্ধ্যার পর মহানগরীর বিনোদন প্রধান অঞ্চলে ঘটলে তো রাষ্ট্রের হাতের মুঠোয় থাকে আক্রান্ত মহিলার চরিত্র বা মানসিকতা নিয়ে মন্তব্যের অধিকার!
কিন্তু সরকারি হাসপাতালে কর্মরতা এক চিকিৎসক, যাঁর নাকি এম ডি পাঠক্রমের ‘ফাইনাল ডিসার্টেশন’ লেখা হয়ে গিয়েছে, যিনি পরীক্ষায় সোনার পদক পাওয়ার আশা রাখেন, তিনি যদি কর্মরত অবস্থায় খুন হন তাঁর কর্মস্থলের ভিতরে, সেই নির্যাতিতা বা মৃতাকে অবিরত চেনামুখের নির্বিশেষ একজন ভাবতে, তাঁর চরিত্র বা মানসিকতা প্রসঙ্গে প্রশ্ন তুলতে মন আর কন্ঠ একটু হলেও কেঁপে কেঁপে ওঠে
সেই কাঁপুনি অবশ্য প্রশাসনের নয়। যাঁরা ভোট দিয়ে অথবা না-দিয়ে বর্তমান প্রশাসনকে নির্বাচিত করেছেন, তাঁদের। মৃতার মা-বাবা সর্বপ্রথম যে ফোন পান, তার খবর ছিল, ওঁদের মেয়ে অসুস্থ। পরের খবর, সে আত্মহত্যা করেছে। পাশাপাশি, কর্মরত অবস্থায় ডাক্তার ঘুমোবে কেন, সেমিনার রুমে ‘একা’ ঘুমোতে যাবে কেন, ইত্যাদি প্রশ্ন সরকারি হাসপাতাল প্রশাসনের তরফে। তার পরে পরম বদান্যতায় মেয়েটির জীবনের মূল্য নির্ধারিত হবে ১০ লক্ষ টাকা। নিতান্ত সাধারণ আর্থিক অবস্থানের মা-বাবা সে টাকা প্রত্যাখ্যান করলে হুঙ্কার শোনা যায়, কেউ কোনও টাকা ‘অফার’ করেনি। এ সব বানানো কথা। পারলে প্রমাণ করুন।
নিদারুণ যন্ত্রণা পেয়ে মরে যাওয়ার পরেও কত অসম্মান পাওনা থাকে এক নারীর আর তার দেহের! দুর্নীতিতে সহযোগিতা করতে না-চাওয়া, পুঞ্জীভূত দুর্নীতির কথা নিয়ে সরব হওয়া বা সরব হওয়ার আস্ফালন, এ বোধহয় আজ নারী-পুরুষ নির্বিশেষে খুন হয়ে যাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট অপরাধ। নারীর বাড়তি অসম্মান হলো শ্লীলতাহানি, ধর্ষণ এ সবের একটা বিশ্বাসযোগ্য গল্প নির্মাণ। যে নির্মাণ মনুষ্যদেহ বিশেষজ্ঞদের পক্ষে তুলনায় সহজ! যে নির্মাণের ফলে প্রশ্ন তোলা সহজ হয়, কোন উদ্দেশ্যে কর্মরতা মহিলা ডাক্তার বিশ্রাম নিতে যাবেন। কেনই বা তিনি সেমিনার কক্ষে ‘একা’ শোবেন! বিশ্বজুড়ে মানুষ কেঁপে উঠেছে। সে কাঁপুনি থামেনি গত দেড় মাসে। ডাক্তারদের সঙ্গে সাধারণ দেশবাসীর সহযোগ জনজাগরণের চেহারা নিয়েছে। কুমোরপাড়ার পোটোরা, নৌকার উপরে জেলেরা, সুইগি-জোম্যাটোর জোগানকর্মীরা, রিকশা চালকেরা, অবসরপ্রাপ্ত সেনা-প্রশাসকেরা, শিক্ষক সংগঠনের সদস্যরা, শিল্পীরা আলাদা আলাদা মিছিল করেছেন। বলেছেন আছি, আমরা আছি। শুধু বলা নয়, যাঁদের নাম সচরাচর দেখা যায় না সংবাদপত্রে বা সামাজিক মাধ্যমের দেওয়ালে, তেমন কতজন নিজের নিজের একদিনের উপার্জন পাঠিয়ে চিকিৎসকদের আন্দোলনে শামিল হতে চেয়েছেন। কিন্তু যে বেওকুফ চিকিৎসক আজকের জমানায় দাঁড়িয়ে ভেবেছিলেন, নিজের ক্ষেত্রবিশেষে নিছক নিজের মেধা-ব্যুৎপত্তি-কর্মক্ষমতা সম্বল করে ‘নেই’ হয়ে না থাকার কথা, তাঁর খুনের বিচার কি কোনওদিন শেষ হবে? এই যে আজ প্রশ্ন উঠছে, মেয়েটিকে হত্যা করে তার শবদেহকে ধর্ষণ করা হল, নাকি ধর্ষণের পরে মরল সে, এই প্রশ্নের ভিতরেই যে অকথ্য অসম্মান নিহিত আছে, তার বিচার কোন আইনে মিলবে?
প্রতিনিয়ত চেষ্টা চলছে প্রতিবাদকে, প্রতিবাদীকে বিভ্রান্ত করবার। সেই প্রথম দিন থেকে। শোনা গেল, খুবই দুঃখজনক ঘটনা, কিন্তু এমন ঘটনাকে রাজনীতির রঙে কালিমালিপ্ত করা চলবে না। যেন আরও কালিমা লেপন করা যায়, এমন ঘটনাই ঘটেছে! যেন সরকারি হাসপাতালে একজন কর্মরতা চিকিৎসককে নির্যাতন আর হত্যা সম্ভব হতে পারে রাজনীতির মদত ছাড়া! যত দুর্নীতির প্রসঙ্গ গত প্রায় দেড়মাস ধরে শোনা যাচ্ছে, তা যেন রাজনীতির বাইরের বস্তু! শাস্তিমূলক স্থানান্তরের ফলে পরিকাঠামোয় জীর্ণ-দীর্ণ এক সরকারি হাসপাতালে গিয়ে পড়া এক ডাক্তারবাবু সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন, যবে থেকে তিনি আনুষঙ্গিক দুর্নীতির কথা বলছেন, তখন থেকেই যদি কথাগুলো কানে তুলতেন দেশবাসী, তবে হয়তো এই মর্মান্তিক প্রাণনাশ ঘটত না। বলা বাহুল্য, ওই সব কথা ডাক্তারবাবুটির বদলি ছাড়া আর খুব কিছু ঘটায়নি।
দ্বিতীয়ত, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ ধ্বনি তুলে যত মিছিল বেরোচ্ছে, তার সবগুলোই কি ‘জাস্টিস’-এর অভিন্ন সংজ্ঞা বহন করছে? ‘বিচার চাই’ বা ‘ন্যায়বিচার চাই’ তো আপাত উচ্চারণে অতি নির্দোষ চাওয়া। তার আড়ালে কি পর্বতপ্রমাণ দুর্নীতির বিরুদ্ধাচরণ করার মতো অন্যায্য দুঃসাহসের বিচারও চাওয়া হচ্ছে? অথবা সেই দুঃসাহসের সহযোগে দাঁড়িয়েছেন যাঁরা, তাঁদের বিচার? এ প্রশ্ন না উঠে পারে না। কারণ, প্রথম রাত দখলের রাতে আরজি কর হাসপাতালে ঢুকে ভাঙচুর করেছিলেন যাঁরা, তাঁরাও কি প্রতিবাদীর ছদ্মবেশ ব্যবহার করেননি? ‘এক মাসে অনেক প্রতিবাদ হয়েছে, এ বার উৎসবে ফিরুন’–এর বাণী যাঁদের মরমে পশেছে, রাত ১১টা পর্যন্ত পাড়ার মোড়ে যাঁরা প্রায় সাতদিন ধরে গণপতি বন্দনার নামে হুল্লোড় করেছেন, তাঁদের কি কোনও মিছিলে ন্যায়বিচার চাইতে দেখা যায়নি? পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে ন্যায়বিচারের সব ধর্নামঞ্চ কি খুনের বিচার চাইছে? নাকি ওরই মধ্যে ‘জাস্টিস’-এর ভিতরে ভিতরে ‘ইতি গজ’ অনূক্ত আছে? প্রতিবাদ যাপনকে উদ্যাপনের হুজুগে ভাসতে দিলে পরস্পরবিরোধী মিছিল তালেগোলে মিশে গেলে অশেষ যন্ত্রণা পেয়ে মরে যাওয়া মেয়েটির অসম্মান বেড়ে চলে।
সেই দিকেই কি যাচ্ছি আমরা? ভবিষ্যতের জন্য শর্ত দেওয়ানেওয়ায় কোথাও কি চাপা পড়ে যাচ্ছে হত্যাকারীর শাস্তির প্রসঙ্গ? যে ব্যবস্থায় এমন এক হত্যাকাণ্ড ঘটে গেল, সেখানে গুটিকতক বদলি কি ব্যবস্থাকে বদলে দিতে পারে? একদিকে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের সময় জুড়ে সরকারি হাসপাতালে রোগীর মৃত্যুর পরিসংখ্যান সাজিয়ে তাঁদের দায়িত্বের কথা মনে করানো হচ্ছে, কিন্তু দেওয়া হচ্ছে না কোনও আপেক্ষিক হিসাব যে, গতবছর কি তার আগের বছর এই এক সময়সীমার মধ্যে কোনও আন্দোলন ছাড়াই কত রোগীর মৃত্যু হয়েছিল! অন্যদিকে হঠাৎ শোনা গেল, এবার থেকে সব মেডিকাল কলেজে ‘আইসি’ অর্থাৎ ‘ইন্টারনাল সেল’ করতেই হবে! ‘বিশাখা গাইডলাইন্স’ অনুযায়ী কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষাক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তার জন্য ২০১৮ সাল থেকে প্রতিটি কাজের জায়গায় ‘ইন্টারনাল কমপ্লেন সেল’ (আইসিসি, সম্প্রতি যার নাম বদলে হয়েছে ইন্টারনাল সেল বা আইসি) আবশ্যিক। মেডিক্যাল কলেজগুলির একটিতেও তা এতদিন তবে ছিল না? সেগুলো কি কাজের জায়গা ছিল না এতদিন? ভারত জুড়ে যে নিয়ম আবশ্যিক, তার থেকে ছাড় পেল কী করে মেডিক্যাল কলেজগুলি? এমন কত বেনিয়ম এই মর্মান্তিক মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সামনে আসবে কে জানে! বেনিয়মগুলো সারিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতিতেই কি আন্দোলনের দাবি মিটে যাবে? এত দুর্নীতি চলল কী করে, মেয়েটা মরল কী করে, কোন বেনোজলে তার খুনের প্রমাণ ভেসে গেল— এই প্রশ্নগুলো কি উন্নত ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতিতে হারিয়ে যাবে? আর কী সেই উজ্জ্বল অনাগত দিন? যেখানে মেয়েদের কাজের সময়ে ঘের দেওয়া, তাদের সহকর্মীর আদলে শর্ত আরোপ করাই নাকি নিরাপত্তার একমাত্র উপায়? আর কত অসম্মানে সাজানো হবে ভবিষ্যৎকে?
বাঙালির শারদোৎসব এগিয়ে আসছে ক্রমশ। পুজো কমিটিরা কেউ কেউ সরকারি অনুদান না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রশাসন বলেছেন, কুছ পরোয়া নেই। যাঁরা নেবেন না, তাঁরা নেবেন না। নতুন পুজো কমিটিদের দেওয়া হবে। এই উৎসবের উপরে যাঁদের জীবিকা-জীবন অনেকখানি নির্ভর করে, তাঁদের রুজিতে টান পড়লে বিপদ নিশ্চয়। কিন্তু এ বারের শারদোৎসবে মিশে থাকবে কি সেই বিষাদ যে, উৎসবের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে সুস্থ, সবল, যোগ্য সন্তানকে এমন কদর্য ভাবে হারিয়েছেন যে মা-বাবা, তাঁদের সাত-সাতটি ন্যায্য প্রশ্নের একটিরও জবাব মেলেনি আজও। কোন ভিতের উপর তৈরি হবে জুনিয়র ডাক্তারদের ভবিষ্যৎ? এ বারের শারদোৎসব উদ্যাপনে কি নিহিত থাকবে কোনও নতুন যাপনের অঙ্গীকার?