ভারতে ওটিটি (OTT) প্ল্যাটফর্মের জনপ্রিয়তা গত কয়েক বছরে ব্যাপকভাবে বেড়েছে। ডিজিটাল মাধ্যমের মাধ্যমে দর্শকরা সহজেই বিভিন্ন ধরণের কনটেন্ট উপভোগ করতে পারছেন। তবে, এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কিছু ওটিটি প্ল্যাটফর্ম অশ্লীল ও অনৈতিক কনটেন্ট তৈরি করছিল বলে অভিযোগ উঠছিল। অবশেষে, কেন্দ্রীয় সরকার এই বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করল।
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক ঘোষণা করেছে যে, ১৮টি ওটিটি প্ল্যাটফর্ম বন্ধ করা হয়েছে, কারণ তারা অতিরিক্ত অশ্লীল কনটেন্ট প্রচার করছিল এবং নারীদের অসম্মানজনকভাবে উপস্থাপন করছিল। পাশাপাশি, ১৯টি ওয়েবসাইট, ১০টি মোবাইল অ্যাপ ও ৫৭টি সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টও ব্লক করা হয়েছে, যেগুলো এই প্ল্যাটফর্মগুলোর প্রচারের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছিল।
সরকার জানিয়েছে, এই পদক্ষেপের মাধ্যমে ভারতীয় সংস্কৃতি ও নৈতিক মূল্যবোধ রক্ষার চেষ্টা করা হয়েছে।
কোন কোন ওটিটি প্ল্যাটফর্ম বন্ধ হয়েছে?
এই ১৮টি ওটিটি প্ল্যাটফর্মের মধ্যে কয়েকটি নাম অনেক জনপ্রিয় ছিল এবং অনেকের মোবাইলে ডাউনলোড করা ছিল।
বন্ধ হওয়া ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলোর তালিকা:
- Dreams Films
- Voovi
- Yessma
- Uncut Adda
- Tri Flicks
- X Prime
- Neon X VIP
- Besharams
- Hunters
- Rabbit
- Xtramood
- Nuefliks
- MoodX
- Mojflix
- Hot Shots VIP
- Fugi
- Chikooflix
- Prime Play
এই অ্যাপগুলোর মধ্যে কিছু গুগল প্লে স্টোর ও অ্যাপল অ্যাপ স্টোরেও ছিল। একটি অ্যাপ ১ কোটির বেশি বার ডাউনলোড হয়েছে, এবং আরও দুটি অ্যাপ ৫০ লাখের বেশি বার ডাউনলোড হয়েছে।
কেন এই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলো?
সরকার বলেছে, এই প্ল্যাটফর্মগুলোর কনটেন্ট অত্যন্ত কুরুচিপূর্ণ ও নৈতিকতার পরিপন্থী। বিশেষ করে নিম্নলিখিত অভিযোগগুলো এসেছে:
- ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ককে বিকৃতভাবে দেখানো হয়েছে।
- পারিবারিক সম্পর্কের মধ্যে অনৈতিক যৌনতা দেখানো হয়েছে।
- নারীদের অসম্মানজনকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
- নগ্নতা এবং পর্নোগ্রাফির মতো কনটেন্ট প্রকাশ করা হয়েছে।
ভারতীয় দণ্ডবিধির ২৯২ ধারা অনুযায়ী, কুরুচিপূর্ণ বা অশ্লীল কনটেন্ট প্রকাশ করা একটি অপরাধ। এছাড়া, তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৬৭ ও ৬৭এ ধারাও লঙ্ঘন করা হয়েছে। সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, “এই প্ল্যাটফর্মগুলোর কনটেন্ট যুব সমাজের জন্য ক্ষতিকর এবং ভারতীয় সংস্কৃতির পরিপন্থী।”
সোশ্যাল মিডিয়ায় কিভাবে ছড়ানো হচ্ছিল এই কনটেন্ট?
এই প্ল্যাটফর্মগুলো শুধুমাত্র তাদের অ্যাপে কনটেন্ট প্রচার করত না, বরং সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার চালাতো। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, তারা ইউটিউব, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম এবং এক্স (আগে টুইটার) ব্যবহার করে প্রচারণা চালাতো। এই সমস্ত প্ল্যাটফর্মে তাদের অ্যাকাউন্ট ছিল এবং তারা সেখানে অশ্লীল ট্রেলার, কাট-করা দৃশ্য ও বাহ্যিক লিঙ্ক শেয়ার করত।
বন্ধ হওয়া সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টের সংখ্যা:
- ফেসবুক: ১২টি অ্যাকাউন্ট
- ইনস্টাগ্রাম: ১৭টি অ্যাকাউন্ট
- এক্স (টুইটার): ১৬টি অ্যাকাউন্ট
- ইউটিউব: ১২টি চ্যানেল
এই সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টগুলোর মোট ৩২ লক্ষেরও বেশি অনুসারী ছিল।
সরকারের পক্ষ থেকে বারবার সতর্কতা দেওয়া হয়েছিল
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী অনুরাগ সিং ঠাকুর একাধিকবার এই ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলোর বিরুদ্ধে সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন।
তিনি বলেছিলেন, “সৃজনশীলতার নামে অশ্লীলতা বরদাস্ত করা হবে না। সরকার ওটিটি ইন্ডাস্ট্রির বিকাশ চায়, কিন্তু তার মানে এই নয় যে নৈতিকতা ও শালীনতার সীমা অতিক্রম করা হবে।” কিন্তু এই প্ল্যাটফর্মগুলোর বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ আসার পরেও তারা তাদের কনটেন্ট সংশোধন করেনি। তাই বাধ্য হয়ে সরকার কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এই নিষেধাজ্ঞার পর ভবিষ্যতে ওটিটি ইন্ডাস্ট্রির কী হবে?
ভারতে ওটিটি ইন্ডাস্ট্রি এখন খুব বড় বাজার। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের কারণে অনেক নতুন নির্মাতা তাদের কাজ সহজেই দর্শকদের সামনে আনতে পারছেন। তবে এই ঘটনাটি দেখিয়ে দিল, সরকার এখন থেকে ওটিটি কনটেন্টের ওপর আরও বেশি নিয়ন্ত্রণ আনতে পারে।
ভবিষ্যতে যে পরিবর্তন আসতে পারে:
- বয়স ভিত্তিক কনটেন্ট ফিল্টার বাধ্যতামূলক হতে পারে।
- অশ্লীল কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণের জন্য নতুন আইন আসতে পারে।
- যেকোনো ওটিটি কনটেন্ট প্রকাশের আগে সরকারের অনুমোদন নিতে হতে পারে।
এখন থেকেই Netflix, Amazon Prime, Disney+ Hotstar-এর মতো বড় ওটিটি প্ল্যাটফর্ম তাদের কনটেন্ট আরও সাবধানে প্রকাশ করতে পারে। যারা ইতিমধ্যে এই অ্যাপগুলো ডাউনলোড করে রেখেছেন, তাদেরও সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। কারণ, এগুলো এখন আইনত নিষিদ্ধ, এবং যে কোনো সময় সাইবার সিকিউরিটি সংস্থা এগুলো অ্যাক্সেস করা বন্ধ করে দিতে পারে।
সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী, ভবিষ্যতে এই ধরণের প্ল্যাটফর্মের বিরুদ্ধে আরও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এই নিষেধাজ্ঞা ভারতের ডিজিটাল কনটেন্ট ইন্ডাস্ট্রির জন্য একটি বড় ধাক্কা হতে পারে। তবে, সরকার মনে করছে এটি সমাজের নৈতিকতা রক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকার জানিয়েছে, “আমরা সৃজনশীলতার বিরুদ্ধে নই, কিন্তু অনৈতিক কনটেন্ট ছড়ানোর অনুমতি দেওয়া হবে না।” এই ১৮টি ওটিটি প্ল্যাটফর্ম বন্ধ হওয়ার পরও যদি কেউ এগুলোর কনটেন্ট প্রচার বা দেখার চেষ্টা করেন, তাহলে তাদের বিরুদ্ধেও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে।