কুম্ভ মেলার আসল ইতিহাস,৪ ফোঁটা অমৃত পড়েই শুরু কুম্ভ!

Spread the love

কুম্ভ মেলা কখন এবং কীভাবে শুরু হয়েছিল, তার সঠিক ইতিহাস পাওয়া কঠিন। তবে এটি কয়েকশো বছরের পুরোনো এক ঐতিহ্য, যা বিভিন্ন আধ্যাত্মিক বিশ্বাস ও সংস্কৃতির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত।

অনেকের মতে, অষ্টম শতাব্দীতে আদি শঙ্করাচার্য ভারতজুড়ে বিভিন্ন মঠ প্রতিষ্ঠা ও ধর্মীয় সমাবেশের আয়োজন করেন। ধারণা করা হয়, তাঁরই হাত ধরে কুম্ভ মেলার সূচনা। তবে এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।

ইতিহাসবিদদের একাংশের মতে, ১৯ শতকের আগে এত বৃহৎ আকারে তীর্থযাত্রার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। যদিও কিছু প্রাচীন পান্ডুলিপি এবং শিলালিপিতে ৬ বা ১২ বছর অন্তর মাঘ মেলার উল্লেখ পাওয়া যায়, যেখানে পবিত্র নদীতে স্নানের কথা বলা হয়েছে। এটি বর্তমান কুম্ভ মেলার প্রাথমিক রূপ হতে পারে বলে ধারণা করা হয়।

স্বাধীনতার আগে ব্রিটিশ সরকার কুম্ভ মেলার আয়োজন করত। এমনকি মেলার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য ইংল্যান্ড থেকে উচ্চপদস্থ অফিসারদের পাঠানো হতো। ১৯৫৪ সালে স্বাধীন ভারতের প্রথম কুম্ভ মেলার আয়োজন করা হয় প্রয়াগরাজে। সেই মেলায় ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু এবং রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্র প্রসাদও অংশগ্রহণ করেছিলেন। সেবারে প্রায় ১২ কোটি পুণ্যার্থী মেলায় যোগ দিয়েছিলেন।

কুম্ভ মেলার সঙ্গে জড়িত রয়েছে এক গভীর পৌরাণিক কাহিনী। বলা হয়, একবার ঋষি দুর্বাসার অভিশাপে দেবতারা তাদের ঐশ্বর্য হারান। দেবতারা ভগবান বিষ্ণুর শরণাপন্ন হলে তিনি পরামর্শ দেন সমুদ্র মন্থনের। দেবতারা অসুরদের সঙ্গে মিলে শুরু করেন সমুদ্র মন্থন। এতে উঠে আসে নানা মূল্যবান রত্ন এবং একটি কলস ভর্তি অমৃত।

অমৃতের জন্য দেবতা এবং অসুরদের মধ্যে ১২ দিন ধরে যুদ্ধ চলে, যা মনুষ্যকালের হিসেবে ১২ বছরের সমান। এই যুদ্ধের সময় চার স্থানে (প্রয়াগরাজ, হরিদ্বার, উজ্জয়িনী, এবং নাসিক) অমৃতের চার ফোঁটা পড়ে। সেই স্থানগুলোতে আজও কুম্ভ মেলা আয়োজিত হয়।

কুম্ভ মেলা সাধারণত চার ধরনের হয়:

  1. পূর্ণ কুম্ভ: প্রতি ১২ বছর অন্তর প্রয়াগরাজে আয়োজিত হয়। এটি কুম্ভ মেলার প্রধান রূপ।
  2. অর্ধ কুম্ভ: প্রতি ৬ বছর অন্তর প্রয়াগরাজ বা হরিদ্বারে আয়োজিত হয়।
  3. কুম্ভ: প্রতি ৩ বছর অন্তর গ্রহের অবস্থান অনুসারে পৃথিবীর চার স্থানের মধ্যে একটিতে আয়োজিত হয়।
  4. মহাকুম্ভ: এটি সবচেয়ে বিরল এবং গুরুত্বপূর্ণ। প্রতি ১৪৪ বছরে একবার হয়। মেষ রাশিতে বৃহস্পতি, সূর্য এবং চন্দ্রের বিশেষ সংযোগ ঘটলে মহাকুম্ভ অনুষ্ঠিত হয়।
    কুম্ভ মেলা কোথায় এবং কবে হবে তা জ্যোতিষ শাস্ত্র অনুযায়ী নির্ধারিত হয়। সূর্য ও বৃহস্পতির নির্দিষ্ট রাশিতে অবস্থান এই সময় নির্ধারণ করে।

প্রয়াগরাজ: বৃহস্পতি বৃষ রাশিতে এবং সূর্য মকর রাশিতে থাকলে।
হরিদ্বার: বৃহস্পতি কুম্ভ রাশিতে এবং সূর্য মেষ রাশিতে থাকলে।
উজ্জয়িনী: বৃহস্পতি এবং সূর্য সিংহ রাশিতে থাকলে।
নাসিক: সূর্য সিংহ রাশিতে এবং বৃহস্পতি মেষ রাশিতে থাকলে।

কুম্ভমেলা, ভারতীয় সংস্কৃতির একটি অন্যতম বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব, প্রতি ১২ বছর পর পর চারটি পবিত্র স্থানে অনুষ্ঠিত হয়। এই মেলার ইতিহাস প্রাচীন এবং এর সাথে জড়িত রয়েছে পৌরাণিক কাহিনী, ধর্মীয় বিশ্বাস ও সামাজিক ঐতিহ্য। কুম্ভমেলার মূল উদ্দেশ্য হলো পুণ্য অর্জন এবং আত্মশুদ্ধি।

আরও পড়ুন : অভয় সিং থেকে কীভাবে হলেন IIT বাবা! বেরিয়ে এল আসল সত্য!

কুম্ভমেলার উৎপত্তি পৌরাণিক কাহিনীর সাথে যুক্ত। বলা হয়, সমুদ্র মন্থনের সময় দেবতা ও অসুরদের মধ্যে অমৃতের জন্য যুদ্ধ হয়েছিল। এই অমৃতের কিছু ফোঁটা পৃথিবীতে পড়ে যায়, যা বর্তমানে কুম্ভমেলার চারটি স্থান—হরিদ্বার, নাসিক, উজ্জয়িনী এবং প্রয়াগরাজে অনুষ্ঠিত হয়। এই স্থানগুলোতে প্রতি ১২ বছর পর পর কুম্ভমেলার আয়োজন করা হয়।

কুম্ভমেলার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় হিন্দু পুরাণ ও প্রাচীন গ্রন্থে। গুপ্ত যুগে (৪র্থ-৬ষ্ঠ শতাব্দী) এই মেলা বিশাল জনসমাগমের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। রাজারা এই উৎসবকে সমর্থন করে মন্দির ও স্নানের ঘাট নির্মাণ করেন।

১২শ শতাব্দী থেকে কুম্ভমেলা রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। বিভিন্ন অঞ্চলের রাজারা এই উৎসবে অংশগ্রহণ করতে শুরু করেন এবং তাদের ধন-সম্পদ ও আচার-অনুষ্ঠান দিয়ে মেলাটিকে মহিমান্বিত করেন। মুঘল সম্রাট আকবরও এই মেলায় অংশগ্রহণ করেন এবং উৎসবকে সমর্থন করেন।

ব্রিটিশ শাসনের সময়, কুম্ভমেলা সাধারণ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয়তা পায় এবং এটি স্বাধীনতা আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠে। মহাত্মা গান্ধী ১৯১৮ সালে কুম্ভমেলায় অংশগ্রহণ করেন46। স্বাধীনতার পর, ভারত সরকার ১৯৫৪ সালে প্রথম কুম্ভমেলার আয়োজন করে এবং ২০০১ সাল থেকে এটি টেলিভিশনে সম্প্রচার করা শুরু হয়।

কুম্ভমেলা শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং এটি ভারতীয় সমাজের একত্রিত হওয়ার একটি প্ল্যাটফর্ম। এখানে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের পাশাপাশি সামাজিক আলোচনা ও মত বিনিময়ের সুযোগ তৈরি হয়। এটি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে এবং একটি বৃহৎ সাংস্কৃতিক মিলনস্থল হিসেবে কাজ করে।
কুম্ভমেলায় অংশগ্রহণকারীরা গঙ্গা, যমুনা, গোদাবরী ও সঙ্গমের জল স্নান করে পুণ্য অর্জনের আশা নিয়ে আসেন। বিশ্বাস করা হয় যে এই জল আত্মশুদ্ধি ও রোগ মুক্তির জন্য বিশেষভাবে কার্যকরী।

এই উৎসবের মাধ্যমে ভারতীয় সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক প্রকাশ পায়। সন্ন্যাসীরা, সাধকরা এবং সাধারণ মানুষ একসাথে মিলিত হয়ে ধর্মীয় আলোচনা করেন, ভজন গায়েন এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে অংশ নেন3
ভারতের অন্যতম বৃহৎ ধর্মীয় অনুষ্ঠান কুম্ভ মেলা, বিশেষ করে মহাকুম্ভ, শুধুমাত্র একটি তীর্থযাত্রা নয় বরং এটি আধ্যাত্মিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও বিশেষ ভূমিকা পালন করে। চলমান মহাকুম্ভ ২০২৫ উপলক্ষে উত্তর প্রদেশের প্রয়াগরাজের ত্রিবেণী সঙ্গমে (গঙ্গা, যমুনা, ও সরস্বতীর মিলনস্থল) দেশ-বিদেশের কোটি কোটি মানুষ সমবেত হয়েছেন। লক্ষাধিক সাধু, অঘোরি ও পুণ্যার্থী এখানে এসেছেন মূলত গঙ্গাস্নানের মাধ্যমে পাপমোচনের বিশ্বাস থেকে। তবে এই বছরের কুম্ভ অন্যান্য বছরের তুলনায় ভিন্ন এবং বিশেষ কারণেও তা আরও গুরুত্বপূর্ণ। জ্যোতিষ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১৪৪ বছরে একবার এমন বিরল গ্রহসংযোগ বা যোগ হয়। আর সেই কারণেই এই কুম্ভকে বলা হচ্ছে ‘মহাকুম্ভ’।

কিন্তু এই বিরল যোগের রহস্য কী? কীভাবে নির্ধারণ হয় কুম্ভ মেলার সময় ও স্থান? কুম্ভ মেলার পেছনের ইতিহাস, পৌরাণিকতা এবং এর সামাজিক-অর্থনৈতিক গুরুত্বই বা কী? এই প্রতিবেদনে আমরা এসব দিক বিশ্লেষণ করব।

মহাকুম্ভ মেলা খুবই বিরল, যা একটি পূর্ণ কুম্ভের ১২টি চক্র শেষে হয়। ২০২৫ সালের মহাকুম্ভের মূল আকর্ষণ হল এই বিরল জ্যোতিষীয় যোগ। জ্যোতিষীদের মতে, এই সময় সূর্য, শনি, চন্দ্র এবং বৃহস্পতির অবস্থান সেই সময়ের মতো হয়, যখন সমুদ্র মন্থন হয়েছিল।

বিশ্বাস করা হয়, মহাকুম্ভে অংশ নেওয়া অত্যন্ত পুণ্যকর। এই সময় গঙ্গাস্নান করলে সব পাপ ধুয়ে যায় এবং মোক্ষলাভ হয়।

কুম্ভ মেলা সাধু-সন্ন্যাসীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি তাঁদের আত্মশুদ্ধি এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির একটি মাধ্যম।

নাগা সাধু: তাঁরা দীর্ঘকালীন তপস্যার পর এই মেলায় আসেন।
অঘোরি: কুম্ভ তাঁদের বিশেষ তন্ত্রসাধনার সময়।
কল্পবাস: কুম্ভ মেলায় ৪৫ দিনের কল্পবাসের পর গঙ্গাস্নান করে মোক্ষ লাভের আশা করা হয়।

পৌরাণিক বিশ্বাস অনুসারে, কুম্ভ মেলার সময় স্বর্গের দরজা খুলে যায় এবং দেবতারা গঙ্গায় স্নান করতে আসেন।

মহাকুম্ভ শুধু আধ্যাত্মিক নয়, এটি অর্থনৈতিক দিক থেকেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০২৫ সালের কুম্ভে প্রায় ৪০-৪৫ কোটি পুণ্যার্থীর সমাগম হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

সরকারি খরচ: প্রশাসনের খরচ আনুমানিক ১৬,০০০ কোটি টাকা।
রাজস্ব আয়: আনুমানিক ১ লক্ষ কোটি টাকার রাজস্ব আসবে, যার মধ্যে ৫০,০০০ কোটি টাকা জিএসটি থেকে।
পর্যটন শিল্প: স্থানীয় ব্যবসায়ী থেকে বড় সংস্থা—সবাই উপকৃত হবে।

কুম্ভ মেলা ভারতের একটি অনন্য সাংস্কৃতিক এবং আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য। এটি কেবল ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়; এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে গভীর পৌরাণিক বিশ্বাস, ঐতিহাসিক গুরুত্ব এবং আধুনিক অর্থনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা।

মহাকুম্ভ ২০২৫ সেই বিরল সুযোগ, যা যুগে একবার আসে। এটি ভারতীয় সংস্কৃতির বহুমুখী রূপ তুলে ধরে। নাস্তিক কিংবা আস্তিক—যে-ই হন না কেন, মহাকুম্ভের অভিজ্ঞতা নেওয়া প্রতিটি মানুষের জন্য এক অসাধারণ উপলক্ষ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *