জাপানের মানুষদের স্বাস্থ্যবান, মেদহীন চেহারা এবং দীর্ঘায়ুর রহস্য জানতে আগ্রহী নয়, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তাঁদের চেহারা পুতুলের মতো নিখুঁত, উজ্জ্বল ত্বক, শক্তিশালী শরীর, এবং অবিশ্বাস্যরকমের দীর্ঘ আয়ু দেখে বিশ্বজুড়ে মানুষ অবাক হয়ে যায়। এমনকি বয়স ৬০ পেরিয়ে গেলেও তাঁদের শরীর আর মন তরুণদের মতোই সতেজ থাকে। কীভাবে তাঁরা এমন সুস্থ জীবনধারা বজায় রাখেন, সেটি জানার জন্যই সবাই তাঁদের অভ্যাসের দিকে চোখ রাখে। জাপানিদের এই অসাধারণ স্বাস্থ্য আর দীর্ঘ জীবনের পেছনে রয়েছে কিছু সহজ অথচ কার্যকর অভ্যাস, যা তাঁরা প্রতিদিন পালন করেন।
তাহলে আসুন, জাপানিদের এই অভ্যাসগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা যাক এবং কীভাবে আমরা নিজেদের জীবনে সেগুলো প্রয়োগ করতে পারি, তা জেনে নেওয়া যাক।
কীভাবে তাঁরা সবসময় সুস্থ ও ফিট থাকেন?
জাপানিরা তাঁদের দৈনন্দিন জীবনে এমন কিছু অভ্যাস মেনে চলেন, যা তাঁদের শরীর ও মন দুটিকেই সুস্থ রাখে। এখানে তাঁদের ৫টি মূল অভ্যাসের কথা বলা হলো, যা তাঁদের চিরতরুণ রাখে।
১. নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম এবং শরীরচর্চা
জাপানের মানুষ প্রচুর হাঁটেন এবং সাইকেল চালান। তাঁরা প্রতিদিন অফিস, বাজার, বা নিত্যকার কাজের জন্য গাড়ি বা বাইকের পরিবর্তে হাঁটা বা সাইক্লিংকে বেছে নেন। এতে তাঁদের শরীর সর্বদা সচল থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত হাঁটা কেবল শরীরের ক্যালোরি বার্ন করেই না, হৃদযন্ত্র, পেশি এবং হাড়ের স্বাস্থ্যের উন্নতিও করে।
তাঁরা শরীরচর্চাকে শুধুমাত্র একটি কাজ হিসেবে দেখেন না, বরং এটি তাঁদের জীবনের অংশ। পার্কে বা পাহাড়ে হাঁটতে যাওয়া, সাইকেল চালানো কিংবা মৃদু যোগব্যায়াম করাও তাঁদের দৈনন্দিন রুটিনের অংশ।
২. ধীরে ধীরে খাওয়ার অভ্যাস
জাপানিদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অভ্যাস হলো ধীরে ধীরে খাওয়ার পদ্ধতি। তাঁরা প্রতিটি খাবার ভালোভাবে চিবিয়ে খান এবং কোনো ধরনের তাড়াহুড়ো করেন না। এই পদ্ধতিটি তাঁদের হজম প্রক্রিয়া উন্নত করে এবং খাবার থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি গ্রহণ করতে সাহায্য করে। দ্রুত খেলে খাবারের প্রকৃত স্বাদ উপভোগ করা যায় না এবং অতিরিক্ত খাওয়ার ঝুঁকিও থাকে। তবে ধীরে খাওয়ার অভ্যাস তাঁদের এই সমস্যাগুলো এড়াতে সাহায্য করে।
৩. তাজা এবং অপরিশোধিত খাবারের প্রতি নির্ভরতা
জাপানিদের খাদ্যতালিকায় প্রধানত থাকে তাজা শাকসবজি, ফল, মাছ, সি-ফুড, এবং গলা ভাত। তাঁরা প্রক্রিয়াজাত (processed) বা রিফাইন্ড খাবার একেবারেই এড়িয়ে চলেন। এসব খাবারে থাকে প্রচুর প্রিজারভেটিভ, যা শরীরে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।
জাপানি রান্নার একটি বৈশিষ্ট্য হলো, তাঁরা কম তেল ও মশলা ব্যবহার করেন। এতে তাঁদের খাবার স্বাদে হালকা হলেও স্বাস্থ্যকর। সুশি, মিসো স্যুপ, গ্রিলড মাছ, এবং সিজনাল সবজি তাঁদের পছন্দের খাবার।
৪. ছোট পরিসরে খাবার খাওয়া
জাপানিদের আরেকটি বিশেষ অভ্যাস হলো ছোট পরিসরে খাবার খাওয়া। তাঁরা ছোট পাত্রে খাবার পরিবেশন করেন এবং খুব সংযমীভাবে খাওয়ার পরিমাণ নির্ধারণ করেন। জাপানি সংস্কৃতিতে “হারাহাচি বু” নামক একটি ধারণা প্রচলিত, যার অর্থ হলো “৮০ শতাংশ পেট ভরা থাকলেই খাওয়া বন্ধ করা।” অতিরিক্ত খাওয়ার অভ্যাস শরীরের জন্য ক্ষতিকর। তবে জাপানিরা তাঁদের এই অভ্যাসের মাধ্যমে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখেন এবং পেটের উপর চাপ কমান।
৫. গ্রিন টি পান করার অভ্যাস
গ্রিন টি জাপানি সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি তাঁদের শরীরকে ডিটক্স করতে সাহায্য করে এবং অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের মাধ্যমে বয়সের ছাপ কমায়। অতিরিক্ত ক্যালোরি যোগ না করেই এটি শরীরকে হাইড্রেটেড রাখে। নিয়মিত গ্রিন টি পান তাঁদের ত্বক উজ্জ্বল এবং শরীর চাঙা রাখতে সাহায্য করে।

জাপানিদের জীবনধারার আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক
জাপানিদের স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের রহস্য শুধুমাত্র খাদ্য এবং শরীরচর্চার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তাঁদের জীবনধারায় আরও কিছু বিষয় রয়েছে, যা তাঁদের দীর্ঘজীবনের মূল চাবিকাঠি।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ
জাপানের পরিবেশ অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন। রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে ঘরের ভেতর পর্যন্ত তাঁদের পরিচ্ছন্নতার প্রতি নজর থাকে। একটি পরিচ্ছন্ন পরিবেশ শুধু শারীরিক স্বাস্থ্যকেই উন্নত করে না, মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও দারুণ গুরুত্বপূর্ণ।
পরিষ্কার বাতাস, জল এবং জীবনের সামগ্রিক পরিবেশ তাঁদের সুস্থ থাকতে সাহায্য করে।
কর্ম-জীবন ও ব্যক্তিগত জীবনের ভারসাম্য
জাপানিরা কাজ এবং ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে একটি নিখুঁত ভারসাম্য বজায় রাখেন। তাঁরা কেবল অফিসের কাজকেই জীবনের সবকিছু মনে করেন না। নিজেদের শখ, পরিবার, বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানো এবং মানসিক প্রশান্তির জন্যও সময় বের করেন।
নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা
জাপানিরা তাঁদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে খুবই সচেতন। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা তাঁদের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এতে কোনো রোগের লক্ষণ শুরুতেই ধরা পড়ে, ফলে সময়মতো চিকিৎসা শুরু করা যায়।
জাপানিরা পরিবার এবং বন্ধুদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখেন। একাকীত্ব তাঁদের জীবনে খুব কম দেখা যায়। সামাজিক বন্ধনের মাধ্যমে তাঁরা মানসিকভাবে স্থিতিশীল থাকেন, যা দীর্ঘ জীবনের অন্যতম কারণ। জাপানিদের জীবনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। তাঁরা জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করেন এবং ছোট ছোট বিষয়েও খুশি হতে জানেন। এটি তাঁদের মানসিক চাপ দূর করে এবং সুস্থ থাকতে সাহায্য করে।
ভাত এবং জাপানিদের খাদ্যাভ্যাস
বিশ্বের অনেক জায়গায় ভাত খাওয়াকে ওজন বৃদ্ধির কারণ মনে করা হয়। কিন্তু জাপানিরা ভাতকে তাঁদের প্রধান খাবার হিসেবে গ্রহণ করেও দীর্ঘায়ু ও সুস্বাস্থ্য বজায় রাখেন। তাঁরা স্টিকি রাইস বা গলা ভাত খান, যা উচ্চমানের ফাইবারসমৃদ্ধ এবং সহজপাচ্য। ভাত তাঁরা খুব অল্প পরিমাণে খান এবং এটি তাঁদের খাদ্যতালিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

দীর্ঘায়ুতে বিশ্বের শীর্ষে জাপান
বিশ্বের সবচেয়ে বেশি গড় আয়ুর দেশগুলোর মধ্যে জাপান শীর্ষে। জাপানিদের গড় আয়ু প্রায় ৮৪ বছর, যা তাঁদের দীর্ঘজীবন এবং স্বাস্থ্যকর জীবনধারার অন্যতম প্রমাণ। গবেষণায় দেখা গেছে, তাঁদের খাদ্যাভ্যাস, শরীরচর্চা, ইতিবাচক মানসিকতা এবং সামাজিক বন্ধন এই দীর্ঘজীবনের প্রধান কারণ।
জাপানিদের এই সহজ অথচ কার্যকর অভ্যাসগুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োগ করা সম্ভব। নিয়মিত হাঁটা, তাজা খাবার খাওয়া, ধীরে খাওয়া এবং কাজের পাশাপাশি পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো—এই অভ্যাসগুলো আমাদেরও সুস্থ এবং সুখী জীবন দিতে পারে।
জাপানিরা প্রমাণ করেছেন, সুস্থ থাকতে গেলে বড় কোনো পরিবর্তন দরকার নেই। ছোট ছোট ভালো অভ্যাসই জীবনের মান উন্নত করতে পারে। তাই তাঁদের জীবনধারাকে অনুপ্রেরণা হিসেবে নিয়ে আমরা নিজেদের জীবনেও পরিবর্তন আনতে পারি। সুস্থ জীবন যাপনের জন্য জাপানিদের অভ্যাসগুলো আমাদের শেখার মতোই।