যিশু খ্রিস্ট ইতিহাসের অন্যতম প্রভাবশালী ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব। খ্রিস্টান ধর্মের কেন্দ্রীয় চরিত্র হলেও তিনি শুধু খ্রিস্টানদের জন্যই নন, বরং সমগ্র মানবজাতির জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতীকে পরিণত হয়েছেন। তাঁর জীবন, শিক্ষা এবং আত্মত্যাগ বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষের বিশ্বাস ও জীবনবোধকে গঠন করেছে। তাঁর মা মরিয়মও ইতিহাসে এক অনন্য স্থান অধিকার করেন।
যিশুর জন্ম নিয়ে বহু ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক বর্ণনা রয়েছে। খ্রিস্টান ধর্মমতে, মরিয়ম ছিলেন ঈশ্বরের এক বিশেষ আশীর্বাদপ্রাপ্ত নারী, যিনি কুমারী অবস্থায় যিশুর জন্ম দিয়েছিলেন। বাইবেল অনুসারে, ফেরেশতা গ্যাব্রিয়েল (ইসলামে জিবরাইল) মরিয়মের কাছে আসেন এবং তাঁকে জানান যে তিনি ঈশ্বরের ইচ্ছায় এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেবেন। খ্রিস্টানদের বিশ্বাস, যিশু হলেন ঈশ্বরের পুত্র এবং তিনি মানবজাতির মুক্তির জন্য পৃথিবীতে এসেছিলেন।
খ্রিস্টান ধর্মগ্রন্থ বাইবেলে যিশুর জীবন ও শিক্ষা বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে। তিনি দয়া, প্রেম ও ক্ষমার বার্তা প্রচার করেছেন। তিনি দুঃখী ও নিপীড়িতদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, অসুস্থদের নিরাময় করেছেন এবং সামাজিক বিভেদকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। তাঁর প্রসিদ্ধ উপদেশগুলোর মধ্যে রয়েছে “তোমার শত্রুকেও ভালোবাসো” এবং “যে তোমার এক গালে আঘাত করে, তার জন্য আরেক গালও বাড়িয়ে দাও।” তাঁর শিক্ষা মানবিকতা, সহিষ্ণুতা ও ন্যায়বিচারের ভিত্তি স্থাপন করেছে, যা আজও মানুষের চিন্তাধারাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।
যিশুর জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো তাঁর ক্রুশবিদ্ধ হওয়া। বাইবেলের বর্ণনানুসারে, যিশুকে বিশ্বাসঘাতকতা ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে রোমান শাসকদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। রোমান গভর্নর পন্তিয়াস পিলাত তাঁর বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করেন, এবং তাঁকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়। খ্রিস্টান বিশ্বাস অনুযায়ী, যিশুর মৃত্যু মানবজাতির পাপের মুক্তির জন্য ছিল, এবং তিন দিন পর তিনি পুনরুত্থিত হন। এই পুনরুত্থান খ্রিস্টধর্মের অন্যতম মূল ভিত্তি। খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করেন যে যিশু মৃত্যুকে জয় করেছেন এবং ঈশ্বরের রাজ্যে ফিরে গেছেন, যেখান থেকে তিনি আবার পৃথিবীতে আসবেন।
যিশুর মা মরিয়ম খ্রিস্টধর্মে বিশেষভাবে সম্মানিত একজন নারী। খ্রিস্টান বিশ্বাসে তিনি ঈশ্বরের আশীর্বাদপ্রাপ্তা, যিনি বিনীত ও নির্লোভ মনোভাব নিয়ে ঈশ্বরের ইচ্ছাকে গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর মাতৃত্ব ছিল আত্মত্যাগ ও সাহসের প্রতীক। তিনি যিশুর শৈশব থেকে শুরু করে তাঁর ক্রুশবিদ্ধ হওয়া পর্যন্ত পাশে ছিলেন। ক্যাথলিক ও অর্থোডক্স খ্রিস্টধর্মে মরিয়মকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়, এবং তাঁকে অনেক স্থানে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে দেখা হয়।
বিশ্বের বৃহত্তম ধর্মসমূহের মধ্যে খ্রিস্টধর্ম ও ইসলাম দুটি প্রধান স্থান দখল করে। যিশু খ্রিস্টানদের জন্য ঈশ্বরের পুত্র হিসেবে পূজিত হলেও, ইসলাম ধর্মে তাঁকে একজন মহান নবী হিসেবে গণ্য করা হয়। ইসলাম ধর্মে যিশুর স্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তাঁর মা মরিয়মের সম্মানও অসাধারণভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
ইসলাম ধর্মে মরিয়ম একমাত্র নারী, যার নামে কোরআনে একটি সম্পূর্ণ সূরা রয়েছে—সূরা মরিয়ম। কোরআনের বিভিন্ন স্থানে মরিয়মের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, যা তাঁর মর্যাদা ও গুরুত্বকে তুলে ধরে। মুসলিমদের কাছে তিনি পবিত্র, সৎ, এবং ঈশ্বরের প্রতি সম্পূর্ণ আত্মসমর্পিত একজন নারী হিসেবে পরিগণিত। কোরআনে বলা হয়েছে, মরিয়ম কুমারী ছিলেন এবং ঈশ্বরের ইচ্ছায় অলৌকিকভাবে নবী ঈসাকে জন্ম দেন।
কোরআনের ভাষ্যমতে, ফেরেশতা জিবরাইল মরিয়মের কাছে আসেন এবং তাঁকে সুসংবাদ দেন যে তিনি ঈশ্বরের অনুমতিক্রমে একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দেবেন। এ নিয়ে তিনি বিস্মিত হয়ে বলেন, “আমি তো কুমারী, আমার সন্তান হবে কীভাবে?” তখন ফেরেশতা তাঁকে জানান, এটি আল্লাহর ইচ্ছায় ঘটবে এবং নবী ঈসা আল্লাহর এক নিদর্শন হিসেবে প্রেরিত হবেন।
যিশুর জন্মের পর মরিয়ম যখন তাঁর সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে আসেন, তখন তাঁকে কঠোর প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। লোকেরা জানতে চায়, তিনি কীভাবে বিবাহিত না হয়ে সন্তানের জন্ম দিলেন। তখন নবী ঈসা অলৌকিকভাবে শিশুকালেই কথা বলে তাঁর মাতার সতীত্বের প্রমাণ দেন এবং ঘোষণা করেন যে তিনি ঈশ্বরের প্রেরিত এক নবী।
খ্রিস্টধর্ম ও ইসলামের মধ্যে নবী ঈসা সম্পর্কে মূল পার্থক্য হলো তাঁর ঈশ্বরত্ব নিয়ে। খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করে যে যিশু হলেন ঈশ্বরের পুত্র এবং তিনিই মানবজাতির মুক্তিদাতা। অন্যদিকে, ইসলাম ধর্মে নবী ঈসাকে একজন নবী হিসেবে গণ্য করা হয়, যিনি মানুষকে সত্যের পথে পরিচালিত করতে এসেছিলেন। ইসলামে বিশ্বাস করা হয় যে নবী ঈসাকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়নি; বরং ঈশ্বর তাঁকে স্বর্গে তুলে নিয়েছেন এবং একদিন তিনি পুনরায় পৃথিবীতে ফিরে আসবেন।
ইসলামের দৃষ্টিতে নবী ঈসা ছিলেন মুসা, ইব্রাহীম, ও মুহাম্মদের মতোই একজন নবী, যিনি ঈশ্বরের বার্তা বহন করেছেন। তবে তাঁর অনুসারীদের একটি বড় অংশ পরবর্তীতে তাঁকে ঈশ্বরের পুত্র হিসেবে পূজা করতে শুরু করে, যা ইসলামের একত্ববাদের ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
মরিয়ম ইসলাম ধর্মে শুধু একজন নবীর মা নন, বরং তিনি ঈশ্বরের প্রতি অবিচল বিশ্বাস ও আত্মসমর্পণের প্রতীক। মুসলিম সমাজে তাঁকে নারীদের জন্য এক অনুকরণীয় চরিত্র হিসেবে গণ্য করা হয়। তাঁর ধৈর্য, পবিত্রতা, এবং ঈশ্বরের প্রতি নিরঙ্কুশ আস্থা মুসলিম নারীদের জন্য এক অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে।
ইসলামে নবী ঈসার পরিচয় তাঁর মাতার নামের সঙ্গে সংযুক্ত, যা মরিয়মের গুরুত্বকে আরও বাড়িয়ে তোলে। কোরআনে নবী ঈসাকে “ইবনে মরিয়ম” বা “মরিয়মের পুত্র” বলে উল্লেখ করা হয়েছে, যা প্রতীকীভাবে বোঝায় যে ইসলামে নবী ঈসার পরিচয় তাঁর মাতার সঙ্গে অত্যন্ত জোরালোভাবে যুক্ত।
মরিয়ম ও নবী ঈসাকে নিয়ে ইসলাম ও খ্রিস্টধর্মের বর্ণনায় কিছু পার্থক্য থাকলেও উভয় ধর্মই তাঁদের অসাধারণ মর্যাদা দিয়েছে। ইসলামে মরিয়ম কেবল একজন নবীর মা নন, বরং একজন পবিত্র নারী, যিনি ঈশ্বরের নিদর্শন বহন করেছেন। নবী ঈসার অলৌকিক জন্ম ও তাঁর ভবিষ্যৎ প্রত্যাবর্তনের বিশ্বাস ইসলাম ধর্মের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায় যে ইসলাম ধর্ম যিশু ও মরিয়মের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে এবং তাঁদেরকে ঈশ্বরের বিশেষ আশীর্বাদপ্রাপ্ত ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করে।
ইসলাম ধর্মেও যিশু ও মরিয়ম অত্যন্ত সম্মানিত। ইসলামে যিশুকে নবী ঈসা নামে উল্লেখ করা হয় এবং তাঁকে মহান নবী হিসেবে গণ্য করা হয়। মুসলমানদের কাছে ঈসা একজন অলৌকিক ক্ষমতাধারী নবী, যিনি আল্লাহর ইচ্ছায় অসুস্থদের সুস্থ করেছেন এবং মৃত ব্যক্তিদের পুনর্জীবিত করেছেন। কোরআনে তাঁর জন্মের অলৌকিকত্ব বর্ণিত হয়েছে এবং তাঁর মাতার বিশুদ্ধতা বিশেষভাবে তুলে ধরা হয়েছে। কোরআনে সূরা মরিয়ম নামের একটি সম্পূর্ণ অধ্যায় রয়েছে, যেখানে মরিয়ম ও নবী ঈসার জীবন সম্পর্কে বলা হয়েছে।
যদিও খ্রিস্টান ও মুসলিম দৃষ্টিভঙ্গিতে কিছু পার্থক্য রয়েছে, উভয় ধর্মই যিশু ও মরিয়মকে অসাধারণ মর্যাদা দেয়। খ্রিস্টানদের কাছে যিশু ঈশ্বরের পুত্র, আর মুসলমানদের কাছে তিনি আল্লাহর এক প্রেরিত নবী। ইসলামে বিশ্বাস করা হয় যে নবী ঈসাকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়নি, বরং আল্লাহ তাঁকে স্বর্গে তুলে নিয়েছেন এবং তিনি শেষ যুগে ফিরে আসবেন।
যিশুর শিক্ষা ও জীবনদর্শন আজও মানুষের হৃদয়ে গভীরভাবে প্রোথিত। দয়া, ক্ষমা, আত্মত্যাগ ও প্রেমের যে আদর্শ তিনি স্থাপন করেছিলেন, তা মানব সভ্যতার বিবর্তনে এক অনন্য দৃষ্টান্ত। একইভাবে, তাঁর মা মরিয়ম নারীত্বের পবিত্রতার এক অনন্য প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হন। তাদের কাহিনি শুধু ধর্মীয় গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা মানব ইতিহাসের এক চিরন্তন অধ্যায় হয়ে রয়েছে।