বাংলাদেশ কি মুক্তিযুদ্ধের কথা ভুলে যাচ্ছে? জানেন, ঠিক কী ছিল ভারতীয় সেনার সামরিক কৌশল?

Spread the love

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অত্যাচার ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াই করে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী একসঙ্গে যুদ্ধ করেছে। এই যুদ্ধের ফলাফল ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা, যা আমাদের জাতির ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে ভারত ও বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা অসামান্য বীরত্ব প্রদর্শন করেছেন। ভারতের পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্তে যুদ্ধের প্রস্তুতি, পাকিস্তানি বাহিনীর তুলনায় তাদের সুবিধা এবং মুক্তিবাহিনীর অবদানের ইতিহাস আমাদের নতুন প্রজন্মের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রেরণাদায়ক।

আশা করি এই দুটি ভূমিকা আপনাকে সহায়ক হবে। আপনাদের মতামত এবং প্রশ্ন আমাদের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না। ধন্যবাদ।

১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ড আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল – এবং আগামীকাল, শুক্রবার, আমরা উদযাপন করব সেই বিজয় দিবসের ৪৫তম বার্ষিকী।

একাত্তরের বিজয় দিবসের আগে টানা দুই সপ্তাহ ধরে চলেছিল তীব্র যুদ্ধ – যার একদিকে ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, আর অন্যদিকে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী।

ভারত কীভাবে সেই সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি নিয়েছিল, পাকিস্তানি বাহিনীর তুলনায় কোথায় ছিল তাদের সুবিধা বা অসুবিধা?

১৯৭১ সালের ৩রা ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যখন একযোগে ভারতের মোট এগারোটি বিমানঘাঁটিতে হামলা চালায়, সঙ্গে সঙ্গে পাল্টা সেনা অভিযানের কথা ঘোষণা করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। ভারতের পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্তে পুরাদস্তুর যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় সেদিন থেকেই, যদিও তার প্রস্তুতিপর্বটা চলছিল আগের বেশ কয়েক মাস ধরে।

যুদ্ধবিদ্যার বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল দীপঙ্কর ব্যানার্জি বলছিলেন, এই দেরিটা ইচ্ছাকৃত ছিল – কারণ ভারতের তখন তৈরি হওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় দরকার ছিল।

তিনি বলছেন, “মার্চে পূর্ব পাকিস্তানে ক্র্যাকডাউন শুরু হওয়ার পর পরই কোনও সামরিক অভিযানের কথা ভাবাটা সম্ভব ছিল না। সেটা একদিক থেকে ভাল সিদ্ধান্তই আমি বলব, ফিল্ড মার্শাল ম্যানেকশও তখনই অভিযান চালানোর পক্ষে ছিলেন না। মনে রাখতে হবে, ভারতীয় সেনা কিন্তু তার আগে কোনও দিনই পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ করতে হবে ভেবে কোনও প্রস্তুতি নেয়নি। ফলে দেরিটা করা হয়েছিল সে জন্যই।”

তখনকার ভারতীয় সেনাপ্রধান স্যাম মানেকশ-ও পরে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ২৭ এপ্রিল ক্যাবিনেট মিটিংয়ের পরই প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাকে ডেকে বলেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানে এই অবস্থা চলছে – ভারত কেন সেনা অভিযান চালাবে না?

তিনি সটান মিসেস গান্ধীকে জানিয়ে দেন, এখন সেনারা তৈরি নয়, সময় লাগবে। ‘মেমসাহেব’ তাতে রুষ্ট হলেও আপত্তি করেননি, মানেকশ বলেছিলেন প্রস্তুতি শেষ হলেই তিনি সরকারকে জানাবেন।

সেনারা যখন যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করেছে, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তখন দুনিয়া জুড়ে কূটনীতির হোমওয়ার্ক শুরু করে দিয়েছেন। ভারতের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল শঙ্কর রায় চৌধুরীর কথায়, “মার্চে ক্র্যাক ডাউনের পর পূর্ব পাকিস্তান থেকে শরণার্থীরা ভারতে ঢুকতে শুরু করল। ইন্দিরা গান্ধী তখন বিশ্বের বিভিন্ন রাজধানীতে ঘুরে ঘুরে বললেন, পাকিস্তান যেন তাদের দেশের বাঙালিদের ওপর অত্যাচার বন্ধ করে। কারণ এতে ভারতে যে বিপুল শরণার্থী ঢুকছে, সেই ভার বহন করা ভারতের পক্ষে সম্ভব নয়।”

বিমান ছিনতাইয়ে ভারতের সুবিধা

জেনারেল রায়চৌধুরী তখন ভারতীয় সেনার এক তরুণ মেজর, একাত্তরের যুদ্ধে নিজে লড়েছিলেন খুলনা-যশোর ফ্রন্টে। ডিসেম্বরে আসল যুদ্ধ শুরু হল, সে সময়কার দুটো ঘটনা ভারতকে খুব সাহায্য করেছিল।

“ঠিক তার আগের বছর ১৯৭০ সালে পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন হয়েছিল। রাজ্যে নকশাল আন্দোলন ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার কারণে সে সময় প্রচুর সৈন্য মোতায়েন ছিল। যুদ্ধের আগে সেটা ভীষণ কাজে দিয়েছিল।”

“আর একটা অদ্ভুত সমাপতন – সে সময় ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের একটা কাঠমান্ডু-দিল্লি ফ্লাইট ছিনতাই করে রাওয়ালপিন্ডিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পাল্টা ব্যবস্থা নিয়ে ভারত তখন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ভেতর বিমান চলাচল বন্ধ করে দেয় – অর্থাৎ নিজেদের আকাশসীমা তাদের ব্যবহার করতে দেয় না। ফলে পাকিস্তান ভারী সামরিক সরঞ্জাম, রসদ বা সৈন্যসামন্ত সরাসরি আকাশপথে পূর্বদিকে আনতে পারেনি, তাদের সেটা শ্রীলঙ্কা হয়ে সমুদ্রপথে পাঠাতে হয়েছিল।”

তবে ভারতের সেনাদেরও কিন্তু নদীমাতৃক বাংলাদেশে লড়ার জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ছিল না। দীপঙ্কর ব্যানার্জির কথায়, “বাষট্টির পর থেকে ইস্টার্ন সেক্টরে ভারতের প্রায় সব সেনাই প্রস্তুতি নিতেন চীনের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য। মাউন্টেন ওয়ারফেয়ার, হাই অল্টিচিউড লড়াইয়ের প্রশিক্ষণ নিতেন তারা। অস্ত্রশস্ত্র বা স্ট্র্যাটেজিও সেভাবেই জোগানো হত। বাংলাদেশে নদী ও জলময় পরিবেশে যুদ্ধের জন্যও তাদের আলাদা প্রস্তুতি নিতে হয়েছিল।”

অনেকটা এই কারণেই জুন থেকে অক্টোবর – বর্ষার এই লম্বা সময়টা ভারত চেয়েছিল যে কোনওভাবে যুদ্ধটা ঠেকিয়ে রাখতে। একাত্তরের যুদ্ধের অন্যতম নায়ক লে: জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা স্বীকার করেছেন, শঙ্কর রায় চৌধুরীও মনে করেন সেই সিদ্ধান্ত যুক্তিসঙ্গত ছিল।

“বর্ষাকালে আক্রমণ করাটা মোটেও বুদ্ধিমানের কাজ হত না। তখন গোটা বাংলাদেশ এক প্রকাণ্ড জলাভূমির চেহারা নেয়। তবে বর্ষার সময়টায় পূর্ব পাকিস্তানের ভেতরে থাকা বিদ্রোহীরা পাকিস্তানি ফৌজের যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি করতে পেরেছিল। বৃষ্টি থামলে চারদিক থেকে তাদের আক্রমণ করা হয়, তারা তেমন প্রতিরোধ গড়তে পারেনি – দ্রুত আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।”

যুদ্ধটা স্থায়ী হয়েছিল দু সপ্তাহেরও কম। দীপঙ্কর ব্যানার্জি বলছেন, তেরো দিনের বেশি টানলে ভারত হয়তো চাপে পড়ে যেত। বঙ্গোপসাগরে মার্কিন সেভেন্থ ফ্লিটের আনাগোনাও হয়তো শুরু হয়ে যেত।

“যুদ্ধটা তাড়াতাড়ি শেষ হল দুদিক থেকে একযোগে আক্রমণের ফলে। ভেতর থেকে মুক্তিবাহিনী আর বাইরে থেকে ভারতীয় ফৌজ মিলে একসঙ্গে অভিযান চালিয়েছিল। ডিসেম্বরে আমেরিকা ও পশ্চিমী দেশগুলো ভারতের ওপর ক্রমশ চাপ বাড়াচ্ছিল – যুদ্ধটা বেশিদিন টানলে আমরা হয়তো কখনওই তা শেষ করতে পারতাম না।”

কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে ভারত ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মধ্যে পার্থক্য কোথায় ছিল? জেনারেল রায়চৌধুরী বলছেন, “প্রথম কথা ওভারহোয়েল্মিং স্ট্রেংথ! সামরিক ক্ষমতায় ভারত অনেক এগিয়ে ছিল। ভারতের কৌশল ছিল, পাকিস্তানি সেনা যেখানে শক্ত ঘাঁটি গড়ে অগ্রযাত্রাকে রুখতে চাইবে, সেটাকে পাশ কাটিয়ে সোজা ঢাকার দিকে এগিয়ে যাওয়া। এটাকে বলে ‘বাইপাসিং’।”

“এর ফলে দেখা গেল ঢাকার যখন পতন হচ্ছে, ভারতের পেছনে ফেলে আসা বহু জায়গায় পাকিস্তানি সেনারা তখনও ক্যান্টনমেন্টে বসে আছে এবং অসহায় আত্মসমর্পণে বাধ্য হচ্ছে।”

তবে এটাও অস্বীকার করা যায় না, একাত্তরের যুদ্ধে ভারতের প্রায় বারোশো সেনা প্রাণ দিয়েছিলেন – ফলে লড়াইটা তাদের জন্যও অনায়াস ছিল না।

“যদিও ভারতের পরিকল্পনা ছিল পাকিস্তানি সেনার শক্ত ঘাঁটিগুলো এড়িয়ে সোজা ঢাকার দিকে অ্যাডভান্স করা, সেই রাস্তা খোলার জন্য কয়েকটা শক্ত ঘাঁটিতে আক্রমণ চালাতেই হয়েছিল। হিলিতে ভারতের বেশ কিছু সৈন্য হতাহত হয়েছিলেন।”

মুক্তিবাহিনীর ভূমিকা

সামরিক ইতিহাসবিদরা একমত, পূর্ব পাকিস্তানের অচেনা যুদ্ধক্ষেত্রেও ভারত সহজেই লড়াই জিততে পেরেছিল স্থানীয় মানুষজন আর মুক্তিবাহিনীর কারণে।

মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর ভূমিকা

“তাদের সবচেয়ে বড় অবদান ছিল, পাকিস্তানি ফৌজ পশ্চাৎবর্তী এলাকাটাকেও নিরাপদ দেখতে পারছিল না মুক্তিবাহিনীর জন্যই। তাদের সব সময় আশঙ্কা থাকত, রাস্তা কেটে দিচ্ছে, রসদপত্র আসছে না, সাপ্লাই অ্যামবুশ হচ্ছে – এটা তাদের মনোবল একদম চুরমার করে দিয়েছিল!” বলছেন শঙ্কর রায়চৌধুরী।

মেজর জেনারেল দীপঙ্কর ব্যানার্জিও মনে করিয়ে দিচ্ছেন, পৃথিবীতে যুদ্ধের ইতিহাসে নানা গেরিলা বাহিনীর অসাধারণ কৃতিত্বের সঙ্গেই তুলনীয় মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *