বিতর্কের কেন্দ্রে থাকা এমন পুজো কমিটিগুলির মধ্যে একটি পূর্ব কলকাতার কাঁকুড়গাছি এলাকায় অবস্থিত। ‘শ্রী শ্রী সরস্বতী ও কালীমাতা মন্দির পরিষদ পুজো কমিটি’-র মণ্ডপে এক দিকে মঞ্চের উপরে প্রতিমা বসানো হয়েছে।
দুর্গাপুজোর থিমে প্রতিবাদের নামে কি অসংবেদনশীলতার নিদর্শন তৈরি করা হচ্ছে? আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসক-ছাত্রীর খুন এবং ধর্ষণের ঘটনার প্রেক্ষিতে এই প্রশ্নই উঠতে শুরু করেছে। এমনও পুজোর থিম সামনে আসছে, যেখানে আর জি করের ‘ক্রাইম স্পট’-এর দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বলে দাবি উদ্যোক্তাদের। যা অত্যন্ত কুরুচিকর বলে মন্তব্য করছেন শিল্পীদের একাংশ। আদালতের নজরে অপরাধমূলক পদক্ষেপ হিসাবেও বিষয়টিকে দেখা হতে পারে বলে দাবি করেছেন আইনজীবীদের অনেকে। তাঁদের বক্তব্য, এমনিতেই মৃতার নাম-পরিচয় এবং ছবি প্রকাশ্যে চলে আসায় ক্ষুব্ধ সুপ্রিম কোর্ট। এখন সেই বিষয়ই পুজোর থিম হিসাবে তুলে ধরা হলে সরাসরি পদক্ষেপ করতে পারে আদালত।
বিতর্কের কেন্দ্রে থাকা এমন পুজো কমিটিগুলির মধ্যে একটি পূর্ব কলকাতার কাঁকুড়গাছি এলাকায় অবস্থিত। ‘শ্রী শ্রী সরস্বতী ও কালীমাতা মন্দির পরিষদ পুজো কমিটি’-র মণ্ডপে এক দিকে মঞ্চের উপরে প্রতিমা বসানো হয়েছে। উল্টো দিকে রাখা হয়েছে প্রতিমার আদলে তৈরি একটি মূর্তি। সেই মূর্তির চোখ ঢাকা দু’হাতে। মূর্তির সামনে মাটিতে রয়েছে চাদর ঢাকা একটি নারী অবয়ব। পুজোর উদ্যোক্তা বিশ্বজিৎ সরকারের দাবি, ‘‘আর জি করের বিচার চেয়ে এই থিম বানানো হয়েছে। পায়েরকাছে নির্যাতিতাকে পড়ে থাকতে দেখে দেবী লজ্জায় চোখ ঢেকেছেন। এই কারণেই থিমের নাম ‘লজ্জা’। চোখ ঢাকা দেবীর পাশে সিংহও লজ্জায় মাথা নিচু করে রয়েছে। লক্ষ্মীর ভান্ডারের একটি প্রতীকও রেখেছি। তা দিয়ে বোঝানো হচ্ছে যে, লক্ষ্মীর ভান্ডার দিয়েই মানুষকে ভুলিয়ে রাখা হচ্ছে।’’
এই থিম নিয়েই সমাজমাধ্যমে জোর বিতর্ক চলছে। অনেকেই লিখেছেন, এমন দৃশ্য মণ্ডপে ফুটিয়ে তোলার কথা কেউ ভাবেন কী করে? নারকীয় হত্যাকাণ্ডের অপরাধস্থলের যে দৃশ্য দেখলে সমাজের শিউরে ওঠার কথা, সেটাই পুজোর থিম করায় হতবাক অনেকেই। মনোরোগ চিকিৎসকদের আবার প্রশ্ন, এমন দৃশ্য দেখলে মৃতার পরিবার, আত্মীয়দের উপরে কী প্রভাব পড়বে, তা-ও ভাবা হল না? এই থিমের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন কলকাতার পুজোর শিল্পীদের অনেকেই। টালা প্রত্যয়ের এ বারের থিম শিল্পী সুশান্ত পাল যেমন বললেন, ‘‘যে কোনও সৃষ্টি আপেক্ষিক। যে কোনও থিম যিনি বানিয়েছেন, তাঁর শিক্ষা, ভাবনা, চেতনা, বোধ-সহ নানা জিনিসের উপরে নির্ভর করে। কিন্তু প্রতিবাদ আরও অর্থপূর্ণ ভাবে করা যায় বলেই মনে করি। এ ক্ষেত্রে প্রতিবাদের নামে কোনও উদ্দেশ্য পূরণের চেষ্টা করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।’’
তবে এই বছরই প্রথম নয়। গত বছর এই কমিটির সরস্বতী পুজোর থিম ছিল ‘শিক্ষা দুর্নীতি’। জানা গিয়েছে, এই পুজোর উদ্যোক্তাদেরই অন্যতম, অভিজিৎ সরকার নামে এক ব্যক্তিকে নির্বাচন পরবর্তী হিংসায় খুনের অভিযোগ ওঠে ২০২১ সালে। সিবিআই বিষয়টির তদন্ত করে। এই মৃত্যুর পরে ভোট পরবর্তী হিংসাও থিম করা হয়েছিল এই মণ্ডপে। যদিও আইনজীবী মিলন মুখোপাধ্যায় বললেন, ‘‘পুজোর থিমে কী দেখানো যাবে বা যাবে না, তার কোনও গাইডলাইন নেই। কিন্তু মতপ্রকাশের অধিকার বা রাইট টু এক্সপ্রেশনের নামে বাড়াবাড়ি হচ্ছে কি না, সেটাই দেখতে হবে। এ ক্ষেত্রে নিম্ন রুচির ব্যাপার হয়েছে।’’
এমনই বিতর্ক তৈরি হয়েছিল বেলেঘাটার গান্ধী মাঠ ফ্রেন্ডস সার্কল নামে একটি পুজোর থিম ঘিরেও। সেখানে একটি বিশাল শিরদাঁড়াতৈরি করানো হয়েছিল। কিন্তু এই শিরদাঁড়া নিয়েই রাজ্যে জোর আলোচনা হয়েছে আর জি কর-কাণ্ডের প্রেক্ষিতে। চিকিৎসক পড়ুয়ারা লালবাজারে গিয়ে পুলিশকে প্রতীকী শিরদাঁড়া উপহার দিয়ে এসেছিলেন। তবে বিতর্কের মধ্যেই কলকাতার নতুন নগরপালের সঙ্গে ওই পুজো কমিটির কর্তাদের বৈঠক হয়। এর পরে রাতারাতি থিম থেকে বাদ পড়ে শিরদাঁড়া। পুজোর উদ্যোক্তাদের দাবি, বিতর্ক এড়াতেই এই পদক্ষেপ।