🌍 পৃথিবীর সাতটি ঐতিহ্যবাহী পুরোনো দেশ, যেখানে মানুষ একবার হলেও যেতে চায়!

Spread the love

পৃথিবীর সাতটি ঐতিহ্যবাহী পুরোনো দেশ, যেখানে মানুষ একবার হলেও যেতে চায়! বিশ্বের ইতিহাসে এমন কিছু দেশ রয়েছে, যাদের ঐতিহ্য, সভ্যতা এবং সংস্কৃতি হাজার হাজার বছরের পুরনো। এই দেশের প্রাচীন সভ্যতাগুলি আজও আমাদের জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করে, তাদের বিজ্ঞানের অগ্রগতি, সামাজিক প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় চিন্তা এবং রাজনৈতিক কাঠামো অনেক দেশের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব দেশ কেবল ইতিহাসের পাতায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং তাদের প্রভাব আজও পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে আছে। আজ আমরা জানবো পৃথিবীর সাতটি সবচেয়ে প্রাচীন দেশের কথা, যেগুলোর ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং সভ্যতা বহু যুগের স্মৃতি বহন করে।

১. ইরান (পার্সিয়া): পৃথিবীর প্রথম বিশ্ব সাম্রাজ্য

ইরান, যাকে প্রাচীন কাল থেকে পার্সিয়া বলা হত, পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন দেশ। ইরানের ইতিহাস প্রায় ৫৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে সাইরাস দ্য গ্রেটের মাধ্যমে গড়ে ওঠে, যিনি পার্সিয়া সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে পরিচিত। পার্সিয়া ছিল পৃথিবীর প্রথম বিশ্ব সাম্রাজ্য, যেখানে একাধিক জাতি, ভাষা এবং সংস্কৃতির সমন্বয়ে একটি বিশাল ও শক্তিশালী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পার্সিয়া সাম্রাজ্য পৃথিবীজুড়ে বাণিজ্য, সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থায় অগ্রগতি ঘটিয়েছে।

পার্সিয়ার প্রাচীন সভ্যতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল এর প্রশাসনিক দক্ষতা। সাইরাস দ্য গ্রেট এক অত্যন্ত দক্ষ শাসক ছিলেন, যিনি ভিন্ন ভিন্ন জাতি ও সংস্কৃতির মানুষের সঙ্গে সহিষ্ণুতা বজায় রেখে শাসন করতেন। পার্সিয়ায় নির্মিত হয়েছিল প্রথম আধুনিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে একক মুদ্রার ব্যবহার শুরু হয়। এছাড়া, পার্সিয়ার অসাধারণ স্থাপত্য, সাহিত্য, বিজ্ঞান এবং ধর্মীয় চিন্তা আজও বিশ্বের ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে আছে।

আজকের ইরান তার ইতিহাস এবং সংস্কৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা রেখে আধুনিক বিশ্বে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ইরানের প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ, বিশেষত পাসারগাদে সাইরাস দ্য গ্রেটের সমাধি, পর্যটকদের জন্য এক গুরুত্বপূৰ্ণ স্থান।

২. মিশর (ইজিপ্ট): পিরামিডের এবং মমির দেশ

মিশর, বা ইজিপ্ট, বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো সভ্যতার জন্মস্থান। প্রায় ৩১০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মিশরের প্রথম রাজা মেনেস রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। মিশর ছিল একটি দীর্ঘস্থায়ী রাজ্য, যেখানে এক ঐতিহ্যবাহী সভ্যতা গড়ে ওঠে, যা বিশ্বের ইতিহাসে আজও একটি অমূল্য ধন হিসেবে পরিগণিত হয়।

মিশরের সভ্যতা তার অমর স্থাপত্য, বিশেষত পিরামিড এবং স্ফিঙ্কসের জন্য সুপরিচিত। মিশরের পিরামিডগুলি আজও পৃথিবীর সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যশৈলী হিসেবে বিবেচিত। প্রাচীন মিশরীয়রা মৃতদের জন্য মমি প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করেছিল, যা আজও বিজ্ঞানী এবং ইতিহাসবিদদের জন্য এক বিস্ময়ের বিষয়। এছাড়া, মিশরের হায়ারোগ্লিফিক লিপি, যা তাদের ভাষা ছিল, সেগুলি আধুনিক যুগের গবেষকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার।

পিরামিডের এবং মমির দেশ

মিশরীয় সভ্যতা ছিল অত্যন্ত উন্নত। তারা কৃষি, জ্যোতির্বিজ্ঞান, চিকিৎসা এবং গণনায় দক্ষ ছিল। প্রাচীন মিশরীয়দের ধর্মীয় বিশ্বাস ছিল অত্যন্ত জটিল, যেখানে তাদের দেবতারা প্রকৃতি, শক্তি এবং জীবন-মৃত্যুর সাথে সম্পর্কিত ছিল। মিশরের রাজা ফারাওদের শাসনব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী এবং তারা ধর্মীয় কেন্দ্রিক একটি রাষ্ট্র পরিচালনা করতেন। মিশরীয় সভ্যতার প্রভাব আজও পৃথিবীজুড়ে গভীরভাবে অনুভূত হয়।

৩. গ্রিস: গণতন্ত্র, দর্শন এবং সাম্রাজ্যের ধারা

গ্রিসের সভ্যতা, যা প্রাচীন বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সভ্যতা হিসেবে পরিচিত, পৃথিবীজুড়ে এক বিশেষ মর্যাদা অর্জন করেছে। প্রায় ২৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে গ্রিসের সভ্যতা শুরু হয়, এবং এটি প্রায় ১১০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। গ্রিসের সভ্যতা দার্শনিক চিন্তা, গণতন্ত্রের উন্মেষ, যুদ্ধকৌশল এবং শিল্পকলায় অসাধারণ অগ্রগতি করেছিল।

গ্রিসের প্রাচীন দর্শনীয় চিন্তা, যেমন প্লেটো, সক্রেটিস, এবং অ্যারিস্টটল, পৃথিবীর চিন্তাভাবনা ও জ্ঞানের পরিসরে বিপ্লব ঘটিয়েছিল। এই দার্শনিকদের তত্ত্ব এবং তাঁদের চিন্তা আজও পৃথিবীজুড়ে শিক্ষা ও সমাজ ব্যবস্থার ভিত্তি হিসেবে পরিচিত। গ্রিসে গণতন্ত্রের ধারণা প্রথমবারের মতো গড়ে উঠেছিল, যেখানে জনগণ নিজেদের শাসক নির্বাচন করতে পারত।

গ্রিসের স্থাপত্যশিল্পও ছিল অসাধারণ, এবং তাদের নির্মিত পার্থেনন মন্দির আজও পৃথিবীজুড়ে এক অবিস্মরণীয় স্থাপত্য হিসেবে পরিচিত। গ্রিসের সাহিত্য, নাটক এবং শিল্পকলা আজও মানব সভ্যতার অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হয়। প্রাচীন গ্রিসের প্রভাব আজও পৃথিবীজুড়ে অনুভূত হয়, বিশেষত রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে।

৪. ভারত: বহুবিধ সংস্কৃতি এবং সভ্যতার মেলবন্ধন

ভারত, যার সভ্যতা প্রায় ২৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে গড়ে ওঠে, পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন এবং সমৃদ্ধ দেশ। ভারতের প্রাচীন সভ্যতা ছিল এক বিস্ময়কর ধারা, যা পৃথিবীকে অনেক দিক দিয়ে উন্নত করেছে। ভারতের ইন্দাস সভ্যতা (Indus Valley Civilization), যা ৩৩০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে গড়ে ওঠে, ছিল বিশ্বের প্রথম নগর সভ্যতার মধ্যে একটি।

তাজমহল

ভারতের ইতিহাসের মধ্যে রয়েছে বহু ধর্মের উদ্ভব, যেমন হিন্দু ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম, জৈন ধর্ম, এবং পরে ইসলাম, খ্রিস্টান ধর্ম। ভারতের সংস্কৃতি আজও বিশ্বব্যাপী বহু দেশ ও জনগণের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করে। ভারতের দার্শনিকতা, সাহিত্য, সংগীত, এবং চিত্রকলা পৃথিবীজুড়ে প্রশংসিত। ভারতের গণতন্ত্র, বিজ্ঞান, গণনা, চিকিৎসা, এবং অন্যান্য ক্ষেত্রেও অসাধারণ অগ্রগতি ঘটেছে। ভারতীয় দার্শনিক চিন্তা এবং সংস্কৃতি আজও বিশ্বজুড়ে গুরুত্বপূর্ণ।

৫. ইথিওপিয়া (অ্যাবিসিনিয়া): প্রাচীন আফ্রিকার অন্যতম শক্তি

ইথিওপিয়া, যাকে প্রাচীনকালে অ্যাবিসিনিয়া বলা হত, আফ্রিকার প্রাচীনতম দেশগুলির মধ্যে একটি। ইথিওপিয়ার ইতিহাস প্রায় ১ খ্রিষ্টাব্দে গড়ে ওঠে, যখন অ্যাক্সুম রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ইথিওপিয়া বিশ্বের প্রথম খ্রিস্টান রাষ্ট্র ছিল, যেখানে খ্রিস্টধর্ম ৪ শতকের দিকে গৃহীত হয়েছিল।

ইথিওপিয়ার সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় ঐতিহ্য খুবই গভীর। এখানকার ভাষা, স্থাপত্যশৈলী, এবং সংগীত আজও বিশ্বে অত্যন্ত সম্মানিত। ইথিওপিয়ার ইতিহাসের মধ্যে রয়েছে বহু যুদ্ধ, শাসনব্যবস্থা এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, যা আজও দেশটির জনগণের মধ্যে জীবন্ত রয়েছে।

৬. চীন: সভ্যতার এক বিশেষ কেন্দ্র

চীন, যার সভ্যতা ২০৭০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে শুরু হয়েছিল, পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন এবং বৃহৎ সভ্যতা। চীন একাধিক রাজবংশের অধীনে বহু বছর শাসিত হয়েছিল। চীনের সভ্যতা ছিল অত্যন্ত উন্নত, এবং এতে ছিল বিশাল সামরিক শক্তি, চমৎকার স্থাপত্য, উন্নত প্রযুক্তি এবং দার্শনিক চিন্তা। চীন প্রাচীন কালের আবিষ্কারগুলি, যেমন কাগজ, গানপাউডার, মুদ্রণ এবং রেশম, পৃথিবীজুড়ে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল।

চীনের দর্শন, বিশেষত কনফুসিয়াসবাদ এবং তাওবাদ, আজও পৃথিবীজুড়ে বিভিন্ন সমাজ ও সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলছে।

৭. জাপান: অতীত ও বর্তমানের মেলবন্ধন

জাপান, যার ইতিহাস প্রায় ২৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে শুরু হয়েছিল, আজ পৃথিবীর অন্যতম উন্নত দেশ। জাপান প্রাচীনকালে এক শক্তিশালী সাম্রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল, যেখানে শোগুন এবং সামুরাইদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

জাপানী সভ্যতা, সংস্কৃতি এবং প্রযুক্তি আজ পৃথিবীর শীর্ষে রয়েছে। জাপানী শিল্পকলা, যেমন চা-অনুষ্ঠান, কাবুকি নাটক, এবং জাপানি চিত্রকলা আজও পৃথিবীজুড়ে প্রশংসিত। প্রযুক্তির ক্ষেত্রে জাপান আজও বিশ্বব্যাপী একটি অগ্রণী দেশ।

এই সাতটি দেশ পৃথিবীর ইতিহাসে অমূল্য অবদান রেখে গেছে এবং তাদের প্রাচীন সভ্যতা আজও পৃথিবীজুড়ে বিস্ময় সৃষ্টি করে। তাদের সংস্কৃতি, ধর্ম, শিল্প, বিজ্ঞান এবং রাজনীতি আজও আমাদের জীবনকে প্রভাবিত করে চলেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *