নিশ্চিতভাবেই অবাক লাগতে পারে, কিন্তু এমন একটি আইন বাস্তবে কার্যকর ছিল আমাদের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশে, যেখানে বিয়ে করলেই দিতে হয় ট্যাক্স! এই অদ্ভুত নিয়মটি ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত কার্যকর ছিল, যা মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন সরকার সম্প্রতি বাতিল করার ঘোষণা দিয়েছে। তবে এই নিয়মের ইতিহাস এবং প্রভাব নিয়ে আলোচনা করলে অনেক চমকপ্রদ তথ্য সামনে আসে। তবে ২০২৫ সালের ২১ জানুয়ারি মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন সরকার ঘোষণা করেছে যে এই বিয়ে করের আইন আর কার্যকর থাকবে না। এটি বাতিলের পর অনেক প্রশ্ন উঠছে—এই আইনটি কেমন ছিল? কীভাবে কাজ করত? এবং এর সামাজিক প্রভাব কতটা ছিল? চলুন এই বিষয়ে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা যাক।
কীভাবে শুরু হয়েছিল বিয়েতে কর দেওয়ার নিয়ম?
বিয়েতে করের ধারণাটি আসে ১৯৭০-এর দশকে। বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল উদ্বেগজনক। পাশাপাশি বহুবিবাহও সমাজে একটি বড় ইস্যু হিসেবে দেখা দিচ্ছিল। সেই সময় সরকারের ধারণা ছিল, বহুবিবাহ শুধু জনসংখ্যা বৃদ্ধি করে না, এটি পারিবারিক জীবনের ভারসাম্যকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। তাই, বহুবিবাহ নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার একটি বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
এই নিয়মের আওতায়, প্রথম বিয়ের ক্ষেত্রে কোনো কর ধার্য করা হয়নি। তবে দ্বিতীয় বা তার বেশি বিয়ে করতে হলে কর দিতে হতো। এটি একটি তফসিল আইনের মাধ্যমে সংযোজিত হয়, যেখানে স্ত্রীর সংখ্যা অনুযায়ী করের পরিমাণ ধাপে ধাপে বাড়ানো হয়।
আইন অনুযায়ী, প্রথম বিয়ের ক্ষেত্রে কোনো কর ধার্য করা হয়নি। কিন্তু দ্বিতীয় বিয়ে করতে হলে দিতে হতো ৫,০০০ টাকা কর। এই করের পরিমাণ স্ত্রীর সংখ্যার সঙ্গে বেড়ে যেত। উদাহরণস্বরূপ:
- দ্বিতীয় বিয়ে: ৫,০০০ টাকা
- তৃতীয় বিয়ে: ২০,০০০ টাকা
- চতুর্থ বিয়ে: ৫০,০০০ টাকা
তবে এখানে কিছু ব্যতিক্রমও ছিল। যদি প্রথম স্ত্রী নিঃসন্তান হতেন বা মানসিকভাবে অসুস্থ হতেন, সেক্ষেত্রে দ্বিতীয় বিয়ের জন্য মাত্র ২০০ টাকা কর দিতে হতো।
এই করের পরিমাণ অনেকের কাছে তুচ্ছ মনে হতে পারে, কিন্তু দরিদ্র বা মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের জন্য এটি ছিল এক বিশাল আর্থিক বোঝা।
সরকারের মূল উদ্দেশ্য ছিল বহুবিবাহ কমানো। তৎকালীন শাসকরা বিশ্বাস করতেন, করের আর্থিক চাপ পুরুষদের বহুবার বিয়ে করতে নিরুৎসাহিত করবে। তবে বাস্তবে এর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
অনেক পুরুষই এই নিয়ম ফাঁকি দেওয়ার জন্য গোপনে বিয়ে করতেন। একাধিক স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও, তাঁরা তাদের বিয়ের বিষয়ে প্রশাসনকে সঠিক তথ্য দিতেন না। ফলে আইনটি কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব হয়নি।
বিয়েতে কর ধার্য করার এই নিয়মটি সমাজে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। অনেকেই এই আইনকে ইতিবাচক হিসেবে দেখেছিলেন। তাঁদের মতে, এটি বহুবিবাহের প্রবণতা কমিয়ে আনতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল। বিশেষ করে নারীরা এই নিয়মের পক্ষপাতী ছিলেন, কারণ এটি তাঁদের স্বার্থ রক্ষা করত।
তবে অন্যদিকে, অনেকেই এই নিয়মকে অযৌক্তিক এবং বৈষম্যমূলক বলে মনে করতেন। বিশেষ করে ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলো এই নিয়মের বিরুদ্ধে ছিল। তাদের মতে, ইসলাম ধর্ম বহুবিবাহ অনুমোদন দিয়েছে এবং সরকারের এই নিয়ম ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছিল।
এই নিয়মটি আর্থিকভাবে দুর্বল শ্রেণির জন্য বড় চাপ সৃষ্টি করেছিল। দ্বিতীয় বা তৃতীয় বিয়ের পরিকল্পনা করা দরিদ্র পুরুষদের জন্য এই কর একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবে সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণি এই করকে খুব বেশি গুরুত্ব দেয়নি, কারণ তাঁদের জন্য এটি পরিশোধ করা কোনো বড় বিষয় ছিল না।
সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে, এই নিয়মের কিছু ইতিবাচক দিক ছিল। এর ফলে অনেক পুরুষই দ্বিতীয় বিয়ের আগে ভালোভাবে ভাবতেন। নারীদের অধিকার সুরক্ষিত করার ক্ষেত্রেও এটি কিছুটা ভূমিকা পালন করেছিল।
তবে আইনটি কার্যকর করার ক্ষেত্রে প্রশাসনিক দুর্বলতা স্পষ্ট ছিল। অনেক সময় বিয়ের তথ্য লুকিয়ে রাখা হতো, যা নিয়মটির কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়।
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে মুহাম্মদ ইউনুস সরকার ঘোষণা করে যে এই বিয়ে করের নিয়ম আর কার্যকর থাকবে না। সরকারের মতে, এই আইন যুগোপযোগী নয় এবং এটি মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে।
সরকারের এই সিদ্ধান্তকে সমাজের একটি বড় অংশ ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম মনে করে, এই নিয়ম বাতিল হওয়া উচিত ছিল অনেক আগেই। তাঁদের মতে, কারও ব্যক্তিগত জীবনে সরকারী হস্তক্ষেপ থাকা উচিত নয়।
তবে কিছু মানুষ, বিশেষ করে প্রবীণ প্রজন্ম, এই সিদ্ধান্তে হতাশ হয়েছেন। তাঁদের মতে, এই আইনটি বহুবিবাহ রোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছিল এবং এটি বাতিল করার ফলে সমাজে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
বিয়েতে কর ধার্য করার নিয়ম বিশ্বের খুব কম দেশেই রয়েছে। তবে কিছু দেশে বিয়ে বা তালাকের ক্ষেত্রে বিশেষ ফি নেওয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ:
- মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশ: তালাকের ক্ষেত্রে উচ্চ ফি ধার্য করা হয়, যা বিবাহবিচ্ছেদ নিরুৎসাহিত করতে সাহায্য করে।
- চীন: জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিয়ে এবং সন্তান ধারণের ওপর নানা নিয়ম চালু করা হয়েছিল।
বাংলাদেশের এই নিয়মটি বিশেষভাবে আলাদা, কারণ এটি সরাসরি বহুবিবাহ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রণীত হয়েছিল।
এই নিয়ম বাতিল হওয়ার পর সমাজে কী ধরনের প্রভাব পড়বে, তা নিয়ে এখনো আলোচনা চলছে। কেউ কেউ মনে করছেন, এই সিদ্ধান্তের ফলে বহুবিবাহের প্রবণতা বাড়তে পারে। অন্যদিকে, অনেকে মনে করেন, আইনটি কার্যকরভাবে কখনোই প্রয়োগ করা যায়নি, তাই এটি বাতিলের ফলে খুব বেশি পার্থক্য হবে না।
বাংলাদেশের বিয়েতে কর ধার্য করার নিয়মটি দেশের ইতিহাসে একটি বিতর্কিত অধ্যায় হিসেবে থেকে যাবে। এর মাধ্যমে বহুবিবাহ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হলেও, এটি পুরোপুরি সফল হয়নি। তবু এটি একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ ছিল, যা সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি এবং আইন ব্যবস্থার পরিবর্তনকে চিহ্নিত করে।
মুহাম্মদ ইউনুস সরকারের এই নিয়ম বাতিলের সিদ্ধান্ত দেশের আইনি ও সামাজিক কাঠামোর আধুনিকায়নের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এটি দেখায় যে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আইন এবং সমাজের চাহিদা পরিবর্তিত হয় এবং আইনেরও সেই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো প্রয়োজন।
আমাদের আশা, এই পরিবর্তন বাংলাদেশকে আরও উন্নত এবং আধুনিক সমাজ হিসেবে গড়ে তুলবে।