ভারতে স্টাইল এবং ফ্যাশনের ক্ষেত্রে সিনেমার তারকাদের প্রভাব বরাবরই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সিনেমার পর্দায় যে তারকারা নিজেদের অভিনয় ও ব্যক্তিত্ব দিয়ে দর্শকদের মন জয় করেন, তাদের স্টাইল, সাজগোজ এবং ফ্যাশন-চয়েসও সমানভাবে মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করে। তাদের পোশাক, চুলের স্টাইল, জুতো বা এমনকি আনুষঙ্গিক সামগ্রী ব্যবহার—সব কিছুই অনেকের কাছে ফ্যাশন অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠে। বহু মানুষই তাদের প্রিয় তারকার মতো সেজে উঠতে চান এবং তাদের অনুসরণ করে নিজেদের ফ্যাশন সেন্স তৈরি করেন।তবে শুধু সিনেমার তারকারাই নন, ভারতের অন্যান্য খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বেরাও ফ্যাশনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন।
ক্রীড়াজগতের তারকা, সংগীতশিল্পী, রাজনীতিবিদ বা ডিজিটাল মিডিয়ার প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বরাও ফ্যাশন এবং স্টাইলের ক্ষেত্রে জনমানসে গভীর প্রভাব ফেলে। উদাহরণস্বরূপ, ক্রিকেট তারকা বিরাট কোহলির পোশাক বা বলিউড তারকা দীপিকা পাডুকোনের চুলের স্টাইল অনুকরণ করার প্রবণতা অনেকের মধ্যেই দেখা যায়।বর্তমান সময়ে সোশ্যাল মিডিয়া এই প্রভাব আরও বাড়িয়ে তুলেছে। তারকারা তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা এবং ফ্যাশন শেয়ার করার মাধ্যমে তাদের ভক্তদের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হচ্ছেন। ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুক বা টুইটারে একটি ছবির মাধ্যমে তাদের সাজগোজ বা স্টাইল মুহূর্তের মধ্যে ট্রেন্ড হয়ে উঠছে। এমনকি, অনেক মানুষ বিশেষ অনুষ্ঠান বা পার্টির জন্য তারকাদের স্টাইল ফলো করেন এবং সেই অনুযায়ী নিজেদের সাজিয়ে তোলেন।এই প্রবণতা শুধুমাত্র শহুরে এলাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ভারতের গ্রামাঞ্চল এবং ছোট শহরেও তারকাদের স্টাইল অনুকরণ করার প্রবণতা লক্ষণীয়। সিনেমা বা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে তারা তারকাদের স্টাইল সম্পর্কে জানতে পারেন এবং নিজেদের মতো করে সেই স্টাইল গ্রহণ করেন।
তারকাদের স্টাইল কেবল ফ্যাশনের ক্ষেত্রেই নয়, বরং আধুনিক জীবনধারার প্রতিফলন হিসেবেও বিবেচিত হয়।এটি স্পষ্ট যে, স্টাইল এবং ফ্যাশনের ক্ষেত্রে ভারতের মানুষের মধ্যে তারকাদের প্রভাব ব্যাপক এবং বহুমুখী। এটি কেবল ব্যক্তিগত রুচি প্রকাশের মাধ্যম নয়, বরং তারকাদের সঙ্গে মানসিকভাবে যুক্ত হওয়ার একটি উপায় হিসেবেও কাজ করে।ক্রিকেটার বিরাট কোহলি এমন একজন তারকা, যিনি জনপ্রিয়তা, সম্পত্তি এবং স্টাইল—সব কিছুতেই অনেক তারকাকে ছাড়িয়ে গেছেন। বিশেষ করে তার শরীরজুড়ে থাকা ট্যাটুগুলো তাকে ভক্তদের মধ্যে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। অনেকেই হয়তো জানেন না যে বিরাট কোহলির সারা শরীরে মোট ১১টি ট্যাটু রয়েছে। তবে এই ট্যাটুগুলো শুধুমাত্র সাজসজ্জার জন্য , প্রতিটির পেছনেই রয়েছে বিশেষ অর্থ এবং ব্যক্তিগত গুরুত্ব।
১. মহাদেব (Lord Shiva) ট্যাটু
বিরাট কোহলি তার জীবনে মানসিক স্থিরতা বজায় রাখতে এবং রাগ ও আগ্রাসনকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিশেষভাবে সচেতন। এই মানসিক শক্তি এবং নিয়ন্ত্রণের প্রতীক হিসেবে তিনি তার বাঁ হাতে ‘লর্ড শিবা’র একটি ট্যাটু করিয়েছেন। এই ট্যাটুটিতে মহাদেব ধ্যানমগ্ন অবস্থায় চিত্রিত, যা তাকে মানসিক শান্তি ও স্থিরতা বজায় রাখতে প্রেরণা দেয়। এটি তার আধ্যাত্মিক বিশ্বাস এবং জীবনের ভারসাম্য রক্ষার প্রতীক হিসেবে কাজ করে।
২. দ্য মনাস্ট্রি (The Monastery)
তার মানসিক শান্তির আরেকটি চিহ্ন হলো তার হাতে থাকা ‘দ্য মনাস্ট্রি’ ট্যাটু। এটি শান্তি, স্থিরতা এবং আত্মবিশ্বাসের প্রতীক, যা তাকে চাপের মুহূর্তে নিজেকে স্থির রাখতে সাহায্য করে। বিশেষ করে ক্রিকেটের বাইশ গজে কঠিন পরিস্থিতিতে এই ট্যাটু তার মনে শান্তি এবং সাহস যোগায়।
৩. টেস্ট ক্যাপ নম্বর
বিরাটের ক্রিকেট জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলোকেও তিনি চিরস্থায়ী স্মারক হিসেবে ধরে রাখতে চান। এর উদাহরণ হলো তার টেস্ট ক্যাপ নম্বরের ট্যাটু। ২০১১ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কিংস্টনে তার টেস্ট অভিষেক ঘটে। সেই মুহূর্ত তার জন্য এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে তিনি নিজের টেস্ট ক্যাপ নম্বরটি শরীরে ট্যাটু করে রেখেছেন। এটি কেবল তার ক্রিকেটীয় যাত্রার একটি চিহ্ন নয়, বরং তার পরিশ্রম এবং অর্জনের প্রতীকও বটে।
বিরাট কোহলির এই ট্যাটুগুলো তার জীবনের বিভিন্ন দিককে প্রকাশ করে—তার আধ্যাত্মিকতা, মানসিক শক্তি, এবং পেশাদার জীবনের স্মরণীয় মুহূর্তগুলোকে। প্রতিটি ট্যাটু তার জন্য একটি বিশেষ অর্থ বহন করে, যা তাকে তার জীবন এবং ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে সাহায্য করে।
৪. গড’স আই (God’s Eye)
বিরাট কোহলির বাম হাতে রয়েছে একটি বিশেষ ট্যাটু, যা পরিচিত ‘গড’স আই’ নামে। এই ট্যাটুটি শুধুমাত্র একটি নকশা নয়, বরং এটি একটি গভীর অর্থ বহন করে। এটি এমন একটি প্রতীক, যা বোঝায় যে ঈশ্বর সবকিছু দেখছেন এবং প্রতিটি কাজ, সিদ্ধান্ত এবং মুহূর্ত তার নজরে রয়েছে। এই ধারণা বিরাটের জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
‘গড’স আই’ ট্যাটুটি বিরাটের জন্য মানসিক শক্তি এবং অনুপ্রেরণার উৎস। এটি তাকে মনে করিয়ে দেয় যে জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে সতর্ক থাকা জরুরি। ট্যাটুটি তাকে অনুপ্রাণিত করে সঠিক কাজ করতে এবং নৈতিকতার পথে অটল থাকতে। বাইশ গজের চাপ, প্রতিযোগিতা এবং জীবনের নানা জটিল মুহূর্তে এই ট্যাটু বিরাটকে মনে করিয়ে দেয় যে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং ন্যায়নিষ্ঠ থাকা সবসময় গুরুত্বপূর্ণ।
এছাড়া, এই ট্যাটু তার আধ্যাত্মিক দিককেও প্রকাশ করে। ঈশ্বরের উপস্থিতি এবং তার ক্ষমতার ওপর বিশ্বাস বিরাটের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। তিনি বিশ্বাস করেন যে একজন মানুষ যত বড়ই হোক না কেন, তার ওপর এক সর্বশক্তিমান সত্তা রয়েছেন, যিনি সবকিছুর বিচার করবেন। এই বিশ্বাস তাকে অহংকার থেকে দূরে রাখে এবং সবসময় দায়িত্বশীল থাকতে সাহায্য করে।
‘গড’স আই’ ট্যাটুটি শুধু বিরাটের ব্যক্তিত্ব নয়, তার জীবনের দর্শন এবং মানসিকতার প্রতিফলন। এটি তাকে সবসময় সতর্ক এবং সচেতন থাকতে উদ্বুদ্ধ করে, যাতে তিনি তার পেশাগত এবং ব্যক্তিগত জীবনে সঠিক পথে চলতে পারেন। এই ট্যাটুটি তার বিশ্বাস, আত্মবিশ্বাস এবং জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিকে চমৎকারভাবে উপস্থাপন করে।
৫. ওয়ানডে অভিষেক স্মারক
২০০৮ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওডিআই ক্রিকেটে অভিষেকের স্মারক হিসেবে তার প্রথম ম্যাচের ক্যাপ নম্বরের ট্যাটু করিয়েছেন। এটি তার ক্রিকেটীয় যাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
৬ ও ৭. মা ও বাবার নাম
বিরাট কোহলি তার পরিবারকে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ বলে মনে করেন। তার মা ও বাবার প্রতি শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা প্রকাশের একটি বিশেষ উপায় হলো তাদের নামের ট্যাটু, যা তিনি নিজের শরীরে চিরস্থায়ীভাবে ধারণ করেছেন।তার শরীরে মায়ের নামের একটি ট্যাটু রয়েছে, যা তার মায়ের প্রতি গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার প্রতীক। বিরাটের জীবনের প্রতিটি সাফল্যের পেছনে তার মায়ের অবদান অপরিসীম। কঠিন সময়েও তার মা তাকে মানসিক শক্তি জুগিয়েছেন এবং নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য সাহস দিয়েছেন। মায়ের নামের এই ট্যাটুটি বিরাটকে তার শেকড় এবং পরিবারের প্রতি দায়বদ্ধতার কথা সবসময় মনে করিয়ে দেয়।অন্যদিকে, তার বাবার নামের একটি ট্যাটু রয়েছে, যা বাবার স্মৃতিকে চিরস্থায়ী করে রেখেছে। বিরাট যখন মাত্র ১৮ বছর বয়সী তরুণ, তখন তার বাবা তাকে ছেড়ে চিরতরে চলে যান। কিন্তু তার বাবার আদর্শ এবং জীবনে তার প্রভাব বিরাটের কাছে চিরন্তন। বিরাট সবসময় বলেন, তার বাবাই তাকে কঠোর পরিশ্রম, নৈতিকতা এবং সঠিক পথে চলার শিক্ষা দিয়েছেন। বাবার নামের এই ট্যাটুটি শুধু স্মৃতির প্রতীক নয়, বরং বিরাটের জীবনের মূল্যবোধ ও আদর্শের প্রতি তার অটল বিশ্বাসেরও প্রতিফলন।মা ও বাবার নামের এই ট্যাটুগুলো বিরাটের জীবনে শুধু একটি নকশা নয়; এগুলো তার জীবনের গভীরতম আবেগ এবং পরিবারের প্রতি অটুট ভালোবাসার চিহ্ন। প্রতিটি মুহূর্তে এগুলো তাকে অনুপ্রেরণা দেয় এবং জীবনের প্রতিটি সফলতায় তাদের অবদান স্মরণ করিয়ে দেয়।
৮. জাপানিজ সামুরাই
তার ডান হাতে একটি ‘জাপানিজ সামুরাই’ ট্যাটু রয়েছে, যা তার শক্তি, শৃঙ্খলা, এবং সাহসের প্রতীক। এটি তার জীবনযাপনের কৌশল ও মানসিকতার পরিচায়ক।
৯. কর্কট রাশি (Cancer Zodiac)
বিরাটের রাশি কর্কট। নিজের রাশির নাম তিনি ট্যাটু হিসেবে করিয়েছেন, যা তার ব্যক্তিগত জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
১০. ট্রাইবাল আর্ট ট্যাটু
তার ডান হাতে রয়েছে একটি ‘ট্রাইবাল আর্ট’ ট্যাটু, যা তার আগ্রাসী এবং লড়াই করার মানসিকতাকে প্রকাশ করে। এটি বিরাটের ব্যক্তিত্বের প্রতীক।
১১. জীবনের দর্শন ভিত্তিক ট্যাটু
বিরাট তার ট্যাটুগুলোর মাধ্যমে জীবনের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি, অভিজ্ঞতা এবং মানসিক উন্নতিকে উপস্থাপন করেন। প্রতিটি ডিজাইনের পেছনে রয়েছে গভীর বার্তা।

কেন বিরাট কোহলির ট্যাটুগুলো এত জনপ্রিয়?
- আধ্যাত্মিকতা এবং ফ্যাশনের যুগলবন্দি।
- জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের স্মারক।
- পরিবারের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা।
- মানসিক শক্তির প্রতীক।
শেষ কথা
বিরাট কোহলির ট্যাটুগুলো নিছক দৃষ্টিনন্দন নয়, এগুলো তার ব্যক্তিত্ব, বিশ্বাস, এবং জীবনদর্শনের প্রতিচ্ছবি। যদি আপনি বিরাটের ভক্ত হন বা ট্যাটুতে আগ্রহী হন, তাহলে এই ট্যাটুগুলোর পেছনের গল্প আপনাকে অনুপ্রাণিত করবেই।