সনাতন ধর্মে বিদ্যার দেবী সরস্বতীর গুরুত্ব অপরিসীম। তিনি জ্ঞান, বুদ্ধি, সংগীত, শিল্পকলা ও বাগ্মিতার অধিষ্ঠাত্রী দেবী। তাঁর আশীর্বাদে মানুষ বিদ্যার আলোয় আলোকিত হয় এবং মনের অন্ধকার দূরীভূত হয়। হিন্দু পুরাণ অনুসারে, দেবী সরস্বতী শ্বেতবস্ত্র পরিহিতা, শ্বেত পদ্মে আসীন এবং তাঁর বাহন রাজহংস। এক হাতে বীণা, অন্য হাতে বেদপুস্তক ও জপমালা—এই রূপেই তিনি পূজিত হন।
প্রতি বছর মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে বসন্ত পঞ্চমী বা শ্রীপঞ্চমীর দিন দেবী সরস্বতীর পূজা অনুষ্ঠিত হয়। বিশেষত শিক্ষার্থীরা এই দিনে তাঁকে আরাধনা করে বিদ্যা ও জ্ঞানের বর লাভের আশায়। দেবী সরস্বতীর উৎপত্তি সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন মতবাদ পাওয়া যায়। কেউ বলেন, তিনি ব্রহ্মার মানস কন্যা। কেউ বলেন, তিনি স্বয়ং নারায়ণের অংশ, আবার কেউ কেউ তাঁকে ব্রহ্মার স্ত্রী বলেও উল্লেখ করেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, দেবী সরস্বতীর স্বামী কে? এই প্রশ্নের উত্তর কী বলে হিন্দু পুরাণ?
পুরাণ অনুযায়ী, দেবী সরস্বতীর জন্ম স্বয়ং ব্রহ্মার মানসপটে। অর্থাৎ তিনি ব্রহ্মার মানস কন্যা, যাঁর সৃষ্টি হয়েছিল জ্ঞান ও বিদ্যার বিস্তার ঘটানোর জন্য। সরস্বতীর জন্মের পর তাঁর অপরূপ সৌন্দর্য দেখে ব্রহ্মা নিজেই মোহিত হয়ে পড়েন। দেবীর শ্বেত বসন, শান্ত ও মনোহর রূপ এবং শুভ্রতার প্রতীক তাঁর বাহন রাজহংস—এসবই ব্রহ্মাকে আকৃষ্ট করেছিল।
কিন্তু এক কন্যার প্রতি পিতার এই আকর্ষণ দেবী সরস্বতীর পক্ষে মানা সম্ভব হয়নি। তিনি ব্রহ্মার দৃষ্টিভঙ্গিকে অস্বীকার করেন এবং সরে যেতে চান। সরস্বতীর এই অনীহা দেখে ব্রহ্মা মদন দেব বা কামদেবের সাহায্য নেন। প্রেমের দেবতা কামদেব ব্রহ্মাকে সাহায্য করতে সরস্বতীর মনে প্রেম জাগানোর চেষ্টা করেন, যাতে তিনি ব্রহ্মাকে গ্রহণ করেন। তবে সরস্বতী সেই প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করেন এবং জ্ঞান ও বিদ্যার দেবী হিসেবে নিজেকে স্থির রাখেন।
একটি প্রচলিত তত্ত্ব অনুসারে, ব্রহ্মা হলেন আদি এবং অবিনশ্বর সৃষ্টিকর্তা। তিনি শুধু জগতের স্রষ্টাই নন, বরং তিনি নিজেই সৃষ্টির মূল উৎস। পুরাণ মতে, বিশ্ব সৃষ্টি করতে গেলে পুরুষ ও নারী উভয়েরই প্রয়োজন। তাই ব্রহ্মার থেকেই সৃষ্টি হয়েছে পুরুষ ও নারী জাতি।
হিন্দু দর্শনে যা কিছু স্থির, তা পুরুষের প্রতীক আর যা কিছু চলমান, তা নারীর প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। যেমন, গিরিরাজ হিমালয়—যিনি চিরস্থায়ী ও অপরিবর্তনশীল, তিনি পুরুষের প্রতীক। অন্যদিকে, শান্তনুর পত্নী গঙ্গা—যিনি চিরপ্রবাহমান, তিনি নারীর প্রতীক। এই ধারণার ভিত্তিতে বলা হয়, সৃষ্টি ও ধ্বংসের চক্রকে রক্ষা করতে এই পৃথিবীতে পুরুষ ও নারী উভয়েরই ভূমিকা অপরিহার্য।
সনাতন বিশ্বাস অনুসারে, সৃষ্টির ধারাকে পরিচালিত করতে তিন প্রধান দেবতার উপস্থিতি রয়েছে—ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর। এই ত্রিদেবেরই শক্তিরূপ হলেন তিন দেবী—সরস্বতী, লক্ষ্মী ও চণ্ডী (পার্বতী/দুর্গা)। সরস্বতী হলেন ব্রহ্মার শক্তি, যিনি জ্ঞান ও বিদ্যার প্রতীক। লক্ষ্মী হলেন বিষ্ণুর শক্তি, যিনি ধন-সম্পদ, সৌভাগ্য ও শ্রীবৃদ্ধির দেবী। আর চণ্ডী বা দুর্গা হলেন মহেশ্বরের শক্তি, যিনি শক্তি, ধ্বংস ও পুনর্নির্মাণের প্রতীক।
অনেক পুরাণ মতে, এই তিন দেবী একে অপরের পরিপূরক। তাঁদের একত্রিত শক্তিতেই জগৎ পরিচালিত হয়। তাই সরস্বতী কেবল ব্রহ্মার সহধর্মিণী নন, বরং তিনিই তাঁর জ্ঞানশক্তির রূপ। তবে কিছু পুরাণে তাঁকে ব্রহ্মার স্ত্রী হিসেবেও উল্লেখ করা হয়, যেখানে বলা হয়, ব্রহ্মার সৃষ্টি কার্য সম্পন্ন করার জন্য সরস্বতীর প্রয়োজন ছিল।
দেবী সরস্বতীর স্বামী সম্পর্কিত বিষয়ে নিশ্চিত কোনও একক মত নেই। তিনি ব্রহ্মার মানস কন্যা, আবার কিছু কাহিনিতে তাঁকে ব্রহ্মার পত্নীও বলা হয়। অন্যদিকে, কিছু বিশ্বাস অনুসারে, সরস্বতী কোনও দেবতার স্ত্রী নন, বরং তিনি স্বয়ং নারায়ণের অংশ এবং বিদ্যার শক্তিরূপ।
সনাতন ধর্মের বহুস্তরীয় ও বহুমাত্রিক দর্শনের কারণে দেবী সরস্বতীর স্বামী কে, সে বিষয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে। তবে একথা নিশ্চিত যে, তিনি কেবলমাত্র কোনও দেবতার স্ত্রী নন, বরং তিনি স্বয়ং জ্ঞানের দেবী, যাঁর প্রভাব ও আশীর্বাদ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকে।
অনেক পুরাণে উল্লেখ রয়েছে যে, ব্রহ্মা হলেন জ্ঞানের আধার। কিন্তু জ্ঞান কেবল অন্তরে ধারণ করলেই তা যথেষ্ট নয়, সেটি প্রকাশিত না হলে তার কোনও মূল্য থাকে না। আর সেই প্রকাশের মাধ্যম হল বাক্ বা ভাষা। বাক্যধারার প্রতীকই হলেন দেবী সরস্বতী। তাই তাঁকে বলা হয় ‘বাগদেবী’।

এই ধারণা অনুসারে, ব্রহ্মার মধ্যে যে জ্ঞান ছিল, সেটি প্রকাশের জন্যই সরস্বতীর জন্ম হয়েছিল। তাই সরস্বতী ব্রহ্মার কন্যাস্বরূপ, কিন্তু একইসঙ্গে তিনি ব্রহ্মার শক্তিও। এই কারণেই তাঁকে ব্রহ্মার পত্নী হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
পুরাণে সরস্বতীকে নদীরূপেও কল্পনা করা হয়েছে। নদী যেমন আপন স্রোতে বহমান, জ্ঞানও তেমনই বহমান—এটি থেমে গেলে জীবন দুর্বল হয়ে পড়ে। সরস্বতী নামের মধ্যেই এর ব্যাখ্যা রয়েছে—‘সর’ অর্থ বহমান এবং ‘স্বতী’ অর্থ অস্তিত্ব। অর্থাৎ, সরস্বতী হলেন সেই বহমান জ্ঞানধারা, যা সৃষ্টির ধারাকে অব্যাহত রাখে।
অন্য এক পুরাণ মতে, যখন ব্রহ্মা জগত সৃষ্টি করছিলেন, তখন তিনি অনুভব করেন, সৃষ্টির কাজকে সহজতর করতে একজন সহকারী প্রয়োজন। তাই তিনি নিজের মানস থেকে এক অনিন্দ্যসুন্দরী নারীর জন্ম দেন। কিন্তু সেই নারীর অপরূপ সৌন্দর্য দেখে ব্রহ্মা নিজেই তাঁর প্রেমে পড়েন।
ব্রহ্মা সরস্বতীর প্রতি গভীর আকর্ষণ অনুভব করেন এবং তাঁকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করতে চান। কিন্তু সরস্বতী ব্রহ্মার প্রতি অনীহা প্রকাশ করেন। তাঁর এই অনীহা দেখে ব্রহ্মা মদন দেবের সাহায্য নেন, যিনি প্রেম ও আকর্ষণের দেবতা। মদন দেব সরস্বতীর মনে প্রেম জাগানোর চেষ্টা করেন, কিন্তু তিনি সেই মোহজালে আবদ্ধ হননি।
এই কাহিনিতে দেবী সরস্বতীকে ব্রহ্মার পত্নী বলা হলেও, কিছু শাস্ত্রবিদ মনে করেন, এটি কেবল প্রতীকী ব্যাখ্যা। এখানে ব্রহ্মা হলেন জ্ঞানের আধার, আর সরস্বতী হলেন সেই জ্ঞানের বহিঃপ্রকাশ। তাই তাঁদের সম্পর্ক আসলে পিতা-কন্যা নয়, বরং একজন স্রষ্টা ও তাঁর সৃষ্ট শক্তির সম্পর্ক।
আরেকটি তত্ত্ব অনুযায়ী, দেবী সরস্বতীর প্রকৃত স্বামী ব্রহ্মা নন, বরং তিনি স্বয়ং বিষ্ণুর পত্নী। এই মতানুসারে, সরস্বতী হলেন লক্ষ্মীর আরেক রূপ।
লক্ষ্মী দেবী যেমন ধন, সৌভাগ্য ও ঐশ্বর্যের প্রতীক, তেমনই সরস্বতী হলেন জ্ঞান ও বিদ্যার প্রতীক। উভয়েই এক শক্তির দুই দিক—একদিকে ভৌত ও আর্থিক সমৃদ্ধি, অন্যদিকে মানসিক ও আত্মিক সমৃদ্ধি। শাস্ত্র অনুসারে, শ্রীবিষ্ণু জগৎ রক্ষার দায়িত্বে আছেন, আর এই রক্ষার জন্য তাঁর দুটি শক্তির প্রয়োজন—একটি লক্ষ্মী, যিনি ধন ও সম্পদের প্রতীক, এবং অন্যটি সরস্বতী, যিনি জ্ঞান ও প্রজ্ঞার প্রতীক।
দেবী সরস্বতীর স্বামী সম্পর্কে নির্দিষ্ট কোনও সিদ্ধান্তে আসা কঠিন, কারণ বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে এ বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত পাওয়া যায়।
কিছু পুরাণ তাঁকে ব্রহ্মার স্ত্রী বলেছেন, যেখানে তিনি ব্রহ্মার মানস সৃষ্টির প্রতীক।
অন্যদিকে, কিছু কাহিনিতে তাঁকে লক্ষ্মীর অপর রূপ হিসেবে দেখানো হয়েছে, যেখানে তিনি শ্রীবিষ্ণুর সহধর্মিণী।
কিছু দার্শনিক মতে, সরস্বতী কেবল এক ব্যক্তি নন, বরং জ্ঞানের প্রতীকী রূপ। তাই তিনি কোনও নির্দিষ্ট দেবতার সঙ্গে সম্পর্কিত নন, বরং তিনি সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডে জ্ঞানের বিস্তার ঘটানোর জন্য চিরন্তনভাবে বিরাজ করছেন।
এ থেকেই বোঝা যায়, দেবী সরস্বতী কেবল কোনও দেবতার সহধর্মিণী নন, বরং তিনি এক সর্বজনীন শক্তি। তিনি মানুষের মনের অন্ধকার দূর করে, জীবনকে আলোকিত করেন এবং সৃষ্টির ধারাকে সচল রাখেন।