ফ্রেঞ্চ ফ্রাই বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় একটি স্ন্যাক্স। শিশু থেকে বৃদ্ধ, সবাই এই মচমচে ও সুস্বাদু খাবারটি ভালোবাসে। এটি মূলত আলু ভেজে প্রস্তুত করা হয় এবং নুন, মশলা বা বিভিন্ন সস দিয়ে পরিবেশন করা হয়। বর্তমান বিশ্বে ফাস্টফুড সংস্কৃতির উত্থানের ফলে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই কেবলমাত্র একটি খাবার নয়, এটি খাদ্য শিল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে উঠেছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই ব্যাপক জনপ্রিয় হলেও, একসময় ভারতকে এই খাবার আমদানি করতে হতো। তবে বিগত কয়েক দশকে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের উন্নয়নের ফলে ভারত নিজেই ফ্রেঞ্চ ফ্রাই উৎপাদন এবং রফতানি শুরু করেছে। বর্তমানে ভারত শুধুমাত্র নিজের দেশের জন্য নয়, বরং আন্তর্জাতিক বাজারেও ফ্রেঞ্চ ফ্রাই সরবরাহ করছে।
একসময় ভারত ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আমদানি করত, কিন্তু বর্তমানে দেশটি নিজেই এটি উৎপাদন ও রফতানি করছে। ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়েও ভারতে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই তেমন সহজলভ্য ছিল না। তখন প্রধানত আমেরিকা ও ইউরোপ থেকে ফ্রোজেন ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আমদানি করে বড় বড় আন্তর্জাতিক রেস্তোরাঁ চেইনের মাধ্যমে সরবরাহ করা হতো। কিন্তু প্রযুক্তির উন্নয়ন, কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে ভারত এখন নিজেই এই পণ্যের অন্যতম বড় উৎপাদক ও রফতানিকারী হয়ে উঠেছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভারত থেকে ১,৩৫,৮৭৭ টন ফ্রেঞ্চ ফ্রাই রফতানি হয়েছে, যার মূল্য প্রায় ১,৪৭৮.৭৩ কোটি টাকা। শুধু ২০২৪ সালের এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত, ভারত ১,০৬,৫০৬ টন ফ্রেঞ্চ ফ্রাই রফতানি করেছে, যার মূল্য ১,০৫৬.৯২ কোটি টাকা। এই বিশাল বাজার এবং এর বিস্তারের পিছনে কী কী কারণ কাজ করেছে, তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
ভারতে ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের প্রবেশ এক নতুন খাদ্য সংস্কৃতির সূচনা করেছিল। ১৯৯০-এর দশকের আগে, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই মূলত আন্তর্জাতিক ফাস্টফুড চেইনের মাধ্যমে আমদানি করা হতো এবং শুধুমাত্র অভিজাত হোটেল ও রেস্তোরাঁতেই এটি পাওয়া যেত।
১৯৯২ সালে ল্যাম্ব ওয়েস্টন ভারতীয় বাজারে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আমদানি শুরু করে এবং এটি মূলত বড় বড় হোটেল ও রেস্তোরাঁয় সরবরাহ করা হতো। কিন্তু উচ্চ আমদানি খরচ ও সীমিত সরবরাহের কারণে সাধারণ মানুষের কাছে এটি সহজলভ্য ছিল না।
এরপর, ১৯৯৬ সালে ম্যাককেইন ফুডস ভারতে প্রবেশ করে এবং দেশের ভোক্তাদের জন্য ফ্রেঞ্চ ফ্রাই সহজলভ্য করার প্রচেষ্টা চালায়। একই সময়ে, ম্যাকডোনাল্ডস ভারতীয় বাজারে প্রবেশ করে এবং ফ্রেঞ্চ ফ্রাই-এর চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। এ সময় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফাস্টফুড চেইন যেমন কেএফসি, বার্গার কিং ইত্যাদিও ভারতীয় বাজারে প্রবেশ করতে শুরু করে, যা ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের জনপ্রিয়তা আরও বাড়িয়ে তোলে।
২০০০-এর দশকে ভারতে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের বিকাশ ঘটে। দেশীয় সংস্থাগুলিও ফ্রেঞ্চ ফ্রাই উৎপাদনে আগ্রহ দেখাতে শুরু করে। হাইফেন ফুডস, ইসকন বালাজি ফুডস, ফানওয়েভ ফুডস এবং চিলফিল ফুডস এর মতো সংস্থাগুলি দেশীয়ভাবে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই উৎপাদন শুরু করে, যা ভারতকে এই খাদ্যশিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলে।
ফ্রেঞ্চ ফ্রাই শুধুমাত্র একটি খাবার নয়, এটি এখন একটি গ্লোবাল ফাস্টফুড সংস্কৃতির প্রতীক হয়ে উঠেছে। এটি সাধারণত আলু থেকে তৈরি একটি খাবার যা তেলে ভেজে প্রস্তুত করা হয়। ম্যাকডোনাল্ডস, কেএফসি, বার্গার কিং-এর মতো আন্তর্জাতিক ফাস্টফুড চেইনের মাধ্যমে এটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। শুধু বড় শহর নয়, বর্তমানে ভারতীয় উপমহাদেশের গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত এই খাবার পৌঁছে গেছে।
শিশু, কিশোর থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্ক, সবাই ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খেতে ভালোবাসে। সিনেমা দেখতে দেখতে, আড্ডা দিতে দিতে বা খাবারের সঙ্গে সাইড ডিশ হিসেবে এটি জনপ্রিয়। এমনকি রাস্তার ধারে ছোট ছোট খাবারের দোকানেও এখন ফ্রেঞ্চ ফ্রাই পাওয়া যায়।
ভারতে বাচ্চারা যেমন এটি ভালোবাসে, তেমনই অফিসের কর্মচারীরা বিরতিতে এটি খেতে পছন্দ করেন। তাছাড়া, এটি বিভিন্ন ধরণের সস, চিজ বা মশলার সাথে পরিবেশন করা হয়, যা এর স্বাদকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে।
ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম আলু উৎপাদনকারী দেশ, যেখানে প্রতি বছর প্রায় ৬ কোটি টন আলু উৎপাদন হয়। এত বিশাল পরিমাণ আলু উৎপাদনের কারণে দেশটি ফ্রেঞ্চ ফ্রাই উৎপাদনের ক্ষেত্রে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে।

১. প্রচুর আলু উৎপাদন:
ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম আলু উৎপাদনকারী দেশ, যেখানে প্রতি বছর প্রায় ৬ কোটি টন আলু উৎপাদিত হয়। ফ্রেঞ্চ ফ্রাই উৎপাদনের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর।
২. প্রযুক্তিগত উন্নতি:
আধুনিক ফুড প্রসেসিং প্রযুক্তির কারণে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই উৎপাদন ও সংরক্ষণ সহজ হয়েছে।
৩. অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক চাহিদা: ভারতে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই-এর অভ্যন্তরীণ চাহিদা যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনই আন্তর্জাতিক বাজারেও এর বিশাল চাহিদা রয়েছে।
৪. ফাস্টফুড সংস্কৃতির প্রসার:
শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত ফাস্টফুড সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়েছে, যা ফ্রেঞ্চ ফ্রাই-এর চাহিদাকে বাড়িয়ে দিয়েছে।
৫. রফতানি বাজারের প্রসার:
ভারত ফ্রেঞ্চ ফ্রাই রফতানির জন্য বড় বাজার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিশেষত ফিলিপিন্স, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরশাহী, ওমান, জাপান এবং তাইওয়ানে ভারতীয় ফ্রেঞ্চ ফ্রাই ব্যাপকভাবে রফতানি করা হচ্ছে।
বর্তমানে ভারত ফ্রেঞ্চ ফ্রাই রফতানির অন্যতম কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভারত ১,৩৫,৮৭৭ টন ফ্রেঞ্চ ফ্রাই রফতানি করেছে, যার বাজারমূল্য ১,৪৭৮.৭৩ কোটি টাকা। শুধু ২০২৪ সালের এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ভারত ১,০৬,৫০৬ টন ফ্রেঞ্চ ফ্রাই রফতানি করেছে, যার মূল্য ১,০৫৬.৯২ কোটি টাকা।
বিশ্ববাজারে ভারতের ফ্রেঞ্চ ফ্রাই-এর চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। উন্নতমানের আলু, অত্যাধুনিক ফুড প্রসেসিং প্রযুক্তি এবং প্রতিযোগিতামূলক মূল্যই ভারতের ফ্রেঞ্চ ফ্রাই রফতানির মূল চালিকা শক্তি। ভবিষ্যতে এই শিল্প আরও বিস্তৃত হবে এবং ভারতের অর্থনীতিতে আরও বড় অবদান রাখবে।
ভারত এখন শুধু ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আমদানিকারী দেশ নয়, এটি একটি প্রধান উৎপাদন ও রফতানিকারী দেশে পরিণত হয়েছে। দেশীয় খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের উন্নয়ন, আলু উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা এবং বিশ্ববাজারে ক্রমবর্ধমান চাহিদার ফলে ভারতের ফ্রেঞ্চ ফ্রাই শিল্প দ্রুত বিকশিত হচ্ছে।
ভবিষ্যতে এই শিল্প আরও প্রসার লাভ করবে এবং এটি ভারতের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। ফ্রেঞ্চ ফ্রাই-এর ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা এবং রফতানি বৃদ্ধির ফলে ভারত বিশ্ব খাদ্যশিল্পের অন্যতম প্রধান খেলোয়াড় হয়ে উঠবে।