ভারতে কেন মোবাইল ফোনে ইনকামিং, আউটগোয়িং কল কেন ‘+91’ দিয়েই শুরু হয়? জেনে নিন আসল কারণ

Spread the love

বিশ্বজুড়ে প্রতিটি দেশের নিজস্ব একটি ফোন কোড রয়েছে, যা আন্তর্জাতিকভাবে ফোন কল করতে ব্যবহার করা হয়। এই কোডগুলো নির্ধারণ করে ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন (আইটিইউ), যা জাতিসংঘের একটি বিশেষ সংস্থা। ফোন নম্বরের আগে থাকা এই কোডের পেছনে একটি বিশেষ যুক্তি এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে।

প্রথমদিকে, টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা সীমিত ছিল এবং আন্তর্জাতিক কলের ক্ষেত্রে আলাদা করে কোনো কোড ব্যবহারের প্রয়োজন হতো না। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে বিভিন্ন দেশে টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নতি ঘটলে এবং এক দেশ থেকে অন্য দেশে কল করার প্রয়োজন বাড়তে থাকলে, প্রতিটি দেশকে আলাদা পরিচয় দেওয়ার জন্য একটি নির্দিষ্ট কোড প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৬০-এর দশকে আইটিইউ এই সমস্যা সমাধানের জন্য একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করে এবং বিশ্বের দেশগুলোকে বিভিন্ন জোনে ভাগ করে ফোন কোড নির্ধারণ করে।

আইটিইউ পুরো বিশ্বকে মোট ৯টি ভৌগোলিক অঞ্চলে বিভক্ত করেছে। প্রতিটি অঞ্চলের জন্য নির্দিষ্ট এক বা একাধিক ডিজিট বরাদ্দ করা হয়েছে, যা সেই অঞ্চলের সব দেশের ফোন কোডের ভিত্তি তৈরি করেছে। উদাহরণস্বরূপ, উত্তর আমেরিকার দেশগুলোর কোড শুরু হয় +1 দিয়ে, যেমন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় +1। দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোর কোড +5 এবং +7 দিয়ে শুরু হয়, যেমন ব্রাজিলের +55 এবং আর্জেন্টিনার +54। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের কোড +3 এবং +4 দিয়ে শুরু হয়, যেমন যুক্তরাজ্যের +44, ফ্রান্সের +33 এবং জার্মানির +49। আফ্রিকার দেশগুলো +2 দিয়ে শুরু হয়, যেমন দক্ষিণ আফ্রিকার +27, মিশরের +20।

এশিয়ার দেশগুলোর ক্ষেত্রে +8 এবং +9 ব্যবহৃত হয়। চীনের কোড +86, জাপানের +81 এবং ভারতের কোড +91। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ যেমন পাকিস্তান +92, বাংলাদেশ +880, শ্রীলঙ্কা +94 এবং নেপালের +977 কোড পায়।

ফোন কোড নির্ধারণের ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করা হয়েছিল। প্রথমত, অঞ্চলভিত্তিক ভাগ করার মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের মধ্যে নম্বরের সংঘর্ষ এড়ানো সম্ভব হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, জনসংখ্যার ওপর ভিত্তি করে কিছু দেশকে নির্দিষ্ট ডিজিটের কোড দেওয়া হয়েছিল, যাতে ফোন নম্বর সহজে সনাক্ত করা যায়। তৃতীয়ত, বিভিন্ন দেশের টেলিযোগাযোগ অবকাঠামোর ওপর ভিত্তি করে তাদের জন্য সহজলভ্য এবং কার্যকর কোড বরাদ্দ করা হয়েছিল।

ঐতিহাসিকভাবে, টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তির প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ফোন কোডের প্রয়োজনীয়তা আরও বেড়েছে। একসময় আন্তর্জাতিক কল পদ্ধতি জটিল ছিল, কিন্তু এখন ইন্টারনেট এবং মোবাইল প্রযুক্তির উন্নতির ফলে কলিং সিস্টেম অনেক সহজ হয়েছে। তবু এখনও প্রতিটি দেশের জন্য নির্দিষ্ট কোড ব্যবহৃত হয়, যা আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগের ক্ষেত্রে পরিচিতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

বর্তমানে, অনেক দেশ নিজস্ব টেলিকম অপারেটরের মাধ্যমে নির্দিষ্ট কোড সংরক্ষণ করে এবং প্রযুক্তিগত উন্নতির ফলে আন্তর্জাতিক ফোন কলের ব্যয় অনেকটাই কমে এসেছে। তবে ফোন কোডের গুরুত্ব এখনো অপরিবর্তিত রয়ে গেছে, কারণ এটি প্রতিটি দেশের স্বতন্ত্র পরিচয়ের অন্যতম প্রতীক।

আন্তর্জাতিক ফোন কোড ব্যবস্থার কিছু অতিরিক্ত তথ্য এবং তাৎপর্য রয়েছে, যা এই ব্যবস্থার গুরুত্ব আরও স্পষ্ট করে তোলে।

ফোন কোড নির্ধারণের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ভৌগোলিক অঞ্চলই বিবেচনা করা হয়নি, কিছু বিশেষ ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম রাখা হয়েছে। যেমন, রাশিয়া এবং কাজাখস্তান একই ফোন কোড +7 ব্যবহার করে, যদিও তারা ভিন্ন ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক সীমানার অন্তর্ভুক্ত। আবার, কানাডা এবং যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই +1 কোড ব্যবহার করে, কারণ তাদের টেলিযোগাযোগ অবকাঠামো প্রায় একই নীতির অধীনে পরিচালিত হয়।

কিছু অঞ্চলের জন্য বিশেষ কোডও নির্ধারণ করা হয়েছে, যেমন আন্তর্জাতিক টোল-ফ্রি নম্বরের জন্য +800, যা বিভিন্ন দেশে বিনামূল্যে কল করার সুবিধা দেয়। এছাড়া স্যাটেলাইট পরিষেবার জন্য +870, যা সমুদ্রের জাহাজ ও দূরবর্তী স্থানে যোগাযোগের জন্য ব্যবহৃত হয়।

কিছু দেশ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের কোড পরিবর্তন করেছে। জার্মানি একসময় +49-এর পরিবর্তে +4 ব্যবহার করত, পরে এটি আপডেট করা হয়। একইভাবে যুগোস্লাভিয়া ভেঙে যাওয়ার পর বিভিন্ন নতুন রাষ্ট্র আলাদা কোড গ্রহণ করে, যেমন সার্বিয়া +381, ক্রোয়েশিয়া +385 এবং বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা +387।

কিছু ছোট দেশ বা অঞ্চল তাদের বড় প্রতিবেশী দেশের ফোন কোড ব্যবহার করে। যেমন, ভ্যাটিকান সিটি ইতালির +39 কোডের অংশ, এবং মোনাকো ফ্রান্সের +33-এর পরিবর্তে +377 ব্যবহার করলেও ফ্রান্সের টেলিকম পরিষেবার ওপর নির্ভরশীল।

বর্তমানে ইন্টারনেট কলিং (VoIP) এবং মোবাইল কমিউনিকেশন প্রযুক্তির বিকাশের ফলে ফোন কোড ব্যবস্থার ভূমিকা কিছুটা কমে এলেও এটি এখনো আনুষ্ঠানিক আন্তর্জাতিক যোগাযোগের জন্য অপরিহার্য। ই-সিম প্রযুক্তি এবং ক্লাউড কমিউনিকেশনের মাধ্যমে যদিও ভৌগোলিক নির্ভরতা কমছে, তবে ফোন কোড এখনো নির্দিষ্ট দেশের পরিচিতি বজায় রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

আমরা প্রায়শই দেখি যে ভারতের মোবাইল নম্বর বা ফোন কল +91 দিয়ে শুরু হয়। এটি ভারতের আন্তর্জাতিক ডায়ালিং কোড বা কান্ট্রি কোড। কিন্তু কখনও কি ভেবে দেখেছেন, কেন ভারতের ক্ষেত্রে +91 নির্ধারিত হয়েছে? কেন অন্য কোনো নম্বর নয়? এর পেছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস ও কারণ রয়েছে। আসুন বিস্তারিতভাবে জেনে নেওয়া যাক।

কান্ট্রি কোড হল একটি নির্দিষ্ট সংখ্যা, যা একটি দেশকে আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগে সনাক্ত করতে ব্যবহৃত হয়। যখন কেউ এক দেশ থেকে অন্য দেশে ফোন করে, তখন তাকে প্রথমে সেই দেশের কোড ডায়াল করতে হয়। এটি আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন (International Telecommunication Union – ITU) দ্বারা নির্ধারিত হয়।

আইটিইউ জাতিসংঘের একটি সংস্থা, যা বিশ্বব্যাপী টেলিযোগাযোগ নীতিমালা নির্ধারণ করে। তাদের মূল দায়িত্বগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জন্য আলাদা আলাদা ডায়ালিং কোড নির্ধারণ করা।

আইটিইউ আন্তর্জাতিক ফোন কল ব্যবস্থাকে ৯টি ভৌগোলিক অঞ্চলে ভাগ করেছে। ভারতের মতো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো Zone 9-এর অন্তর্ভুক্ত। এই জোনে অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর ফোন কোড +9 দিয়ে শুরু হয়। যেমন:

ভারত → +91
পাকিস্তান → +92
আফগানিস্তান → +93
শ্রীলঙ্কা → +94
মালদ্বীপ → +960
নেপাল → +977

অতএব, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে যখন কান্ট্রি কোড দেওয়া হয়, তখন তাদের জন্য +9 সিরিজ নির্ধারণ করা হয়।

আইটিইউ যখন ভারতের জন্য একটি কান্ট্রি কোড নির্ধারণ করছিল, তখন কিছু বিষয় বিবেচনা করা হয়েছিল:

যেহেতু ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশ, তাই তাকে এমন একটি কোড দেওয়া হয় যা সহজে মনে রাখা যায় এবং ব্যবহার করা যায়।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য +9 সিরিজ বরাদ্দ করা হয়েছিল, আর এর মধ্যে ভারতের জন্য +91 নির্ধারিত হয়।

ভারত আন্তর্জাতিকভাবে বাণিজ্য, প্রযুক্তি, ব্যবসা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায়, তার জন্য একটি সহজে মনে রাখা যায় এমন কোড নির্ধারণ করা হয়।

এই কারণগুলোর ভিত্তিতেই ভারত +91 কোডটি পায়।

বর্তমানে, ফোন কলের মাধ্যমে প্রতারণার ঘটনা ক্রমাগত বাড়ছে। অনেক সময় স্ক্যাম কলাররা ভুয়া নম্বর ব্যবহার করে প্রতারণার চেষ্টা করে। তাই, অজানা বা সন্দেহজনক নম্বর থেকে ফোন এলে সতর্ক থাকা জরুরি। কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ:

  1. অপরিচিত আন্তর্জাতিক নম্বর থেকে কল এলে সাবধান থাকুন।
  2. +91 ছাড়া অন্য কোনো নম্বর থেকে ভারতীয় কল দাবি করলে যাচাই করুন।
  3. ব্যক্তিগত তথ্য বা ব্যাংক সম্পর্কিত তথ্য ফোনে কখনও শেয়ার করবেন না।
  4. ফোন কলের মাধ্যমে OTP বা পাসওয়ার্ড চাইলেই সতর্ক হোন।
  5. কোনো সন্দেহজনক কল এলে ট্রাই ডু নট ডিসট্রাব (DND) মোড চালু করুন বা সরকারি হেল্পলাইনে অভিযোগ করুন।

ভারতের আন্তর্জাতিক কান্ট্রি কোড +91 হওয়ার পেছনে একটি সুসংগঠিত ব্যবস্থা ও কারণ রয়েছে। আইটিইউ বিভিন্ন দেশের জন্য নির্দিষ্ট নম্বর নির্ধারণ করে, এবং ভারতের জন্য +91 নির্ধারিত হয় কারণ এটি দক্ষিণ এশিয়ার +9 জোনের অংশ।

একইসঙ্গে, ফোন কল স্ক্যাম থেকে সতর্ক থাকা অত্যন্ত জরুরি। কোনো অজানা নম্বর থেকে কল এলে বা সন্দেহজনক কার্যকলাপ দেখলে সঙ্গে সঙ্গে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। নিরাপদ এবং সুরক্ষিত যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য আমাদের সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *