নিসানের যাত্রা শুরু হয় ১৯৩৩ সালে, যখন টোকিওভিত্তিক টোবাটা কাস্টিং ও দাতসুন একত্রিত হয়ে “Jidosha-Seizo Co., Ltd.” নামে কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠা করে। পরে এর নাম পরিবর্তন করে “Nissan Motor Co., Ltd.” রাখা হয়।
প্রথমদিকে, নিসান দাতসুন ব্র্যান্ডের অধীনে ছোট ও কার্যকরী গাড়ি তৈরি করত, যা দ্রুত জনপ্রিয়তা পায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, নিসান নতুন উদ্ভাবন নিয়ে আসে এবং ১৯৫০-এর দশকে আমেরিকান বাজারেও প্রবেশ করে। ১৯৬৯ সালে নিসান তাদের আইকনিক গাড়ি Nissan Skyline GT-R উন্মোচন করে, যা আজও বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়।
১৯৯৯ সালে, কোম্পানির আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়ে পড়লে ফরাসি গাড়ি নির্মাতা রেনলোর সঙ্গে জোট বাঁধে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানান ব্যবস্থাপনাগত সমস্যার কারণে নিসানের বাজারমূল্য ও জনপ্রিয়তা কমতে শুরু করে।
জাপানের দুই বিশাল গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান নিসান ও হোন্ডার মধ্যে একসময় সম্ভাব্য সংযুক্তির আলোচনা চলছিল। তবে, সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, নিসানের গর্ব ও বাস্তবতাকে মেনে নিতে না পারার প্রবণতাই এই সংযুক্তিকে ব্যর্থ করেছে।
নিসান, যেটি ১৯৩৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, দীর্ঘদিন ধরে জাপানি অটোমোবাইল শিল্পে একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাদের আর্থিক অবস্থা নাজুক হয়ে পড়েছে, বিশেষ করে রেনলোর সঙ্গে জোট বাঁধার পর থেকেই কোম্পানিটি নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়। অন্যদিকে, হোন্ডা তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল অবস্থায় ছিল এবং ইলেকট্রিক ভেহিকেলের বাজারেও যথেষ্ট ভালো করছিল।
সূত্রমতে, হোন্ডা ও নিসান সংযুক্তির পরিকল্পনাটি ২০১৯-২০ সালের দিকে গোপনে আলোচনায় ছিল। নিসানের তৎকালীন নেতৃত্ব এই সংযুক্তির মাধ্যমে নতুন প্রযুক্তি ও বাজারে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করতে চেয়েছিল। তবে নিসানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে একটি গোঁড়ামি কাজ করছিল। তারা তাদের স্বাধীনতা হারানোর ভয়ে চুক্তিটি এগিয়ে নিতে আগ্রহী ছিল না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, নিসানের এই অহংকারী মনোভাবই তাদের আরও আর্থিক সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে। যদি তারা সময়মতো বাস্তবতা মেনে নিত এবং হোন্ডার সঙ্গে শক্তিশালী অংশীদারিত্ব গড়ে তুলত, তবে তারা বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক অটোমোবাইল বাজারে আরও ভালো অবস্থানে থাকতে পারত।
নিসান ও হোন্ডার মধ্যে সম্ভাব্য চুক্তির ব্যর্থতার খবরটি সম্প্রতি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে। একসময় মনে করা হচ্ছিল, এই দুই বৃহৎ জাপানি গাড়ি নির্মাতা কোম্পানি একত্রিত হলে অটোমোবাইল শিল্পে এক নতুন মাত্রা যোগ করবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই চুক্তি আর বাস্তবে রূপ নেয়নি। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নিসানের জেদ এবং বাস্তব পরিস্থিতি অনুধাবন করতে ব্যর্থ হওয়াই এই চুক্তির ভেস্তে যাওয়ার মূল কারণ। তবে হোন্ডার পক্ষ থেকেও কিছু কারণ ছিল, যা এই চুক্তিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে বাধা দিয়েছে।
নিসানের আর্থিক অবস্থা বর্তমানে খুব একটা ভালো নয়। সংস্থাটি তাদের ভবিষ্যৎ লাভের পূর্বাভাস প্রায় ৭০ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছে, যা বিনিয়োগকারীদের জন্য উদ্বেগের বিষয়। এছাড়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিসানের ব্র্যান্ডের জনপ্রিয়তা কমছে এবং কোম্পানির বিভিন্ন বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সমস্যা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে, নিসান ও হোন্ডার একীভূত হওয়া একটি যৌক্তিক পদক্ষেপ হতে পারত। কিন্তু, রয়টার্সের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, নিসান তাদের অর্থনৈতিক সংকট সম্পর্কে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন ছিল না এবং এই অনীহাই হোন্ডার মধ্যে সন্দেহ সৃষ্টি করেছিল।
বিশেষজ্ঞদের মতে, নিসানের ব্যবস্থাপনা কাঠামোয় সমস্যা রয়েছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান পেলহ্যাম স্মিথার্স অ্যাসোসিয়েটসের বিশ্লেষক জুলি বুটের মতে, “তারা নিজেদের অবস্থান এবং ব্র্যান্ডের মূল্যকে অতিমূল্যায়ন করছে এবং ব্যবসা পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনাকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করতে পারছে না।” তিনি আরও বলেন, নিসানের উচিত বর্তমান পরিস্থিতি বাস্তবভাবে মূল্যায়ন করা এবং গাড়ি শিল্পের পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়া।
নিসান-হোন্ডা চুক্তির মূল প্রতিবন্ধকতা হিসেবে একটি বড় কারণ ছিল নিসানের পরিকল্পনা সংক্রান্ত অনিশ্চয়তা। হোন্ডার অভিযোগ ছিল যে নিসান কর্মী ছাঁটাই এবং উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোনো পরিকল্পনা দেখাতে পারেনি। এছাড়া, নিসান তাদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদন কেন্দ্র যেমন কিউশু, টেনেসির স্মিরনা, মেক্সিকোর আগুয়াসকালিয়েন্তেস এবং যুক্তরাজ্যের সান্ডারল্যান্ড প্ল্যান্টগুলো বন্ধ বা সংক্ষিপ্ত করার বিষয়ে আগ্রহী ছিল না। অথচ, অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলার জন্য এই ধরনের পদক্ষেপ জরুরি হতে পারত। নিসানের এই অনমনীয় অবস্থান হোন্ডাকে চুক্তি থেকে সরে আসতে বাধ্য করে।
অন্যদিকে, নিসানের ফরাসি অংশীদার রেনল্টের বিষয়টিও এই আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। নিসানের সাবেক অংশীদার রেনল্ট এখনও কোম্পানির উল্লেখযোগ্য পরিমাণ শেয়ার ধরে রেখেছে। রেনল্টের মূল লক্ষ্য ছিল এই শেয়ারগুলোর সর্বোচ্চ মূল্য আদায় করা এবং ইউরোপে নিজেদের প্রতিদ্বন্দ্বী তৈরি না করা। এই কারণে, তারা নিসানের বাজারমূল্য ধরে রাখার চেষ্টা করছে। তাছাড়া, একটি নতুন প্রতিবেদন অনুসারে, তাইওয়ানের ফক্সকন ইতোমধ্যেই রেনল্টের সাথে নিসানের শেয়ার কেনার বিষয়ে আলোচনা করছিল। নিসান যখন এটি জানতে পারে, তখন তারা দ্রুত হোন্ডার সাথে একীভূত হওয়ার চিন্তা শুরু করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত, এই আলোচনা সফল হয়নি।
এদিকে, ফক্সকন এই পরিস্থিতি খুব কৌশলে ব্যবহার করছে। কোম্পানিটির চেয়ারম্যান ইয়ং লিউ জানিয়েছেন যে, ফক্সকনের লক্ষ্য অধিগ্রহণ নয়, বরং সহযোগিতা। তিনি আরও বলেন, তারা নিসানসহ অন্যান্য জাপানি গাড়ি নির্মাতাদের সাথে বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদনের জন্য কাজ করতে আগ্রহী। নিসান যখন একটি সম্ভাব্য অধিগ্রহণের বিষয়ে উদ্বিগ্ন, তখন ফক্সকন কৌশলগতভাবে “সহযোগিতা” প্রস্তাব দিয়ে তাদের আস্থাভাজন হতে চাইছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভবিষ্যতে ফক্সকন নিসানের বড় অংশীদার হয়ে উঠতে পারে।
এছাড়া, ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন আমদানি শুল্ক নীতিও অটোমোবাইল শিল্পে বড় পরিবর্তন আনতে পারে। ফোর্ডের সিইও জিম ফার্লি সম্প্রতি বলেছেন যে, মেক্সিকো ও কানাডার গাড়ির উপর দীর্ঘমেয়াদী ২৫ শতাংশ শুল্ক বসালে এটি মার্কিন অটোমোবাইল শিল্পের জন্য বড় ক্ষতির কারণ হবে। এই নীতির ফলে দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান এবং ইউরোপের গাড়ি প্রস্তুতকারকদের জন্য এটি বড় সুবিধার সুযোগ তৈরি করবে। বিশেষত, হুন্ডাই-কিয়া এবং ইউরোপের বিএমডব্লিউ ও মার্সিডিজের জন্য এটি এক বিশাল স্বর্ণযোগ হতে পারে।
অন্যদিকে, ইউরোপের বাজারেও পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। বিশেষত, পোর্শে বর্তমানে বড় সংকটে রয়েছে। কোম্পানিটি উৎপাদন খরচ বাড়ানোর ঝুঁকি নিতে চাইছে না এবং তাদের শেয়ারের মূল্যও উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পোর্শের দীর্ঘমেয়াদী লাভের লক্ষ্যমাত্রা অর্ধেকে নেমে এসেছে। কোম্পানির বর্তমান অবস্থা নতুন বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য খুব একটা অনুকূল নয়।
এই পরিস্থিতিতে নিসানের ভবিষ্যৎ কী হতে পারে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি কোম্পানি শীঘ্রই তাদের অবস্থান পরিবর্তন না করে, তাহলে তারা আরও গভীর সংকটে পড়তে পারে। হোন্ডার সাথে চুক্তি বাতিল হওয়ার ফলে নিসান এখন একা টিকে থাকার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। যদিও ফক্সকনের সাথে সহযোগিতার সম্ভাবনা রয়েছে, তবে এটি কতটা সফল হবে তা এখনই বলা কঠিন।
বর্তমান পরিস্থিতি স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, গাড়ি শিল্পে দ্রুত পরিবর্তন আনতে না পারলে কোম্পানিগুলো প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবে না। নিসানের উচিত দ্রুত বাস্তবতার সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়া এবং নিজেদের আর্থিক অবস্থার উন্নতির জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। অন্যথায়, তারা ভবিষ্যতে আরও বড় সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে।
অটোমোবাইল বিশেষজ্ঞদের মতে, নিসান যদি অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা না নেয়, তবে ভবিষ্যতে আরও বড় সংকটের মুখোমুখি হতে পারে। হোন্ডার সঙ্গে সংযুক্তির সুযোগ হারানোর পর, এখন তাদের সামনে টিকে থাকার জন্য নতুন কৌশল গ্রহণ করা ছাড়া আর কোনো পথ নেই।