দক্ষিণ ভারতীয় ভদ্রলোকটির মনে তখন এই একটি নয়, প্রচুর প্রশ্ন গিজগিজ করছে। ১৯৫৫ সালে বাইশ বছর বয়সে কেরল থেকে কলকাতায় এসেছিলেন পরমেশ্বরন থনকপ্পন নায়ার। পকেটে মাত্র কুড়ি টাকা, স্কুলের পড়াশুনোর সঙ্গে টাইপ আর শর্টহ্যান্ডটা জানা আছে, কিন্তু এ শহরে তাঁর কোনও মুরুব্বি নেই।
পরমেশ্বরন থনকপ্পন নায়ার। নামটি শুনলে চট করে বোঝার উপায় নেই যে এই মানুষটি কলকাতার ইতিহাসের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। একজন দক্ষিণ ভারতীয় হয়ে তিনি কলকাতাকে এমনভাবে বুঝেছেন, যা অনেক বাঙালিও ভাবেননি। তাঁর গল্প শুরু হয়েছিল ১৯৫৫ সালে, যখন মাত্র বাইশ বছর বয়সে তিনি কেরল থেকে কলকাতায় এসে পৌঁছান। পকেটে ছিল মাত্র কুড়ি টাকা। স্কুলের শিক্ষার সঙ্গে টাইপ আর শর্টহ্যান্ডের জ্ঞান থাকলেও এ শহরে তাঁর কোনও আত্মীয়-পরিজন ছিল না। অথচ এই শহরই একদিন তাঁর জীবন হয়ে উঠল।
কৈশোর থেকেই নায়ারের মধ্যে ছিল ইতিহাসের প্রতি অদম্য কৌতূহল। কলকাতায় এসে তিনি প্রথমে একটি টাইপিস্টের চাকরি নেন। তাতে অবশ্য তাঁর মনে তেমন তৃপ্তি আসেনি। ট্রামে চড়ে আর পায়ে হেঁটে তিনি ঘুরে বেড়াতেন শহরের নানা কোণায়। কলকাতার গলি-ঘুঁজি, পুরনো বাড়ি আর সরু রাস্তা—সবকিছু যেন তাঁকে হাতছানি দিত। শহরটাকে জানতে, বুঝতে শুরু করলেন।
এই ঘোরাঘুরির মধ্যেই একদিন তাঁর মনে এল একটি প্রশ্ন—উত্তর কলকাতার কোনও একটি রাস্তাকে “ওল্ড মেয়র্স কোর্ট” বলা হল কেন, যখন মেয়র্স কোর্ট সাহেবপাড়াতেই ছিল? তিনি এই প্রশ্ন তুলে পাঠান স্টেটসম্যান পত্রিকায়। প্রশ্নটি পড়ে খ্যাতনামা গবেষক রাধারমণ মিত্র চমকে যান। তাঁর মন্তব্য ছিল, ‘‘এ প্রশ্ন একজন বাঙালির পক্ষেই স্বাভাবিক, কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে তা তুললেন একজন অবাঙালি।’’ এই একটি প্রশ্নই কলকাতার প্রতি নায়ারের গভীর আগ্রহের পরিচয় দিয়েছিল।
ন্যাশনাল লাইব্রেরি ছিল তাঁর দ্বিতীয় ঠিকানা। ভবানীপুরের কাঁসারিপাড়া রোডের বাড়ি থেকে হেঁটে মাত্র দশ মিনিটে তিনি পৌঁছে যেতেন সেখানে। গ্রন্থাগারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে নথি, পত্রপত্রিকা আর বিভিন্ন পুরনো বই ঘাঁটতে শুরু করেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল কলকাতার এমন সব দিক খুঁজে বের করা, যা তখন পর্যন্ত উপেক্ষিত। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নথি, ব্রিটিশদের চিঠিপত্র, কলকাতায় আসা বিদেশি অতিথিদের স্মৃতিচারণ, পুরসভার পুরনো নথি—সবকিছুর মধ্যেই লুকিয়ে ছিল কলকাতার ইতিহাস। নায়ার সেই লুকিয়ে থাকা সত্যগুলো একত্রিত করতে থাকেন।
তাঁর কাজের পদ্ধতি ছিল বিস্ময়কর। সংবাদপত্রে কোনও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেখলেই তিনি তা কেটে রেখে দিতেন। ওয়েলিংটন স্কোয়ার আর কলেজ স্ট্রিটের পুরনো বইয়ের দোকান ছিল তাঁর প্রিয় জায়গা। ‘‘ওখানকার দোকানিরা নতুন কিছু পেলেই আমার জন্য রেখে দিত,’’ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন নায়ার। এভাবেই টুকরো টুকরো তথ্য সংগ্রহ করে তিনি রচনা করেন কলকাতার ইতিহাসের সম্পূর্ণ এক মেলা।
নায়ারের জীবনচর্চা ছিল সাধারণ মানুষের থেকে একেবারেই আলাদা। স্ত্রী স্কুলে পড়াতেন এবং সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব সামলাতেন। নায়ার ছিলেন একেবারেই ‘একবেলা’র মানুষ। সারাদিন পড়াশোনা, লেখালেখি আর গবেষণায় মগ্ন থাকতেন। কোনও পারিবারিক উৎসব, বন্ধুবান্ধবের আড্ডা, কিংবা আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ—কিছুতেই তাঁর তেমন আগ্রহ ছিল না। তাঁর পুরো জীবনই নিবেদিত ছিল কলকাতা চর্চার জন্য।
কলকাতার ইতিহাসের প্রতি গভীর নিবেদন
চার দশকেরও বেশি সময় ধরে নায়ার কলকাতার ইতিহাস নিয়ে কাজ করেছেন। তাঁর সৃষ্টির তালিকায় রয়েছে ৬২টি বই। এর মধ্যে অন্যতম হল “আ হিস্টরি অব ক্যালকাটাজ় স্ট্রিটস”। কলকাতা পুরসভার ইতিহাসও তাঁর লেখা। এছাড়াও এশিয়াটিক সোসাইটির উনিশ শতকের ‘প্রসিডিংস’-এর তিনটি খণ্ড সম্পাদনা করেছেন। ‘ক্যালকাটা টারসেন্টিনারি বিবলিয়োগ্রাফি’ দু’খণ্ডে প্রকাশ করেছেন। জেমস প্রিন্সেপ থেকে বিএস কেশবনের জীবনী, কলকাতার সংবাদপত্রের ইতিহাস, পুলিশ প্রশাসন, হাইকোর্ট, এমনকি দক্ষিণ ভারতীয় গোষ্ঠীর কলকাতায় বসবাস নিয়েও তিনি লিখেছেন।
তাঁর লেখা বইয়ের মধ্যে কলকাতার নামকরণের উৎস, জোব চার্নক সম্পর্কিত তথ্য এবং গাঁধীজির কলকাতা সফর নিয়ে কাজ উল্লেখযোগ্য। তাঁর প্রতিটি বইয়ে থাকে নির্ভুল তথ্য আর গভীর গবেষণার ছাপ। তিনি নিজে মনে করতেন, তথ্য সংগ্রহ করাই তাঁর প্রধান কাজ। এর বেশি কিছু হওয়া তাঁর লক্ষ্য ছিল না।
নায়ারের কাজ নিয়ে সমালোচনাও হয়েছে। অনেকের মতে, বাংলা না-জানার কারণে তিনি কলকাতার ইতিহাসের বহু গুরুত্বপূর্ণ দিক এড়িয়ে গেছেন। স্থানীয় ভাষায় লেখা অনেক নথি বা পত্রিকা পড়তে না পারার কারণে তাঁর গবেষণায় কিছু ফাঁক রয়ে গেছে। যদিও নায়ার নিজে এ নিয়ে কখনও হতাশ হননি। তাঁর বক্তব্য ছিল, ‘‘ইংরেজি নথিই আমার জন্য যথেষ্ট।’’ সমালোচনাকে পাশ কাটিয়ে তিনি নিজের কাজ চালিয়ে গেছেন।
নায়ার তাঁর জীবন কাটিয়ে দিলেন কলকাতার জন্য। ৮৫ বছর বয়সে, ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে এবার তিনি স্থায়ীভাবে কেরলে ফিরে যাবেন। যদিও এর আগে, ১৮ বছর আগে তিনি ফিরে যাওয়ার কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু কলকাতার প্রতি তাঁর অদম্য টান তাঁকে এখানে আটকে রেখেছিল। এবার, নিজের শরীর আর বয়সের ভারে তিনি শেষবারের মতো তাঁর জন্মভূমিতে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।
নায়ার তাঁর তিন হাজার বইয়ের মূল্যবান সংগ্রহ ১৯৯৯ সালে কলকাতা পুরসভাকে ১০ লক্ষ টাকায় বিক্রি করেন। বইগুলি টাউন হলে সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও সেগুলি আজও গুদামে বন্দি। টাউন হলের সংস্কার কাজ মাঝপথে থেমে যাওয়ায় সেই বইগুলো আর আলোর মুখ দেখেনি। অথচ এই বইগুলির মধ্যে রয়েছে কলকাতার ইতিহাসের এমন সব নথি, যা ভবিষ্যৎ গবেষণার পথ খুলে দিতে পারে।
এছাড়া নায়ারের লেখা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বই এখন আর ছাপা হয় না। এটি আমাদের সংস্কৃতিচর্চার প্রতি অবহেলার একটি বড় উদাহরণ।
পিটি নায়ার তাঁর জীবনের সেরা সময়টা কলকাতার জন্য ব্যয় করেছেন। তিনি এই শহরের ইতিহাস লিখেছেন, তথ্য সংগ্রহ করেছেন, এবং তার মধ্য দিয়ে কলকাতার প্রতি নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু আমরা কি তাঁর সেই অবদানকে যথেষ্ট সম্মান জানাতে পেরেছি? তাঁর লেখা এবং সংগ্রহ সংরক্ষণে যে উদাসীনতা দেখা গিয়েছে, তা একেবারেই অমার্জনীয়।
নায়ারের গল্প কেবল একজন গবেষকের গল্প নয়, এটি এক অবাঙালির কলকাতার প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন। তাঁর কাজ প্রমাণ করে, কোনও শহর বা তার সংস্কৃতিকে ভালোবাসার জন্য সেখানকার মানুষ হওয়া জরুরি নয়। বরং প্রয়োজন নিষ্ঠা, সময় আর গভীর অনুসন্ধিৎসা।
তিনি একবার বলেছিলেন, ‘‘কলকাতা আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। আমি চাই এই শহরকে কিছু ফিরিয়ে দিতে।’’ তিনি তাঁর কথা রেখেছেন। কিন্তু আমরা কি তাঁর প্রতি আমাদের দায়িত্ব পালন করেছি? এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের সবার ভেবে দেখা উচিত।
নায়ার চলে গেলেন, কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া কাজ আর ভালোবাসা কলকাতার ঐতিহ্যকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। তাঁর মতো কেউ হয়তো আবার আসবেন, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াবেন। কিন্তু তাঁকে যেন আমাদের মতো উদাসীনতার শিকার হতে না হয়।