আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে স্ক্রলিং। সোশ্যাল মিডিয়া, নিউজফিড, ভিডিও স্ট্রিমিং—অসংখ্য কনটেন্ট আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে, আর আমরা অবচেতনে একটার পর একটা কনটেন্ট দেখে যেতে থাকি। কখনো একটা কুকুরছানার মিষ্টি ভিডিও, কখনো পুরনো বন্ধুর সমুদ্রপাড়ে তোলা ছবি, কখনো বা কোনো গুরুত্বপূর্ণ খবর—এক মুহূর্তের জন্য থামলেও আবার স্ক্রিনে আঙুল চালিয়ে এগিয়ে যাই নতুন কিছু দেখার আশায়। লিফটে ওঠানামার সময়, বিছানায় শোবার আগে, কিংবা কোনো অপেক্ষারত মুহূর্তে—আমরা অজান্তেই ডুবে যাই স্ক্রলিংয়ের অসীম জগতে।
কিন্তু, কেন এটা এত আসক্তিকর? আমাদের স্নায়ুর উপর কী প্রভাব ফেলে এই নিরবচ্ছিন্ন স্ক্রলিং? কেন আমরা কিছুতেই এটি থামাতে পারি না? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে প্রথমেই বোঝা দরকার, স্ক্রলিং শুধু একটি অভ্যাস নয়, বরং এটি আমাদের মস্তিষ্কের এক বিশেষ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত।
লিডস্ বেকেট ইউনিভার্সিটির সাইকোলজি বিভাগের সিনিয়র লেকচারার এইলিশ ডিউকের মতে, ফোন হাতে নেওয়া এবং স্ক্রলিং শুরু করা একটি স্বয়ংক্রিয় অভ্যাস। আমরা বিষয়টি বুঝতে পারি না, কারণ এটি দীর্ঘদিন ধরে আমাদের আচরণের সঙ্গে মিশে গেছে। এটি অনেকটা বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় দরজা বন্ধ করার মতোই স্বাভাবিক।
গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের মনে হয় আমরা ১৮ মিনিটে একবার ফোন চেক করি, কিন্তু স্ক্রিন রেকর্ডিং থেকে বোঝা যায়, আমরা আসলে আরও ঘন ঘন ফোন হাতে তুলে নিই। স্ক্রিনের আলো জ্বলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মস্তিষ্ক সক্রিয় হয়ে ওঠে, কারণ স্মার্টফোনের ডিজাইন এবং আমাদের মস্তিষ্কের মধ্যে একধরনের সংযোগ তৈরি হয়ে গেছে।
এন ওয়াই ইউ ল্যাঙ্গনের সাইকিয়াট্রি বিভাগের অধ্যাপক আরিয়েন লিং মনে করেন, স্ক্রলিংয়ের অভ্যাসের পেছনে মানুষের স্বভাবগত কৌতূহল বড় ভূমিকা রাখে। মানুষ সবসময় জানতে চায়, চারপাশে কী ঘটছে। এটি একটি বিবর্তনগত বৈশিষ্ট্য, যা মানবজাতির টিকে থাকার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেই কারণেই মানুষ খবর পড়ে, দুর্ঘটনা দেখলে থামে, এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নতুন আপডেট খোঁজে। স্মার্টফোনের ডিজাইনও এই কৌতূহলকে কাজে লাগিয়ে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যাতে আমরা নিরবচ্ছিন্নভাবে তথ্য পেতে থাকি।
মানুষের মস্তিষ্ক সুখানুভূতির প্রতি আসক্ত। এটি পুরস্কারপ্রিয় এক অঙ্গ, যার নির্দিষ্ট কিছু অংশ যৌনতা, মাদক, এবং জুয়ার মতো আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতার সঙ্গে যুক্ত। যখন আমরা কোনো আনন্দদায়ক কিছু অনুভব করি, তখন আমাদের মস্তিষ্ক সেটি বারবার চাইতে থাকে। সামাজিক মাধ্যমে একটি নতুন ভিডিও, মজার টুইট, বা বন্ধুর পাঠানো একটি বার্তা আমাদের মস্তিষ্কের পুরস্কার ব্যবস্থাকে সক্রিয় করে, যার ফলে আমরা একের পর এক স্ক্রল করতে থাকি।
এখানে আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো মস্তিষ্কের যুক্তিনির্ভর অংশ, প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স। এই অংশ আবেগ নিয়ন্ত্রণের কাজ করে এবং ভারসাম্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করে। যখন আমরা স্ক্রলিং করি, তখন আমাদের আবেগপ্রবণ অংশ এটি চালিয়ে যেতে চায়, আর যুক্তিনির্ভর অংশ এটি থামানোর চেষ্টা করে। কিন্তু যারা অতিরিক্ত স্ক্রলিংয়ের আসক্ত, তাদের ক্ষেত্রে যুক্তিনির্ভর অংশটি সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। বিশেষ করে কিশোর-তরুণদের ক্ষেত্রে এটি বেশি হয়, কারণ তাদের প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স এখনও সম্পূর্ণরূপে বিকশিত হয়নি। ফলে, তারা আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না এবং স্ক্রলিংয়ের গভীরে হারিয়ে যায়।
এই স্ক্রলিংয়ের আরেকটি বড় সমস্যা হলো, এটি আমাদের সময়-জ্ঞান নষ্ট করে দেয়। অধ্যাপক ডিউকের মতে, যখন আমরা স্ক্রলিং করি, তখন একটি ফ্লো স্টেটের মধ্যে চলে যাই, যেখানে সময়ের ধারণা হারিয়ে যায়। টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে, যেখানে ব্যবহারকারীর আগ্রহ অনুযায়ী কনটেন্ট সাজানো থাকে, ফলে একজন ব্যবহারকারী একবার স্ক্রল করা শুরু করলে সেটি থামানো কঠিন হয়ে পড়ে।
অধ্যাপক লিং স্ক্রলিংয়ের আসক্তিকে বোঝানোর জন্য একটি রূপকের উদাহরণ দেন। যদি কোনো পথে আমরা অনেকবার হাঁটি, তাহলে সেটি আমাদের কাছে পরিচিত হয়ে যায় এবং আমরা সহজে সেখানে চলাফেরা করতে পারি। ঠিক তেমনই, যদি কেউ প্রতিনিয়ত স্ক্রলিং করে, তাহলে এটি তার মস্তিষ্কের জন্য ডিফল্ট অভিজ্ঞতায় পরিণত হয়, এবং তখন অন্যদিকে মনোযোগ দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রযুক্তির আসক্তির কোনো নির্দিষ্ট মানদণ্ড নেই, কারণ এটি ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হতে পারে। তবে, যদি মোবাইল ফোন ব্যবহারের ফলে জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, তাহলে সেটি সীমা অতিক্রম করে গেছে বলে ধরা হয়।
তাহলে, কীভাবে এই আসক্তি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব?
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, স্ক্রলিং কমানোর জন্য কয়েকটি কার্যকর উপায় অনুসরণ করা যেতে পারে। প্রথমত, নির্দিষ্ট সময় স্ক্রিন থেকে দূরে থাকা দরকার। গবেষণায় দেখা গেছে, ফোন ছাড়া হাঁটতে বের হওয়া বা ব্যায়াম করা স্ক্রলিংয়ের অভ্যাস কমাতে সাহায্য করে। দ্বিতীয়ত, বাস্তব দুনিয়ায় মানুষের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া বাড়াতে হবে। যেমন, সময় দেখার জন্য ঘড়ি ব্যবহার করা, বই পড়ার সময় ইন্টারনেট বন্ধ রাখা ইত্যাদি।
তৃতীয়ত, আমাদের উচিত প্রতিবার ফোন হাতে নেওয়ার কারণ সম্পর্কে সচেতন হওয়া। অধ্যাপক লিং বলেন, ফোন ব্যবহার অনেকটা ক্ষুধার মতো। আমরা বুঝতে পারি যে, আমাদের স্ক্রল করতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু সেটি নিয়ন্ত্রণ করাও সম্ভব। যদি আমরা এই তাড়নাকে প্রতিরোধ করতে শিখি, তাহলে স্ক্রলিংয়ের ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসা সহজ হবে।
স্ক্রলিং আমাদের জীবনযাত্রার অংশ হয়ে গেলেও, সেটি কখনও কখনও আমাদের সময়, মনোযোগ, এবং মানসিক স্থিতিশীলতার ক্ষতি করতে পারে। তাই, এর প্রভাব সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। আমাদের মস্তিষ্ক যেন প্রযুক্তির দাসে পরিণত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা উচিত। সংযমী ব্যবহারই হতে পারে এর আসক্তি থেকে মুক্তির একমাত্র উপায়।
আধুনিক প্রযুক্তির যুগে স্মার্টফোন আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। তবে, একটানা স্ক্রলিং করার প্রবণতা অনেকের জন্য সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়া, নিউজফিড বা বিনোদনমূলক কনটেন্ট দেখতে দেখতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায়, অথচ আমরা তা বুঝতেও পারি না। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই অতিরিক্ত স্ক্রলিং আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
লিডস্ বেকেট ইউনিভার্সিটির সাইকোলজি বিভাগের সিনিয়র লেকচারার এইলিশ ডিউক বলেন, “স্ক্রলিং একটি স্বয়ংক্রিয় অভ্যাস হয়ে গেছে, যা আমরা অজান্তেই করি। মস্তিষ্কের পুরস্কারপ্রিয় অংশ আমাদের এই কাজে আসক্ত করে ফেলে, ফলে আমরা বারবার স্ক্রল করতে থাকি।”
এই অভ্যাস নিয়ন্ত্রণে আনতে বিশেষজ্ঞরা তিনটি কার্যকর পরামর্শ দিয়েছেন:
অধ্যাপক আরিয়েন লিংয়ের মতে, ফোন থেকে কিছু সময়ের জন্য দূরে থাকা এই আসক্তি কমানোর অন্যতম কার্যকর উপায়। গবেষণায় দেখা গেছে, ফোন ছাড়া হাঁটতে বের হওয়া বা শরীরচর্চার সময় ফোন থেকে বিরতি নেওয়া আমাদের মনোযোগ ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে।
বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দেন, সময় দেখার জন্য মোবাইল ফোনের বদলে ঘড়ি ব্যবহার করা, বই পড়ার সময় ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ রাখা এবং বন্ধুবান্ধব বা পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর মতো অভ্যাস গড়ে তোলা দরকার। এতে বাস্তব জীবনে মনোযোগ বাড়বে এবং স্ক্রলিংয়ের প্রতি আকর্ষণ কমবে।
প্রশ্ন করা— “আমি কেন এটি ব্যবহার করছি?”— এই অভ্যাস স্ক্রলিংয়ের প্রতি নিয়ন্ত্রণ আনতে সাহায্য করতে পারে। অধ্যাপক লিং বলেন, “ফোন ব্যবহারের তাড়না অনেকটা ক্ষুধার মতো। যদি কেউ এটি নিয়ন্ত্রণ করতে শেখে, তবে স্ক্রলিংয়ের প্রতি আসক্তি কমানো সম্ভব।”
বিশেষজ্ঞদের মতে, নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার এবং কিছু সহজ কৌশল অবলম্বন করলে ফোনের অতিরিক্ত স্ক্রলিংয়ের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা সম্ভব। তবে, এজন্য সচেতনতা ও স্ব-নিয়ন্ত্রণ জরুরি।