সাধু-সন্ন্যাসীরা কেন লম্বা দাড়ি ও জটা রাখেন? নেপথ্যে লুকিয়ে কোন কারণ? প্রেমানন্দ মহারাজ কি বলছেন এ বিষয়ে?

Spread the love

মানবসমাজে সাধু-সন্ন্যাসীরা এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছেন। তাঁদের জীবনযাপন, পোশাক-পরিচ্ছদ এবং আচার-আচরণ সাধারণ মানুষের কাছে বরাবরই এক অদ্ভুত কৌতূহলের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাঁরা দুনিয়াবি প্রলোভন থেকে দূরে থাকেন এবং আধ্যাত্মিক সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। এই কারণেই তাঁদের জীবনের প্রতিটি দিক, এমনকি তাঁদের বাহ্যিক রূপও সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রশ্ন ও বিস্ময়ের সৃষ্টি করে।

তাঁদের মধ্যে লম্বা দাড়ি এবং জটা রাখা একটি বহুল প্রচলিত বৈশিষ্ট্য। অনেকেই জানতে চান, কেন সাধু-সন্ন্যাসীরা এমন চেহারা বজায় রাখেন? এটি কি কেবল একটি প্রথাগত নিয়ম, নাকি এর পিছনে লুকিয়ে আছে গভীর কোনো দার্শনিক বা আধ্যাত্মিক তাৎপর্য? সম্প্রতি এক ভক্তের এই প্রশ্নের উত্তরে প্রেমানন্দ মহারাজ এই বিষয়ে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন, যা আমাদের এই প্রথার আধ্যাত্মিক এবং দার্শনিক দিক সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করতে সাহায্য করে।

আধ্যাত্মিক দর্শনের আলোকে দাড়ি ও চুল লম্বা রাখার ধারণা অনেক গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ। সাধু-সন্ন্যাসীদের মতে, দাড়ি ও চুল লম্বা রাখা প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সামঞ্জস্য বজায় রাখার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। তাঁদের বিশ্বাস, চুল এবং দাড়ি মানব শরীরের একটি প্রাকৃতিক অংশ, যা কেবল বাহ্যিক সৌন্দর্য নয়, বরং আধ্যাত্মিক শক্তি ও মানসিক স্থিরতার প্রতীক হিসেবেও কাজ করে।

মহারাজ ব্যাখ্যা করেন যে, চুল ও দাড়ি হলো শরীরের একটি প্রাকৃতিক আচ্ছাদন, যা প্রকৃতির নিয়ম মেনে বিকশিত হয়। এটি ঠিক তেমনই, যেমন একটি বৃক্ষের শাখা-প্রশাখা তার কাণ্ডকে রক্ষা করে এবং তাকে শক্তিশালী করে তোলে। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা যায় যে, সাধু-সন্ন্যাসীরা তাঁদের দেহকে প্রকৃতির স্বাভাবিক অবস্থায় রেখে দেন এবং কৃত্রিম পরিবর্তনের প্রয়োজন বোধ করেন না। আধুনিক সমাজে মানুষ যখন বাহ্যিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে নানা রকম কৃত্রিম পদ্ধতি গ্রহণ করে, তখন সাধুরা এই কৃত্রিমতার বাইরে থেকে প্রকৃতির নিয়ম মেনে চলার একটি শক্তিশালী বার্তা দেন।

তাঁদের বিশ্বাস অনুযায়ী, দাড়ি ও জটা বৃদ্ধি পাওয়ার মাধ্যমে শরীরে বিশেষ ধরনের আধ্যাত্মিক শক্তি সঞ্চিত হয়। এটি মানসিক স্থিরতা বজায় রাখতে, ধ্যানের গভীরতায় প্রবেশ করতে এবং চিত্তের শান্তি অর্জনে সহায়তা করে। লম্বা দাড়ি ও চুল তাঁদের মধ্যে এক ধরনের স্বাভাবিক এবং প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যের অনুভূতি জাগিয়ে তোলে, যা তাঁদের আধ্যাত্মিক যাত্রার একটি অপরিহার্য অংশ।

সাধু-সন্ন্যাসীদের মতে, প্রকৃতি যেভাবে মানুষকে গড়ে তুলেছে, তা পরিবর্তন না করে তার সঙ্গে একাত্ম হওয়াই প্রকৃত সুখ ও শান্তির পথ। তাঁরা মনে করেন, শরীরের প্রতি এই প্রাকৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করলে তা মানবজীবনের গভীর সত্য উপলব্ধি করতে সাহায্য করে এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির দ্বার উন্মোচন করে।

প্রেমানন্দ মহারাজ উল্লেখ করেছেন যে, জটা (অজস্র পরস্পর সংযুক্ত চুল) আধ্যাত্মিক ত্যাগের এক জীবন্ত প্রতীক। শাস্ত্রে মহাদেব শিবের জটার বিশেষ উল্লেখ পাওয়া যায়। মহাদেবের জটা থেকে গঙ্গার প্রবাহিত হওয়ার উপাখ্যান এই ধারণাকে আরো শক্তিশালী করে। বলা হয়, তাঁর জটা প্রকৃতি, শক্তি ও ধৈর্যের প্রতীক। শিবকে “যোগীদের যোগী” বলা হয় এবং তাঁর জটা শুধুমাত্র একটি দৈহিক চিহ্ন নয়, এটি তাঁর আধ্যাত্মিক শক্তি ও প্রকৃতির সঙ্গে তাঁর সামঞ্জস্যের প্রতীক।

আরও পড়ুন: কুম্ভ মেলার আসল ইতিহাস,৪ ফোঁটা অমৃত পড়েই শুরু কুম্ভ!

মহাদেবের জটার এই ধারণা থেকে প্রভাবিত হয়ে সাধু-সন্ন্যাসীরা জটা রাখেন। তাঁদের কাছে জটা শুধুমাত্র ত্যাগের চিহ্ন নয়, বরং এটি তাঁদের আধ্যাত্মিক সাধনার অবিচ্ছেদ্য অংশ। জটা তাঁদের মনে করিয়ে দেয় যে, তাঁরা সংসার ত্যাগ করেছেন এবং তাঁদের লক্ষ্য শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক মুক্তি বা মোক্ষ অর্জন।

জটা সাধু-সন্ন্যাসীদের জন্য ধৈর্য, ত্যাগ এবং স্থিতিশীলতার প্রতীক। জটা রাখার মাধ্যমে তাঁরা নিজেদের সংসারিক জীবন থেকে মুক্ত বলে ঘোষণা করেন। চুলের এই অব্যবস্থাপনা এবং জটিলতা জীবনের জটিলতার প্রতি তাঁদের উদাসীনতাকে নির্দেশ করে।

জটা প্রক্রিয়া একটি দীর্ঘ সময়ের ধৈর্য ও তপস্যার ফল। এটি এক মুহূর্তে তৈরি হয় না। একজন সাধু তাঁর জটা যত্নসহকারে বৃদ্ধি করেন এবং এর প্রতিটি গিঁটে তাঁর আধ্যাত্মিক অগ্রগতি ও ধৈর্যের প্রতিফলন ঘটে। প্রেমানন্দ মহারাজের মতে, জটা হল সেই বাহ্যিক চিহ্ন, যা একজন সন্ন্যাসীকে তাঁর লক্ষ্যের প্রতি সচেতন ও নিবেদিত রাখে।

চুলের মতো দাড়িরও আধ্যাত্মিকতা ও আধ্যাত্মিক শক্তির সঙ্গে যোগসূত্র রয়েছে। হিন্দু ধর্মে এবং অন্যান্য আধ্যাত্মিক পথে দাড়িকে শক্তি, জ্ঞানের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অনেক যোগী বিশ্বাস করেন যে, দাড়ি বৃদ্ধি করা শরীরের শক্তি ধরে রাখে এবং তাঁদের আধ্যাত্মিক সাধনায় সাহায্য করে। এটি একটি ব্যক্তিকে প্রকৃতির কাছাকাছি নিয়ে আসে এবং জাগতিক জীবনের বন্ধন থেকে বিচ্ছিন্ন হতে সাহায্য করে।

হিন্দু শাস্ত্রে যেমন অথর্ববেদ, শিব পুরাণ, এবং যোগ সূত্র-তে চুল ও দাড়ির আধ্যাত্মিক গুরুত্ব নিয়ে নানা আলোচনা রয়েছে। শিব পুরাণে মহাদেবের জটার মাধ্যমে গঙ্গার অবতরণ কেবল একটি কাহিনী নয়, এটি প্রকৃতি ও জীবনের ধারার প্রতীক। অন্যদিকে, যোগ সূত্রে দেহের প্রতিটি অংশকে আধ্যাত্মিক শক্তির উৎস হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং চুল ও দাড়ি এর ব্যতিক্রম নয়।

বর্তমান যুগে সাধু-সন্ন্যাসীদের জটা ও দাড়ি আমাদের প্রাচীন আধ্যাত্মিক শিক্ষার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে। যদিও আজকের জীবনে সবাই এই ধারা অনুসরণ করেন না, তবুও এই প্রতীকগুলি আধ্যাত্মিকতার গভীর তাৎপর্যের কথা মনে করিয়ে দেয়। জটা এবং দাড়ি সেই প্রাচীন আধ্যাত্মিক তত্ত্বকে প্রতিফলিত করে, যা আমাদের প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হওয়ার কথা শেখায় এবং জীবনকে জাগতিক মোহমুক্ত করার প্রেরণা দেয়।

এইভাবে, চুল এবং দাড়ি কেবল বাহ্যিক চিহ্ন নয়, বরং এটি একটি উচ্চতর জীবনের পথে পথচলার অনুপ্রেরণা এবং শাস্ত্রীয় আদর্শের অনুসরণ।

এছাড়াও মহারাজ এই বিষয়টির একটি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও দেন। তিনি বলেন, “দাড়ি এবং চুল লম্বা রাখলে তা শরীরের শক্তি সংরক্ষণে সাহায্য করে। চুলের গোড়া মস্তিষ্কের সঙ্গে সংযুক্ত, যা সূর্যের আলো থেকে প্রাকৃতিক শক্তি শোষণ করে এবং শরীরে বিতরণ করে। এটি ধ্যান এবং প্রার্থনার সময়ে মানসিক স্থিরতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।”

মহারাজ আরও বলেন, সাধু-সন্ন্যাসীদের এই রূপটি তাঁদের সমাজ থেকে পৃথক করে। এটি তাঁদের সংসারী জীবন থেকে আলাদা হওয়ার প্রতীক। সাধুরা তাঁদের বাহ্যিক চেহারায় একটি সাধারণ বার্তা দেন—তাঁরা আর সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করছেন না। এই দাড়ি এবং জটা তাঁদের অন্তরের পরিবর্তনের একটি বহিঃপ্রকাশ।

প্রেমানন্দ মহারাজের বক্তব্যে স্পষ্ট যে, দাড়ি এবং জটা শুধু একটি প্রথা নয়, বরং এটি একটি গভীর অর্থবহ আচার। এটি ত্যাগ, ধৈর্য, এবং প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধার প্রতীক। সাধু-সন্ন্যাসীদের এই চেহারা তাঁদের অন্তরের আধ্যাত্মিক অবস্থান এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রতিফলন।

সাধারণ মানুষ হিসেবে এই বিষয়টি আমাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। বাহ্যিক সৌন্দর্যের পেছনে না ছুটে আমরা যদি প্রকৃতির সঙ্গে নিজের সম্পর্কের কথা ভাবি, তবে জীবনের গভীরতাকে উপলব্ধি করা সম্ভব। মহারাজের এই ব্যাখ্যা শুধু ভক্তদের নয়, প্রত্যেক মানুষের জন্যই এক অনুপ্রেরণা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *